গহন গহীন-প্রেসিডেন্ট ওবামার সামনের চ্যালেঞ্জ by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর মানুষটির চার বছরের জন্য ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউসে অবস্থানকালে বিশ্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার নৈতিক অধিকার অর্জনের ঘটনা এখনো ইতিহাস। পঁয়তাল্লিশতম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াই এখন অবসিত।
আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ, আভাস-পূর্বাভাস, জনমত জরিপ, পত্রপত্রিকার ধারাভাষ্য এখন মোহাফেজখানায় ফাইলবন্দি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সাংবিধানিক বিধি অনুযায়ী প্রতি চতুর্থ বর্ষের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে দুই প্রধান দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ার সূচনা হয়, যা চলে মাসের পর মাস। একজন প্রার্থী শেষ পর্যন্ত নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে যখন চূড়ান্তভাবে মনোনীত হন, তখন সব প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবসান ঘটিয়ে অন্য প্রার্থীরা দলের প্রার্থীকে কালবিলম্ব না করে এনডোর্স করেন। রাজনৈতিক সৌজন্যের চরম উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল প্রার্থীরা দেখান উদার চিত্তে।
যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে মাথা উঁচু নেতৃত্বের সংকটে ভুগছে। একসময় অনেক বড় বড় নাম রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়েছে। অবক্ষয়ের সূচনা- ইতিহাসবিদরা মনে করেন, শুরু হয় প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের আমল থেকে। টেক্সাসের ধনকুবের পরিবারের সন্তানটির রাজনীতিতে আসার কোনোই যৌক্তিক কারণ ছিল না। কিন্তু নিয়তি নির্ধারিত হয়েই শনৈঃ শনৈঃ হোয়াইট হাউসে প্রবেশাধিকার পাওয়ার পর জর্জ ডাব্লিউ বুশ নিজেকে মহাশক্তিধর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভাবতে শুরু করেন, তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ 'ডিসিশন পয়েন্টস'- যা প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে, তাতে বুশ সাহেবের চোখে শুধুই দুইজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উপযুক্ত বিবেচিত ছিলেন- একজন আব্রাহাম লিংকন, অন্যজন তাঁর পিতা প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। রুজভেল্ট, জর্জ ওয়াশিংটন, ইউলিসিস গ্র্যান্ট, কেনেডি, ক্লিনটন- এঁরা কেউ ছিলেন না তাঁর প্রশংসার পাত্র!
ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যেই জর্জ ডাব্লিউ বুশ বিশ্বমোড়লের পূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন ভয়াবহ এক সতর্কবাণী উচ্চারণের মধ্য দিয়ে : হয় তোমার অবস্থান আমাদের সঙ্গে, নতুবা তুমি শত্রুপক্ষের!
ইরাকের মতো ইতিহাস-ঐতিহ্যের সূতিকাগার দেশটিকে বুশের গরিমার কারণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে সময় লাগল না। ডাব্লিউএমডি-ওয়েপন অব মাস ডেস্ট্রাকশন- গণবিধ্বংসী অস্ত্র ইরাকের অস্ত্রভাণ্ডারে প্রচুর পরিমাণে মজুদ আছে- এই দোহাই দিয়ে পূর্ণমাত্রায় ইরাকে মিলিটারি অভিযান পরিচালনার হুকুম দিতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করলেন না যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সর্বাধিনায়ক প্রেসিডেন্ট। ওয়ার রুম থেকে সদম্ভে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ঘোষণা করলেন, যেসব যাত্রীবাহী বিমান আমাদের আকাশসীমায় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে নির্দিষ্ট স্থানে অবতরণ করতে অস্বীকার করবে, সেগুলোকে গুলি করে ভূপাতিত করা হবে- এ রকম ফরমান জারি করে তাতে স্বাক্ষর দিয়েছেন তিনি! কী ভয়াবহ যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিরস্ত্র সিভিলিয়ান জনগণের বিরুদ্ধে!
