সরেজমিন-নিয়মের ধার ধারে না বহু কারখানা by আরিফুজ্জামান তুহিন ও তোফাজ্জল হোসেন রুবেল

১৯৬৫ সালের কারখানা আইনে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে অনেক বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু ঢাকা ও আশুলিয়ার কয়েকটি পোশাক কারখানা ঘুরে সেসব আইন মানার কোনো বালাই দেখা যায়নি। আইন থাকলেও ওই সব কারখানার প্রবেশ ও নির্গমন পথ সার্বক্ষণিক খোলা থাকে না।
কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে কারখানা থেকে বের হতে হয় শ্রমিকদের। ওই কারখানাগুলোর সিঁড়িও তিন ফুটের বেশি চওড়া নয়। নেই যথেষ্ট অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম। যা আছে সেগুলোরও নেই আগুন নেভানোর সক্ষমতা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বিধান অনুযায়ী, কারখানার প্রতি তলায় কার্বন ডাই-অক্সাইডসমৃদ্ধ অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ও শুকনো রাসায়নিক গুঁড়া সংরক্ষিত অবস্থায় রাখার কথা রয়েছে। বিকল্প সিঁড়িপথ কমপক্ষে ৪২ ইঞ্চি প্রশস্ত ও সর্বোচ্চ ৪৫ ডিগ্রি কোণে রাখতে হবে।
প্রতি তলায় কমপক্ষে দুটি অগ্নিনিরোধক পয়েন্ট থাকতে হবে এবং প্রতি পয়েন্টে ২০০৪ লিটার পানি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ড্রাম ও চারটি বালতি রাখতে হবে। ধোঁয়া নির্ণয়ক যন্ত্র ও হোস রিল থাকতে হবে।
রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে মিরপুরে। মিরপুর-২ নম্বর সেকশনে একটি চার তলা ভবনে গড়ে উঠেছে আনিকা অ্যাপারেলস লিমিটেড নামের শতভাগ রপ্তানিমুখী একটি গার্মেন্ট কারখানা। কর্তৃপক্ষের দাবি, সব নিয়ম মেনেই এখানে কাজ চলে। গার্মেন্টটির প্রশাসন বিভাগের প্রধান এম শফিউদ্দিন ভুঁইয়ার দাবি, যথেষ্ট অগ্নিনির্বাপক প্রস্তুতি রয়েছে তাঁদের। প্রতি ফ্লোরে রয়েছে পানি ও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এক হাজার ৪০০ শ্রমিকের এ প্রতিষ্ঠানটিতে প্রতি ফ্লোরে ৫০ লিটার পানি ধরে, এমন একটি করে ড্রাম রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ১০ লিটার পানি বহন করতে পারে এমন চারটি বালতি। কোনো হোস রিল দেখা যায়নি। সাড়ে তিন ফুটের মূল দরজাটি সব সময় বন্ধ থাকে। বিকল্প একটি সিঁড়ি থাকলেও সেটার দরজা মূল দরজার সঙ্গে যুক্ত থাকায় কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
একই অবস্থা দেখা গেছে মিরপুরের আবাসিক অঞ্চল মিল্কভিটা রোডের ৭ নম্বর সেকশনের রিও ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেডে ও রিও ডিজাইন লিমিটেডের কারখানায়ও। এ কারখানা যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্টের জন্য পোশাক তৈরি করে। কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রতি মাসে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে অগ্নিনির্বাপণের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হয়। নিয়মিত মহড়াও হয়। শ্রমিকদের ওপর কড়া নজরদারি রাখার জন্য কারখানাটির প্রতি তলায় সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এই গার্মেন্টের ব্যবস্থাপক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের প্রতিটি তলায় অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রয়েছে।'
