সাইবার অপরাধের জালে জড়ানো হচ্ছে কিশোরীদের

সাইবার অপরাধের জালে জড়ানো হচ্ছে কিশোরীদের। বন্ধুত্বের ফাঁদে ফেলে যৌন নির্যাতন ও তার ভিডিওচিত্র ধারণ করে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে ইন্টারনেটে। বিভিন্ন দোকান থেকে তা লোড করা হচ্ছে মোবাইল ফোনে। আর এভাবেই ফাঁসানো হচ্ছে কিশোরী ও নারীদের।

সরলতার সুযোগে কিশোরী মেয়েদের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ ও নির্যাতন করে তার ভিডিও চিত্র ধারণ করে অর্থ আদায়ের পথও বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা।
আবার অনেকে ‘প্রেম প্রত্যাখ্যাত’ হয়ে বা সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পর সামাজিকভাবে হেয় করতে মেয়েদের বিকৃত ছবি ছড়িয়ে দিচ্ছে ফেসবুকে।

৫ দিনের ব্যবধানে এমন অভিযোগে দুটি মামলা হয়েছে সিলেটের দুটি থানায়। গ্রেফতার করা হয়েছে চারজনকে। জব্দ করা হয়েছে কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ও অশ্লীল দৃশ্য সম্বলিত ম্যামোরি কার্ড।

এমন ঘটনায় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে সিলেটের সেইসব মা-বাবাদের- যাদের ঘরে রয়েছে কিশোরী মেয়ে। উদ্বিগ্ন তাদের আত্মীয়-স্বজনরাও। কখন কার মেয়ে ফাঁদে পড়ে এই জালে আটকে যায় এই উৎকণ্ঠাই এখন সকলের মনে।

সাশ্রয়ী দাম ও সহজলভ্য হওয়া ভিডিওচিত্র ধারণ ক্ষমতা সম্বলিত মোবাইল ফোন এখন প্রায় প্রত্যেকের হাতে হাতে। অনেকে শখের দৃশ্যগুলো ধারণ করে রাখার জন্য এসব ফোন ব্যবহার করেন।

ইন্টারনেটে, সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে এগুলো শেয়ার করেন। এর মাধ্যমে বিনোদন প্রেমিরা নির্মল আনন্দ ভাগাভাগির স্বাদ নেন। কিন্তু অপরাধীরা এর মাধ্যমে করে কিশোরী মেয়েদের স্বর্বনাশ।

ফাঁদে ফেলে বা জোর করে তাদের সাথে বিশেষ দৃশ্য ধারণ করে ছেড়ে দিচ্ছে ইন্টারনেটে। আর মুহূর্তে লাখ লাখ চোখ উপুড় হয়ে পড়ছে সেখানে। যে মেয়েটির এমন স্বর্বনাশ ঘটেছে সমাজে তার বেচে থাকা কঠিন হয়ে উঠলে একশ্রেণীর লোকেরা তা থেকে ‘বিনোদন’ পাচ্ছে।

মুখোরুচক আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছে ধারণকৃত দৃশ্যগুলো। নিষিদ্ধ এইসব ভিডিও ক্লিপ ও দৃশ্যের ‘ব্যাপক’ চাহিদা থাকায় এসব তৈরির ‘কারিগরের’ সংখ্যা উদ্বেগজনভাবে বাড়ছে। বন্ধুত্বের ফাঁদে ফেলে অনেকে জোরপূর্বক কিশোরীর সাথে অশ্লীল দৃশ্য মোবাইলের ধারণ করে তা ইন্টারনেট ও ফেসবুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

‘মোবাইলে গান ডাউনলোড’ এর দোকানগুলোও এসব দৃশ্য প্রচার ও বিক্রি সাথে সরাসরি জড়িত রয়েছে। তারা অর্থ উপার্জনের ধান্ধায় এসব ভিডিও ক্লিপ অপরাধীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে চড়া মূল্যে বিক্রি করছে। অনেকে আবার এসব ভিডিওচিত্র দিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছে। প্রায়ই এমন ঘটনা এখন ঘটছে। কিন্তু লোকলজ্জার কারণে এসব অনেকেই এড়িয়ে যান।

এমন অভিযোগে গত ২৪ অক্টোবর এসএমপির শাহপরান থানায় ৮ বখাটের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন কলেজপড়ুয়া এক কিশোরী। দক্ষিণ সুরমার কুশিঘাট, পালপুর গ্রামে বসবাসকারী গোলাপগঞ্জ উপজেলার বরায়া, রফিপুর গ্রামের ওই কিশোরী তার বন্ধবীর মাধ্যমে একটি বাসায় গিয়ে ধর্ষণের শিকার হন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দক্ষিণ সুরমার পালপুর গ্রামের বাবুল মিয়ার মেয়ে উর্মি নগরীর উপশহর এলাকার অজ্ঞাত একটি বাসায় নিয়ে যায়।

সেখানে সিলেটের শাহপরান থানায় এ ঘটনায় ভোক্তভূগি ঐ ছাত্রী ৫ জনের নাম উল্লেখ সহ অজ্ঞাতনামা আরো ৩/৪ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেছে। মামলা নং- ১৬, তারিখ- ২৪/১০/১২ইং, ধারা- নাঃ শিঃ নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী) ২০০৩ এর ৯(১)৩০ এবং সিনেমাটোগ্রাফ আইন এর ৮ (১) (২) (৩) (৭) আসামীদের বিরুদ্ধে ধর্ষন, ধর্ষনে সহায়তা, পর্নোগ্রাফী ধারণে বাধ্য করা, সামাজিক মর্যাদা হানির ভয় দেখিয়ে টাকা দাবী, ইন্টারনেট ও মোবাইলে দেওয়া এবং সমস্ত অপরাধে সহ্য়াতা করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