অসম শক্তির যুদ্ধে ইরাকের পরাজয় ছিল শুধু সময়ের ব্যাপার। বিধ্বস্ত ইরাকের অমূল্য ঐতিহাসিক নিদর্শনসমৃদ্ধ বাগদাদ জাদুঘর হলো লুণ্ঠিত। গিলগামেশ নামের প্রস্তরফলকে খোদিত মহাকাব্য হলো ক্ষতিগ্রস্ত।
নিরীহ মানুষের রক্তের স্রোতে ফোরাত আর দজলা নদীর পানি রঞ্জিত হলো। যুদ্ধ শেষে প্রাপ্তিফল : গণবিধ্বংসী অস্ত্রের প্রচারণা ছিল নিছকই যুদ্ধ বাঁধানোর বাহানা।
যুদ্ধশেষে যখন সন্ধান মিলল না ডাব্লিউএমডি নামক একটি মারণাস্ত্রও, বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না প্রেসিডেন্ট বুশ। মার্কিন সেনা ক্ষয়েও আহত হলো না তাঁর বিবেক। ২০১০ সালের ৯ নভেম্বর, ক্রাউন পাবলিশার্স প্রকাশিত বিশালাকার হার্ড কভারে আত্মজৈবনিক রচনা ডিসিশন পয়েন্টস টেক্সাসের ডালাসে বিক্রির জন্য উন্মুক্ত করা হলো। ঘটনাক্রমে সেদিন ডালাসে থাকার সুযোগ নিয়ে কয়েকটি বইয়ের আউটলেটে বইটির ব্যাপারে জনমনে কেমন আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে তার খোঁজ নিতে গিয়ে প্রত্যাশিতভাবেই ফল পেলাম। বইয়ের ব্যাপারে পাঠকদের মধ্যে তেমন উৎসাহ দেখা গেল না। কারণ এই বইয়ে ছিল না প্রেসিডেন্ট বুশের আত্মসমালোচনার লেশমাত্র। মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে আত্মচরিত লেখার যে রেওয়াজ আছে, ডিসিশন পয়েন্টস সেই ধারায় শুধুই এক সংযোজন। স্মরণযোগ্য, প্রেসিডেন্ট বুশ টেক্সাসের সন্তান!
প্রেসিডেন্ট বুশের পর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী বারাক ওবামা দ্বিতীয়বার যে জয়ী হবেন তা মোটামুটি নিশ্চিত ছিল। কারণ মার্কিন ভোটারদের চোখে বুশের ইমেজ তখন শূন্যের কোঠায়।
বারাক ওবামাকে কট্টরপন্থী মার্কিন ভোটারদের মন জয় করতে অনেক কসরত করতে হয়। তিনি যে কেনিয়ান বংশোদ্ভূত মুসলিম পিতার সন্তান এবং ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তার জন্য নানা রকম যুক্তি দিতে হয়। মুসলমান ভোটাররা ওবামার এই দোলাচলের কারণে দারুণ আহত হয়েছিলেন।
দ্বিতীয়বারের নির্বাচনে পূর্বাভাস ছিল, ওবামাকে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পঁয়তাল্লিশতম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়নের দীর্ঘ প্রক্রিয়া খুব কাছ থেকে লক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘ অবস্থানের কারণে। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রেসিডেন্ট ওবামার ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থিতা অর্জন নিশ্চিত।
রিপাবলিকান প্রার্থী নির্বাচনে নানা রকম সমীকরণ শেষে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ৭০তম গভর্নর মিট রমনির মনোনয়ন লাভের পর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পূর্বাভাস সর্বমহলে শোনা গেল। দুই শিবিরে বিভক্ত মেইন স্ট্রিম পত্রিকাগুলোর ভাষ্যে ভোটাররা যতটা আলোকিত হয়েছেন, তার চেয়ে বেশি হয়েছেন বিমূঢ়।
৬ নভেম্বর নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেল, প্রেসিডেন্ট ওবামা বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউসে প্রবেশাধিকার পেলেন। ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ওবামা পেলেন ৩৩২ ভোট, বিপরীতে মিট রমনি পেলেন মাত্র ২০৬ ভোট (নির্বাচিত হতে ২৭০ ভোটই যথেষ্ট)। পপুলার ভোটেও প্রেসিডেন্ট ওবামা জয়ী হলেন (৬৪,৪৩০,৫৮৮, রমনি : ৬০,২২১,৭৪৬)। গড় হিসেবে যথাক্রমে ৫০.৮ শতাংশ ও ৪৭ শতাংশ।
২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি ইউএস ক্যাপিটালের ওয়েস্ট ফ্রন্টে শপথ গ্রহণের আগেই প্রেসিডেন্ট ওবামাকে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সিআইএ প্রধান চার তারকা খচিত বীর জেনারেল ডেভিড পেত্রাউস পরকীয়া সম্পর্কের দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করেছেন। নির্ভরযোগ্য সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন দ্বিতীয়বার দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যাঁর নাম শোনা যাচ্ছিল, সেই সুজান রাইস লিবিয়ার বেনগাজিতে সন্ত্রাসী হামলায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্টিভেন ইভান্সসহ তিনজনের মৃত্যু সম্পর্কে যে উক্তি করেন, তা পরবর্তী সময়ে অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। ফলে জাতিসংঘে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন রাষ্ট্রদূত সুজান রাইসের নিযুক্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।
তার ওপর রয়েছে মিট রমনির প্রতি ইসরায়েলের দৃঢ় সমর্থন। মরমন সংখ্যালঘু ধর্মমতে বিশ্বাসী মিট রমনি অবশ্য ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে অভিনন্দন জানিয়ে সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস দিয়ে রেখেছেন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক

No comments

Powered by Blogger.