'জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা' by গওহার নঈম ওয়ারা

সুশাসন, ন্যায্যতা আর ন্যায়ের কথা বলে ক্ষমতায় এসেই প্রথমেই 'কচু কাটা' করার জিদের বলি হন সুনীল। তিনি তো সেই কবি_ যেমন নবনীতা দেব সেন বলেছেন, 'ভালো কবিরা আমাদের মনের কথাগুলো আমাদের চেয়ে অনেক ভালো করে বলতে পারেন, যেমন বলে গিয়েছেন সুনীল।' সেই সুনীলকে ধাক্কা দিতে পা কাঁপেনি, মায়া হয়নি মমতার।


বরং সুনীলকে নিয়ে মিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের এলার্জির কোনো রাখঢাক ছিল না। শিশু-কিশোরদের নানা জনপ্রিয় চরিত্র সৃষ্টির অনুপম স্রষ্টা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শিশু-কিশোর একাডেমির সভাপতির পদটা খুবই দৃষ্টিকটুভাবে কেড়ে নেওয়া হয়। বসানো হয় মমতা ক্যাডারের অন্যতম ভারবাহী অর্পিতা ঘোষকে। এ যে কতবড় অপমান! 'বিষ পান করে মরে যাবো' বলা কবিকে নীলকণ্ঠ হয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য করার মতো অপমান।
সুনীলকে নীলকণ্ঠ করার কাজ ক্ষমতাময়ী মমতা চালিয়ে যান অবলীলায় কোনো রকম বিরাম বা যতিচিহ্ন ছাড়াই। রাজ্যের বহু শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতাকে নতুন চালু 'বঙ্গবিভূষণ' সম্মান দেওয়া হলেও সুনীলকে চোখে পড়েনি ক্ষমতার লাল চোখ মমতা কোম্পানির। সবচেয়ে নোংরামি হয় যখন তসলিমা নাসরিন 'শালীনতা লঙ্ঘনের' পুরনো কাসুন্দিটা আবার রোদে দেন বৈয়াম খুলে। তখন তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ একাধিক মিডিয়া যেভাবে তা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করেছে তাতে 'ওপরের নির্দেশের' ছবিটা আর অস্পষ্ট থাকেনি। তাতে যে সুনীলের ক্ষতি বৃদ্ধি হয়নি তা বলাবাহুল্য। বরং যারা তাকে নর্দমায় নামাতে কাদায় নেমেছিলেন তারা খিঁচে পড়ে গেছেন। অজস্র অভিযোগ সুনীল গায়ে মাখেননি। 'জবাব-উত্তর' করেননি সেসব নীচতার। পরে অবশ্য মমতা সুনীলের সর্বশেষ জন্মদিনে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এতে বোধহয় আরও বেশি অপমানিত বোধ করেছিলেন খারাপ লেগেছিল তার। না হলে সৌজন্যতার শিরোমণি সুনীল সে শুভেচ্ছা বার্তার প্রাপ্তি স্বীকার করে ধন্যবাদ জানাতে অপারগ হবেন কেন? কথা বলতে বলতে লাইন কেটে গেলে যে কবি নিজে থেকে ফোন করে বলতেন, 'কথাটা সুন্দর করে শেষ না হওয়ায় আবার কল দিলাম_ ভালো থেকো।' সে মানুষ দিল কতটা পিষে দিলে_ মমতার চিঠির মধ্যে মমত্বের ঘনত্ব খুঁজে পান না, তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
লেখাটি এখানে শেষ করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু বাঙালিদের যে এখনও মানুষ হওয়া বাকি, তার প্রমাণ বাকি থেকে যায়। সুনীলের লাশের শেষকৃত্য নিয়ে নিঃশব্দ ঘোষণা দেওয়া হলো_ এ লাশ আমাদের। আমরা সাজাব, আমরা চালাব, আমরা পোড়াব। তৃণমূলের দুশ্চিন্তা ছিল এ শোকের মিছিলে কমিউনিস্টরা নেতৃত্ব দিতে পারে। তারা মানুষের কাছে সুনীল অবহেলার কাহিনী তুলে ধরতে পারে। অতএব লাশ দখল করো! সুনীলের লাশ শেষ পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্য নজরের আড়াল হতে দেয়নি তৃণমূলীরা।
১৯৭৪ সালের ১৯ মার্চ বুদ্ধদেব বসু যেদিন চলে যান সেদিন তার শব ঘাড়ে করে তরুণ কবিরা শ্মশান পর্যন্ত ধীর পায়ে চলেছিলেন। সেদিন সুনীল ছিলেন সবার আগে। আনন্দবাজারে সুনীল সেদিন লিখেছিলেন_ 'কবি, লেখক, কৃত্তিবাস যুগের প্রাণপুরুষ? কী লেখা যায় তাকে? কলমটা ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছা হয়।' তখনকার কবি-লেখকদের বুদ্ধদেবের সন্তান বলে বর্ণনা করেছিলেন সুনীল। আজ কি কেউ সুনীলের উত্তরাধিকার অস্বীকার করতে পারবে? সেদিনের মিছিলটা কি খুব বড় ছিল? সুনীলের মিছিলের তুলনায় নিতান্তই কৃশকায় ছিল সে মিছিল দৈর্ঘ্য-প্রস্থে। তবে সবকিছু তো আর দৈর্ঘ্য-প্রস্থে মাপা যায় না! যায় কি? সেদিন কবিরা খুব তৃপ্তি পেয়েছিলেন একজন অগ্রজের শেষ কাজে মনের মতো করে শামিল হতে পেরে। এবার সেটা হলো না। রাজনীতি সেটা হতে দিল না। সুনীল চলেন শববাহী শকটে আনন্দবাজার পত্রিকার দফতর থেকে রবীন্দ্রসদনে, সাহিত্য একাডেমি হয়ে কেওড়াতলা। রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে আর সুনীলের কবিতা বলতে বলতে এগিয়েছে শোক মিছিল। সুনীলের মরদেহকে ঘিরে ভিড়ের ঠেলাঠেলি মনে করিয়ে দেয় সুনীলের বর্ণনা তার 'কবির মৃত্যু'তে বধ্যভূমির ভিড় যেন। সুনীলের মরদেহ ঢুকে যায় চুলি্লতে; কিন্তু ভুল রাজনীতির পাওনা চুকে না। মরদেহ নিবেদিত রজনীগন্ধার অবশিষ্ট হাতে নিয়ে ঘোরে ভক্তরা। রেখে দেবে বইয়ের ভাঁজে, মনের কুঠরিতে। সে ফুল শুকাবে না।

গওহার নঈম ওয়ারা
কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.