থানায় মামলা দায়েরের পর শাহরান থানার এসআই ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদের নেতৃত্বে ও দক্ষিণ সুরমা পুলিশ ফাঁড়ীর ইনচার্জ এসআই সৈয়দ ইমরোজ তারেকের সহায়তায় গত বুধবার সন্ধ্যায় কদমতলী পয়েন্ট থেকে কম্পিউটারসহ সুলতান নামের এক ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়।

এছাড়া পুলিশ ঐ রাতেই উর্মিকে (১৭) গ্রেফতার করেছে।

উর্মির দেওয়া তথ্যমতে পুলিশ দক্ষিণ সুরমা ও সিলেট নগরীর বিভিন্ন স্থানে অন্যান্য আসামীদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছে। আসামীরা হচ্ছে দক্ষিণ সুরমা উপজেলার জৈনপুর গ্রামের শানুর মেম্বারের ছেলে লিমন, শিববাড়ী এলাকার কয়েছ, পালপুর কুশিঘাট গ্রামের রাব্বি, মাছিমপুরের মৃত চান মিয়ার ছেলে শাহীসহ অজ্ঞাতনামা ৩/৪ জন আসামী।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, আসামী উর্মির সাথে সে চলতি বছরে ইছরাব আলী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে। বর্তমানে ছাত্রীটি মোমিনখলার স্টার লাইট কলেজের ১ম বর্ষে অধ্যয়ণরত। উর্মির সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক হওয়ার সুবাধে গত ১১ সেপ্টেম্বর উর্মি একটি সিএনজি অটো রিকসাযোগে জন্ম দিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে তাকে নিয়ে যায় শাহজালাল উপশহরের একটি বাসায়। সেখানে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কোন আয়োজন ছিল না। বাসায় ঢুকার পর পরই আসামীরা প্রাণে মারার ভয় দেখিয়ে ঐ ছাত্রীর শরীর থেকে জোর পূর্বক বস্ত্রহরণ করে।

উর্মির সহায়তায় আসামীরা ছাত্রীর নগ্ন ভিডিওচিত্র ধারণ করে মোবাইলের ক্যামেরায়। ২নং আসামী লিমন ছাত্রীর উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। পরবর্তীতে আসামীরা ছাত্রীকে ঐ ঘটনা কাউকে না বলার জন্য হুমকি দেয়।

কাউকে ঘটনাটি বললে ভিডিও ক্লিপটি ইন্টারেটে, ফেইসবুকে ও মোবাইলে প্রকাশ করার হুমকি দেয়। পরে আসামীরা এসবের ভয় দেখিয়ে ছাত্রীর পিতার কাছে ১ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবী করে। এ ঘটনা জানাজানি হলে ছাত্রীটির মান সম্মান ক্ষুন্ন হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়ায় এবং সে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে।

পরে নিরুপায় হয়ে ছাত্রীটি থানায় মামলা দায়ের করতে বাধ্য হয়।

এ ব্যাপারে শাহপরান থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) লিয়াকত আলী জানান, আসামীদের গ্রেফতারের জন্য দক্ষিণ সুরমা, গোলাপগঞ্জ সহ তিনটি উপজেলায় এ পর্যন্ত পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। এছাড়া এ ভিডিও ক্লিপটি যেসব মোবাইলের দোকানে রয়েছে সেসব ব্যবসায়ীদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।

এদিকে, দক্ষিণ সুরমায় এক কলেজ ছাত্রীর বিকৃত ও অশ্লীল ছবি ছাড়ার অভিযোগে ছালেহ আহমদ সেলিম নামের এক যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত সোমবার রাত ৮টায় জালালপুর বাজার থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। সেলিম মোগলাবাজার থানার কাদিরপুরের লাল মিয়ার ছেলে।

পুলিশ জানায়, দক্ষিণসুরমা এলাকার এক কলেজ ছাত্রীর মুখাবয়ব একটি নগ্ন ছবির সাথে যুক্ত করে তা ফেইসবুকে আপলোড করে সেলিম ও তার সহযোগীরা। এছাড়া ওই ছাত্রীর নামে ফেইসুবক একটি ফেক (ভূয়া) আইডি খুলে প্রোফাইল পিকচারে নগ্ন ছবির সাথে ওই ছাত্রীর চেহারা জুড়ে দেয়। এ ঘটনার শিকার ছাত্রী গত ৩০ সেপ্টেম্বর মোগলাবাজার থানায় জিডি করলে অপরাধীদের ধরতে মাঠে নামে পুলিশ।

এরপর সোমবার রাত ৮টায় জালালপুর বাজারে অভিযান চালিয়ে সেলিমকে তার দোকান থেকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় সেলিমের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন সেট ও একটি কম্পিউটার জব্দ করে পুলিশ।

পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে সে অপরাধের কথা স্বীকার করে জানায়, ছাত্রীর ছবি স্থানীয় একটি স্টুডিও থেকে সে সংগ্রহ করেছে। পুলিশ তার কম্পিউটার ও মোবাইল সেট দুটি সার্চ করে কলেজ ছাত্রীর বিকৃত ছবিসহ অশ্লীল ১২টি ছবি উদ্ধার করে। গত মঙ্গলবার বখাটে সেলিমকে আদালতে হাজির করে ৫দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ।

No comments

Powered by Blogger.