বাংলা নববর্ষ-সম্প্রীতির মহোৎসবে মিলিত হোক সকল ধারা by আবু সাঈদ খান

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের করণীয় হচ্ছে, নতুন আঙ্গিকে নববর্ষ উদযাপনের ক্ষেত্রে সব বাঙালিকেই এক মিছিলে আনা। এখানে আদিবাসীদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষের এই মিলনমেলার শক্তি অপরাজেয়।
এই নববর্ষ উদযাপন, বসন্তবরণ, পৌষমেলা ইত্যাদি ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতাসহ সব অশুভ শক্তি পরাস্ত হবে। গড়ে উঠবে সবার জন্য বাসযোগ্য মানবিক সমাজের বুনিয়াদ


পহেলা বৈশাখ এখন বাংলার সর্ববৃহৎ ও সর্বজনীন উৎসবে পরিণত। আগে বলা হতো, এটি শহুরে উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের একাংশের বিনোদন_ পহেলা বৈশাখের সকালে বাহারি পাঞ্জাবি-শাড়ি পরে রাজধানীর রমনা বটমূলে বসে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা আর পান্তা-ইলিশ খাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন আর এটি উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে নেই। রাজধানীর নিম্নবিত্ত, কেরানি-পিয়ন-শ্রমিক-দোকানি-ফেরিওয়ালাসহ সর্বস্তরের সর্বশ্রেণীর নরনারীর অংশগ্রহণে বাংলা নববর্ষ উদযাপন আজ নতুন মাত্রায় উন্নীত। শুধু তাই নয়, রাজধানী থেকে অন্য শহরগুলোতে এমনকি গ্রামেও এ ঢেউ আছড়ে পড়েছে।
রাজধানীর উৎসবের পরিধি ও চরিত্র বদলেছে। ক'বছর আগেও রমনার বটমূল ও তার আশপাশে জনসমাগম হতো। এখন রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাংলা একাডেমী, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাপিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। রবীন্দ্রসরোবর নতুন সংযোজন। এর বাইরেও এবার পাড়া-মহল্লা, ক্লাবসহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে নববর্ষ উদযাপিত হয়েছে। অন্যদিকে রবীন্দ্র-নজরুলসঙ্গীতের পাশাপাশি বাউল-ভাওয়াইয়াসহ লোকগীতির সুর-মূর্ছনা নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠানের সঙ্গে লোকায়ত জীবনের সংযোগ ঘটিয়েছে। একে আরও বাঙ্ময় করে তুলেছে লোকজ শিল্পের মেলা।
এবার পলাশী থেকে কাকরাইল, সোনারগাঁও থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ছিল জনতার উপচেপড়া ঢল। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, বয়স্ক নরনারী সবাই নতুনের ডাকে এক মিছিলে শামিল হয়েছে। এ ভিড়ের মধ্যে একাকার হয়ে বুঝেছি, এখানে প্রাণের উচ্ছলতা আছে, কিন্তু উচ্ছৃঙ্খলতা নেই। থার্টিফার্স্ট নাইটের আয়োজন থেকে এ অনুষ্ঠান আলাদা। সেখানে যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, এখানে তেমন কিছু ঘটার আশঙ্কা নেই। আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, থার্টিফার্স্টের সেই অঘটনঘটনপটীয়স তরুণরা কি আজ বাসায় ঘুমাচ্ছে, না ওরা আজ ভিন্ন মানব-মানবীতে পরিণত হয়েছে!