গার্মেন্টটি ঘুরে দেখা যায়, ১২ তলার এ কারখানায় এক হাজার ৭০০ শ্রমিক কাজ করেন। প্রতি তলায় রয়েছে সাড়ে ছয় হাজার স্কয়ার ফুট জায়গা। কিন্তু পানির জন্য যে হোস রিল রয়েছে, এর ব্যাসার্ধ মাত্র এক ইঞ্চি। এখানে আগুন লাগলে কোনোভাবেই এত সরু পানির পাইপ দিয়ে তা আয়ত্তে আনা সম্ভব নয় বলে জানান কারখানার একাধিক শ্রমিক। তাঁদের অভিযোগ, বিদেশিদের দেখানোর জন্য মালিকরা নামকাওয়াস্তে এসব ব্যবস্থা রাখেন। অপ্রশস্ত সিঁড়ি আর ঘিঞ্জি পরিবেশ যেকোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে।
মিরপুরের শিল্পাঞ্চলে রয়েছে প্রায় ৭০টি গার্মেন্ট কারখানা। প্রায় সব কারখানার সিঁড়ি তিন থেকে সাড়ে তিন ফুটের কাছাকাছি। নিরাপত্তার অজুহাতে এসব গার্মেন্ট কারখানার প্রধান ফটক সব সময় বন্ধ রাখা হয়।
মিরপুরের কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া অঞ্চলের গার্মেন্টগুলোতেও দেখা গেছে একই চিত্র। সরেজমিনে গিয়ে ৯৬০ পূর্ব শেওড়াপাড়ার আউট ফ্যাশন লিমিটেডের সিঁড়িতে কোনো আলো দেখা যায়নি। জরুরি নির্গমন ব্যবস্থাও নেই। আট তলা এ ভবনের সাত তলায়ই গার্মেন্ট কারখানা। শেওড়াপাড়ার জে কে ফ্যাশন লিমিটেড, অয়েল টেক্স সোয়েটার লিমিটেড, ইয়ুথ ফ্যাশন লিমিটেডের বেলায়ও দেখা গেছে একই চিত্র। এসব গার্মেন্ট কারখানার সিঁড়ি আড়াই থেকে তিন ফুট প্রশস্ত। নেই জরুরি সিঁড়ির ব্যবস্থা। অন্যদিকে কিছু কিছু কারখানায় ব্যতিক্রমও দেখা গেছে। সেগুলোতে বেশির ভাগ নিয়ম-কানুন অনুসরণ করা হয়। তবে তাদের সংখ্যা হাতেগোনা।
আশুলিয়া ঘুরে দেখা গেছে, অনেক কারখানাই বহুতল ভবনে গড়ে উঠলেও সেগুলোতে নিরাপত্তা সিঁড়ি বা জরুরি নির্গমনপথ নেই।
বাংলাদেশের যেকোনো শিল্প-কারখানা স্থাপনে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক। এ নিয়ম চালু ছিল গার্মেন্ট কারখানায়ও। তবে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়া থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় গার্মেন্ট কারখানাগুলোকে। ফলে গার্মেন্ট কারখানাগুলো কোথায় হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে তা তদারকির আর উপায় থাকে না।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক আবুল মুনসুর বলেন, '২০০৭ সালের আগে পর্যন্ত পরিবেশ অধিপ্তর সরেজমিন অনুসন্ধান করে পরিবেশের ছাড়পত্র দেওয়ার পরই কেবল কারখানা বা ফ্যাক্টরি নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হতো। কিন্তু ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর শুধু গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি নির্মাণে পরিবেশের ছাড়পত্র নেওয়ার বিধানটি তুলে দেওয়া হয়। ফলে এ বিষয়টি আমরা আর এখন দেখি না।'
অভিযোগ রয়েছে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বিধান অনুযায়ী পোশাক কারখানাগুলো পরিচালিত হয় না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক আবু নাঈম মো. শহিদুল্লাহ বলেন, 'আমরা যখন ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স দিই তখন তারা সব ধরনের উপাদান পূর্ণ রাখে। পরে আর সেগুলো থাকে না। আর কোন জায়গায় কারখানা করবে বা গোডাউন তৈরি করবে, তা নির্ধারণ করে রাজউক।'
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার এক গার্মেন্ট মালিক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মিড লেভেলের কারখানা কর্মকর্তারা মূলত অদক্ষ। তাঁদের অদক্ষতার কারণে এসব দুর্ঘটনায় শ্রমিকরা মারা যাচ্ছে। মালিকপক্ষ থেকে কখনো বলা হয় না যে আগুন লাগার সময় কারখানার গেট তালা দিয়ে রাখো।'
