চরাচর-জোকার জীবন by ফখরে আলম

রং মেখে সং সেজে শত শত বছর ধরে এই জনপদে জোকাররা মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে অনাবিল আনন্দ দিয়ে আসছেন। জোকার মানেই হাসি-তামাশা। জোকার মানেই আনন্দ-ফুর্তি। অনেকে জোকার নন, কিন্তু তাঁর আচরণে হাসির খোরাক পাওয়া গেলে তাঁকে জোকারই বলা হয়।


এই সমাজে এখন আর আগের মতো জোকার দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু তার পরও জোকাররাই সার্কাসের প্রাণ। সার্কাসের দর্শকদের হাসানোই তাঁদের কাজ। এ জন্য জোকাররা নানা রকম কৌশল অবলম্বন করে হাসির বন্যা বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এই হাসির স্রষ্টা জোকারদের মধ্যেও দুঃখ-কষ্ট রয়েছে। সম্প্রতি যশোর টাউন হল মাঠে সার্কাস অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় কথা হয় বুলবুল সার্কাসের কয়েকজন জোকারের সঙ্গে। তাঁরা তাঁদের জীবনের হাসি-কান্নার গল্প শুনিয়েছেন। বলেছেন, জোকারের বাইরের রূপের সঙ্গে ভেতরের রূপের কোনো মিল নেই। পেটে খিদে থাকলেও হাসতে হয়। জোকারদের কাঁদতেও মানা।
বগুড়ার মহাস্থানগড় এলাকার বুলবুল সার্কাসে প্রায় ১০০ লোক কাজ করেন। এর মধ্যে তিনজন হলেন জোকার। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সার্কাস অনুষ্ঠিত হয়। এই তিনজন জোকারই সার্কাস মাতিয়ে রাখেন। সার্কাসের সব খেলা ছাড়াও 'ডিগভোল' (ডিগবাজি খেলা), 'সাইভোল' (সাইকেল খেলা) খেলায় জোকাররা খুবই পারদর্শী। প্রকৃতপক্ষে নামকরা সার্কাসগুলোয় জোকার বা ক্লাউনরা হলেন 'রিং মাস্টার', তাঁরাই সার্কাসের দলনেতা। জোকার সাইদুর রহমান বামন, প্রতিবন্ধী। তাঁর বাড়ি রাজশাহী। তিনি কয়েক বছর ধরে রং মেখে সং সেজে সার্কাসের জোকার হয়ে মানুষের মুখে হাসি ফোটাচ্ছেন। সাইদুর রহমান বললেন, 'আমি পঙ্গু মানুষ। কোনো শক্ত কাজ করতে পারি না। আল্লাহ আমাকে পঙ্গু করেছেন বলে অনেকেই খারাপ কথা বলেন। টিটকারি করেন। সার্কাস আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সংসারে ছয়-সাতজন লোক। সার্কাস না থাকলে না খেয়ে মরতে হতো। কিন্তু আমাদের মনের জ্বালা-যন্ত্রণার খবর কেউ নেয় না।' জোকার মোসলেম আলীর বাড়ি দিনাজপুর। ১০ বছর ধরে তিনি জোকার জীবনকেই বেছে নিয়েছেন। মোসলেম বললেন, '১০ বছর বয়সে বাবা মারা যান। বড় ভাই আমাকে মানুষ করেছেন। কিন্তু ভাবি আমাকে দেখতে পারতেন না। তিনি অনেক জ্বালা-যন্ত্রণা দিয়েছেন। এ জন্য একপর্যায়ে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হই। যোগ দিই সার্কাসের দলে। পাঁচ বছর সার্কাস দলে থাকার পর একদিন জোকারের অনুপস্থিতিতে পরিচালক আমার মুখে চুনকালি মাখিয়ে জোকার বানিয়ে মাঠে নামান। এর পর থেকেই আমি জোকার। আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে এখন মানুষের মুখে হাসি ফোটাচ্ছি। আমি চাই সবাই যেন আনন্দে থাকে। সব সময়ই হাসতে পারে।' সার্কাস দলের ম্যানেজার মোহাম্মদ জসিম বললেন, 'জোকাররা দিন হিসাবে টাকা পায়। যেদিন শো অনুষ্ঠিত হয়, সেদিন তারা ৪০০-৫০০ টাকা পায়। তবে এখন সার্কাসের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেছে। এ কারণে খুব কম দর্শক হয়। তাতে দল টিকিয়ে রাখাই মুশকিল।' তিনি আরো জানান, জোকাররা সার্কাসের সব খেলাই পারেন। তাঁরা দর্শকদের হাসিয়ে বাহবা কুড়ান। তবে এটা ঠিক, তাঁদের জীবনেও দুঃখ-কষ্ট রয়েছে, কিন্তু নিজেদের জীবনের দুঃখ-কষ্ট দূর করতে পারেন না।
ফখরে আলম

No comments

Powered by Blogger.