বেশভূষায়ও নতুনের ছোঁয়া। ঈদ, পূজা, বুদ্ধপূর্ণিমা ও বড়দিনেও নতুন পোশাক পরে সবাই, তবে পহেলা বৈশাখের পোশাক ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, শার্টের রঙ-ডিজাইনে রয়েছে নতুনত্ব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লাল-সাদার সমাহার। অনেকের পোশাকে লোকজ চিত্রশিল্পের ছাপ।
নববর্ষের অনুষ্ঠান থেকে কারও দূরে থাকার সুযোগ নেই। রঙবেরঙের নববর্ষের কার্ড, মেইল-ফেসবুক-মোবাইল ফোনে শুভেচ্ছা বার্তা বিনিময়ে শিশু-কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, বয়স্ক সবাই সমানভাবে আন্দোলিত।
বাংলা নববর্ষ উৎসবের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে অনুষ্ঠানটির সর্বজনীন ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র। দেশে ঈদ, পূজা, বুদ্ধপূর্ণিমা ও বড়দিনও ব্যাপকভাবে পালিত হয়, যা মূলত নিজ নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমিত। ওইসব অনুষ্ঠানে ভিন্ন সম্প্রদায়ের নরনারী-শিশুরা যোগ দেয়, তবে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে। আর বাংলা নববর্ষ সব সম্প্রদায়ের, সব ধর্মের, সব বর্ণের_ সমগ্র জনগোষ্ঠীর অনুষ্ঠান।
বাংলা নববর্ষ বরণ থেকে দূরে নেই আদিবাসী জনগোষ্ঠীও। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগুলোর বর্ষবরণে কখনও ভাটা পড়েনি। সেই সুদূর অতীত থেকে চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই ও ত্রিপুরারা বৈসুক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। বৈসুকের 'বৈ', সাংগ্রাইয়ের 'সা' এবং বিজুর 'বি' নিয়ে একত্রিতভাবে বৈসাবি নামকরণ করা হয়েছে সাম্প্রতিককালে। অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে নববর্ষ বরণের রেওয়াজ অব্যাহত রয়েছে।
দীর্ঘদিন বাংলা নববর্ষকে বরণের ক্ষেত্রে দোটানায় ছিল বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়। মোল্লাতন্ত্র মুসলিম সম্প্রদায়কে শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ফতোয়াবাজির আশ্রয় নেয়, যা এখনও অব্যাহত আছে। এর ওপর পড়েছে ওহাবি-ফারায়েজি-পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব। এরা লোকায়ত সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানি বলে ত্যাগ করতে উস্কানি দেয়। এ থাবা থেকে বাদ পড়েনি চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখী মেলাও। তবে কৃষক ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, লোকায়ত সংস্কৃতি_ যাদের জীবন-সংগ্রামের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, তাদের লোকজ সংস্কৃতি থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। চৈত্রসংক্রান্তির মেলা থেকেই তাদের নতুন বছরের জন্য কাস্তে, মাথাল, কুড়াল, দা, বঁটিসহ নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী কিনতে হয়। বাদ যায় না আম কাটার ছুরি, বাচ্চাদের জন্য পুতুল আর কদমা, বাতাসা, জিলাপি, আমিরতি, দানাদারসহ রকমারি মিষ্টিও।
আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে। তখন দেখেছি, পহেলা বৈশাখের সকালে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা থেকে আনা মিষ্টি দিয়ে সবাই মিষ্টিমুখ করত। উঠানে বসে নতুন কাস্তে-দা-বঁটি-কুড়াল ধার বা ঘষামাজা করা হতো। ছেলেমেয়েরা বাঁশি বাজাত, আর নতুন ছুরি দিয়ে আম কাটত। নতুন ছুরি দিয়ে আম কাটার যে কী আনন্দ তা আজও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল আছে। আর সকালে বাবা কিংবা দাদার হাত ধরে হালখাতায় যাওয়া ছিল সবচেয়ে আনন্দের ঘটনা। বিকেলে ঘোড়দৌড়, হা-ডু-ডু, কুস্তি খেলা সবাই উপভোগ করত। পহেলা বৈশাখ ছিল কৃষকের আটপৌরে জীবনে খানিকটা স্বস্তি, সেই সঙ্গে নতুন করে জীবনযুদ্ধে শামিল হওয়ার প্রস্তুতি। আজকে নগরে-বন্দরে নববর্ষের যে আয়োজন, তা আমাদের জীবন-সংগ্রামকে প্রতিফলিত করে না। আমরা এখন বাংলা বর্ষপঞ্জির ধার ধারি না। আমরা হিসাব-নিকাশ করি খ্রিস্টীয় সাল-তারিখে। আমাদের পূর্বপ্রজন্ম অতি আদর-ভালোবাসায় সম্রাট আকবর প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহীকে বঙ্গাব্দে পরিণত করেছিল, নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ করে নিয়েছিল, যেটি এ প্রজন্মের কাছে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের অংশ। আমরা আজ নববর্ষ বরণ করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে সেতুবন্ধ রচনা করছি। এ অনুষ্ঠান আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে এক অসাম্প্রদায়িক লোকায়ত জীবনের সঙ্গে; যা অসাম্প্রদায়িক-সেক্যুলার মানবিক সমাজ গড়ার নিরন্তর প্রেরণা।
কৃষক-গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে বাংলা সন-তারিখ এখনও গুরুত্ব হারায়নি। বাংলা সন-তারিখ দেখেই তারা ফসল বোনে, ফসল তোলে, দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যবহার করে বাংলা পঞ্জিকা। খোদ রাজধানীর পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা বাংলা সন-তারিখ ভুলে যাননি। এখনও তারা বাংলা নববর্ষের অতীত ঐতিহ্য অনুযায়ী হালখাতা মহরত করেন।
১৪ এপ্রিল শহরগুলো যখন নববর্ষের অনুষ্ঠানমালায় উচ্চকিত, তখন পুরান ঢাকা ও গ্রামবাংলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে চৈত্রসংক্রান্তি, বছরের বিদায়ী উৎসব। পরদিন অর্থাৎ সরকারি পঞ্জিকা অনুযায়ী ২ বৈশাখে হালখাতা। খতিয়ে দেখা যাক, কেন এই বৈসাদৃশ্য?