গার্মেন্টগুলোর আগুন নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বিজিএমইএর সহসভাপতি ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, 'আমাদের একটা ফায়ার ইউনিটের মাধ্যমে ফ্যাক্টরিগুলো তদারক করা হয়।' বেশির ভাগ কারখানায় প্রশস্ত সিঁড়ি নেই- এমন অভিযোগের জবাবে ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, 'কোনো বহুতল ভবনের গার্মেন্ট কারখানায় যদি একাধিক গেট ও প্রশস্ত সিঁড়ি না থাকে তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।'
অন্যদিকে শ্রমিক নেতারা বলছেন, মালিকদের অত্যধিক মুনাফা করার প্রবণতার কারণে শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। প্রবীণ শ্রমিক নেতা ড. ওয়াজিউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'যদি আগুনে পুড়ে মালিকদের কেউ মারা যেতেন তাহলে আগুন আর ধরত না। তাঁরা কম জায়গায় বেশি শ্রমিককে খাটান। এ কারণে পুরো কারখানা ঝুঁকির মধ্যে চলে যায়।' তিনি আরো বলেন, 'ইপিজেডে তো অনেক ফ্যাক্টরি। সেখানে এমন ঘটনা ঘটে না। আদমজি অনেক বড় প্রতিষ্ঠান ছিল, সেখানেও আগুন পুড়ে কেউ মারা যায়নি। কারণ সেখানে কাজের জায়গা অনেক প্রশস্ত ছিল। আর এখন বিল্ডিং তোলার নিয়ম-কানুন না মেনেই একের পর এক গার্মেন্ট তৈরি হচ্ছে।'
দেখার কেউ নেই : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গার্মেন্ট কারখানায় কী কী থাকতে হবে এর সুনির্দিষ্ট একটি ছক দেওয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- সব কারখানার ছাদ সম্পূর্ণ খোলা থাকবে। নিচ থেকে ছাদে ওঠার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ছাদে ওঠার দরজা সার্বক্ষণিক খোলা রাখতে হবে। কারখানায় যাতায়াতের পথ, বিকল্প সিঁড়ি ও জরুরি গেট খোলা রাখতে হবে। দুটি মেশিনের মাঝখানে চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কারখানার ফ্লোরে কাপড়সহ সব ধরনের দাহ্যসামগ্রী বড় লটে স্তূপ করা যাবে না। শর্টসার্কিট এড়ানোর জন্য কারখানাগুলো নিয়মিত নিজেদের পানি, স্যুয়ারেজ লাইন ও বৈদ্যুতিক লাইন পরীক্ষা করবে। কারখানাগুলোকে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে শ্রমিকদের নিয়ে নিয়মিত মহড়া চালাতে হবে। যতক্ষণ কারখানা চালু থাকবে, ততক্ষণ কারখানার অগ্নি মহড়া কর্মীরা ফ্লোরে টহল দেবেন।
কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এসব বিধি-বিধানের তোয়াক্কা করেন না গার্মেন্ট মালিকরা। বিভিন্ন কারখানায় দেখা গেছে, সিঁড়ির পাশে তৈরি পোশাক স্তূপাকারে রেখে চলাচলের পথ অপ্রশস্ত করে রাখা হয়েছে। ছাদ কোনো সময় খোলা থাকে না। অগ্নিনির্বাপকের ব্যবস্থাও নগণ্য।
এক গার্মেন্ট ব্যবাসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'যত কম জায়গায় বেশি শ্রমিককে কাজ করানো যায়, তত বেশি লাভ হয়। এ কারণে কম জায়গায় বেশি শ্রমিককে রেখে মালিকরা বেশি মুনাফার জন্য ঝুঁকি নেন। পাশাপাশি গার্মেন্টের গুদাম ঘর থাকে নিচ তলায় দরজার সামনে। গুদামে সুতা থাকার কারণে আগুনের তীব্রতা গুদামেই বেশি থাকে। শ্রমিকরা গুদামের সামনে দিয়ে বেরোতে পারেন না।' গার্মেন্টের গুদাম বাইরে হওয়া উচিত বলেও এই ব্যবসায়ী মনে করেন।
এসব দেখার জন্য ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর রয়েছেন মাত্র পাঁচজন। এত কমসংখ্যক ইন্সপেক্টর দিয়ে কোনোভাবেই কারখানা পরিদর্শন করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বয়লার বিভাগের প্রধান মো. বাকি বিল্লাহ বলেন, 'মাত্র পাঁচজন পরিদর্শক দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। খুবই নাজুক পরিস্থিতিতে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। এত বড় শিল্পাঞ্চলে এই লোকবল দিয়ে কাজ করা অসম্ভব।'

No comments

Powered by Blogger.