নাটোরে কার-ট্রাক সংঘর্ষ, সাফ স্বর্ণজয়ী শুটার পাখী শিশুকন্যাসহ নিহত

সাফ গেমসে স্বর্ণজয়ী শুটার ফিরোজ হোসেন পাখী আর নেই (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। বুধবার সকালে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার আইড়মাড়ী ব্রিজ এলাকায় ট্রাক ও প্রাইভেটকারের সংঘর্ষে ফিরোজ হোসেন (৩৮) ও তার আড়াই বছরের মেয়ে পুষ্পিতাসহ তিনজন মারা গেছেন।

মারাত্মক আহত হয়েছেন ফিরোজ হোসেন পাখীর স্ত্রী ও সাফ গেমসে স্বর্ণপদক জয়ী শুটার লাভলী চৌধুরী আখি। তাকে পাবনা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পাবনার মহিলা কলেজ রোডের লাহিড়ীপাড়ার মরহুম বাবু মিয়ার ছেলে পাখী সাবেক জাতীয় শুটার এবং আর্মি শুটিং এসোসিয়েশনের কোচ। পুষ্পিতা পাখী ও আঁখি দম্পতির একমাত্র মেয়ে। আয়না (২০) পাখীর বাসার কাজের মেয়ে। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রের বরাত দিয়ে আমাদের নাটোর প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের আইড়মাড়ী এলাকায় পাবনা থেকে ঢাকাগামী প্রাইভেটকারটি (ঢাকা-মেট্রো-গ-২৯-২৩০১) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার বিপরীত পাশে চলে যায়। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাক (ঢাকা মেট্রো ট ১৪-৭৪৭২) প্রাইভেটকারটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দিলে আয়না ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। দুর্ঘটনায় আহতদের স্থানীয় ক্লিনিকে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক অপর দু’জনকেও মৃত ঘোষণা করেন। তারা বাড়িতে ঈদ করে ঢাকায় ফিরছিলেন। রাতেই বাদ এশা নিহতদের নামাজে জানাজা শেষে পাবনার আরিফপুর গোরস্তানে দাফন করা হয়।
১৯৭৫ সালের ৯ই অক্টোবর পাবনার গোপালপুরের লাহিড়ীপাড়ায় জন্মেছিলেন পাখী। ১৯৮৭ সালে পাবনা রাইফেল ক্লাবের হয়ে বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস শুটিং প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে পথ চলা শুরু তার।  ১৯৯০ সালে রাজশাহী ও ঢাকায় .১৭৭ এয়ার রাইফেলে স্বর্ণ জিতেন ফিরোজ হোসেন। দু’বছর বাদে আন্তঃক্লাব প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ সাফ গেমসে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে দলগত স্বর্ণপদক জয় করেন ফিরোজ হোসেন পাখী। ব্যক্তিগত ইভেন্টে পান রূপা। ১৯৯৭ দিল্লিতে দ্বিতীয় শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণ ছিনিয়ে আনেন। পরের বছর মালয়েশিয়ার লঙ্কায়ৌতে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসে ষষ্ঠ হন। ১৯৯৯ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে স্ত্রী লাভলী চৌধুরী আঁখি ৫০ মিটার রাইফেল থ্রি পজিশনে মহিলা দলগত বিভাগে স্বর্ণ জেতেন কাজী শাহানা পারভীন ও সাবরিনা সুলতানাকে সঙ্গী করে। ওই আসরে বাংলাদেশ একটিমাত্র স্বর্ণ জিতেছিল লাভলীর কাঁধে ভর করে। নেপালে পাখী পান রূপা ও ব্রোঞ্জপদক। ২০০১ সালে করাচিতে তৃতীয় সাফ শুটিংয়ে স্বর্ণ ও ব্রোঞ্জ পান এই তারকা শুটার।
শুটিংয়ে খেলোয়াড়ি জীবনকে গুডবাই জানালেও পাখী শুটিং ছাড়তে পারেননি। স্বামী ও স্ত্রী দু’জন মিলেই কোচিংয়ে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৭ সালে ফিনল্যান্ডে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির কোচেস এডুকেশন্স প্রোগ্রামে অংশ নেন। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত চাইনিজ কোচের তত্ত্বাবধানে কোর্স করেন। দক্ষিণ কোরিয়ান শুটিং একাডেমিতে প্রশিক্ষণ। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতেও কোচিং কোর্স করেছেন পাখী। মেয়েদের শুটিংয়ে আরেকটি উজ্জ্বল নাম লাভলী চৌধুরী আখি। ১৯৯৪ সালে বিমান ইন্টার ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ দিয়ে লাভলীর উত্থান। শুরু হয় সাফল্যের আলোয় পথ চলা। ঘরোয়া কিংবা আন্তর্জাতিক সব পর্যায়েই লাভলী দেখান নৈপুণ্য। হয়ে উঠেন আলোচিত। শুটিংয়ে তার বেশির ভাগ সাফল্য অবশ্য বিদেশের মাঠে পাওয়া। ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক ১৯৯৭ সালে। সেবার ভারতের দিল্লিতে সাফ শুটিংয়ে পয়েন্ট ২২ রাইফেল ইভেন্টে লাভলী পান স্বর্ণপদক। দুটো ইভেন্টেই স্বর্ণজয় করে সাড়া জাগান। ফেভারিট এই ইভেন্টে লাভলীর এ সাফল্য ঈর্ষণীয়। একাধিকবার স্বর্ণপদকজয়ী লাভলীর সেরা কৃতিত্ব ছিল ১৯৯৭ সালে কাঠমান্ডু সাফ গেমসে দেশের হয়ে স্বর্ণপদক জেতা। আখি এখনও জানেন না যে, তার স্বামী ও সন্তান নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনার পর অজ্ঞান থাকলেও পরে আখির জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞান ফেরার পর আখি বারবার স্বামী ও সন্তানের খোঁজ করছিলেন। স্বজনরা আঁখিকে জানিয়েছেন যে, ওরা  সুস্থ আছে। কোন সমস্যা নেই। স্বজনদের সান্ত্বনায়ও আখি শান্ত হচ্ছেন না। যতদিন বাঁচবেন স্বামী-সন্তানের জন্য অশান্তই থাকবে আঁখির মন। ২০০০ সালে ভালবেসে আঁখিকে জীবন সঙ্গী করেছিলেন পাখী।
শোক
সাফ গেমসে স্বর্ণজয়ী শুটার পাখী ও তার মেয়ের অকাল মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার এমপি, যুব ও ক্রীড়া সচিব নূর মোহাম্মদ, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সচিব শফিক আনোয়ার, বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের (বিওএ) সভাপতি জেনারেল আবদুল মুবীন, মহাসচিব কুতুবউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন, বাংলাদেশ শুটিং ফেডারেশন। শুটার সাইফুল আলম রিংকি, আসবাব আলী ফয়েজ, সাবরিনা সুলতানা, আসিফ হোসেন, শারমিন আক্তার, আরমিন আশা, তৃপ্তি দত্ত ও সৈয়দা সাদিয়া সুলতানা।

No comments

Powered by Blogger.