আমরা জানি, সম্রাট আকবর একটি বিজ্ঞানভিত্তিক কর্ম-উপযোগী পঞ্জিকা প্রণয়নের জন্য জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লা সিরাজীকে দায়িত্ব দেন। সিরাজী ৯৬৩ হিজরির মহররম মাসে বৈশাখের সূচনা করেন, মহররম তখন বৈশাখ মাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, আর সেই বৈশাখ থেকেই বঙ্গাব্দের শুরু হয়। হিজরি সনের চান্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষে রূপান্তর করায় নতুন এই সন-তারিখ ফসল উত্তোলন ও প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পঞ্জিকায় রূপ লাভ করে। সৌরবর্ষ প্রায় ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা হওয়ার কারণে খ্রিস্টীয় সালে ৪ বছর পরপর ফেব্রুয়ারি মাস ২৯ দিনে হয়, এই একদিন লিপইয়ার বা অধিবর্ষ। বাংলা সনে তা নির্দিষ্ট করা ছিল না। যে কারণে খ্রিস্টীয় বা অন্য সৌর সালের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে গরমিল দেখা দিয়েছিল। তা দূর করতে বাংলা একাডেমী ১৯৬৬ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি চার বছর পরপর চৈত্র মাসের সঙ্গে একদিন যোগ করে খ্রিস্টীয় সালের সঙ্গে সমন্বয়ের প্রস্তাব করে। সেই প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলা পঞ্জিকা আজ সরকারিভাবে গৃহীত। এখন বাংলাদেশে বঙ্গাব্দ গণনা প্রক্রিয়া বিজ্ঞানভিত্তিক ও আধুনিক। কিন্তু পুরান ঢাকাসহ দেশের ব্যবসায়ী শ্রেণী তা মেনে নিতে পারছে না। নতুন পঞ্জিকা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হচ্ছে না প্রত্যন্ত অঞ্চলে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন স্থানে পুরনো পঞ্জিকা চালু রয়েছে। ফলে সেখানকার চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষের সঙ্গে আমাদের উদযাপনে একই রকম পার্থক্য সূচিত হচ্ছে। খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, পশ্চিমবঙ্গে পঞ্জিকাকে আধুনিকীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পুরোহিত ও জ্যোতির্বিদদের বিরোধিতার মুখে তা সম্ভব হচ্ছে না। তারা সংস্কারের বিরোধিতার ক্ষেত্রে কী যুক্তি দিচ্ছেন, আমি জানি না। তবে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ কেউ বলছেন, পূজা-অর্চনার ক্ষেত্রে নক্ষত্র-তিথির ব্যাপার আছে। আবার হিন্দু সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলা হচ্ছে, মেলা-নববর্ষ-হালখাতা তো ধর্মীয় উৎসব নয়। তবে এ ক্ষেত্রে তিথি-নক্ষত্রের হিসাব কেন প্রয়োজন?
সে যা-ই হোক, নববর্ষের যজ্ঞে সব মানুষের একই দিনে শরিক হওয়া উচিত। এখানে মতদ্বৈধতার সুযোগ নেই। এমনকি ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ দুনিয়ার যেখানে যত বাঙালি আছে, তারা একই দিনে উৎসব পালন করলে তা আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের বাঙালিদের আমরা কী করে শোনাব? বাংলাদেশ সরকারিভাবে নতুন তারিখ গণনার রীতি অনুসরণ করার আগে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ-আলোচনা, এমনকি যৌথ কমিশনও করতে পারত। আমার মনে হয়, এখনও বিষয়টি নিয়ে ভারত, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে এবং আলোচনার মাধ্যমে যৌক্তিক সমাধানে পেঁৗছানোও সম্ভব।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের করণীয় হচ্ছে, নতুন আঙ্গিকে নববর্ষ উদযাপনের ক্ষেত্রে সব বাঙালিকেই এক মিছিলে আনা। এখানে আদিবাসীদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষের এই মিলনমেলার শক্তি অপরাজেয়। এই নববর্ষ উদযাপন, বসন্তবরণ, পৌষমেলা ইত্যাদি ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতাসহ সব অশুভ শক্তি পরাস্ত হবে। গড়ে উঠবে সবার জন্য বাসযোগ্য মানবিক সমাজের বুনিয়াদ।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
 

No comments

Powered by Blogger.