একই সূত্রে গাথা বিশ্ব ব্যাংকিং ক্রাইসিস, বিপন্ন ড. ইউনূস ও পদ্মা সেতু দুর্নীতি by শফিক রেহমান

বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক সংকট সূচনার আরো আগে ৭ আগস্ট ২০০৭-এ পশ্চিমে সূচিত হয় গ্লোবাল ফাইনানশিয়াল ক্রাইসিস, যেটা পরে ২০০৮ ফাইনানশিয়াল ক্রাইসিস নামে পরিচিত হয়। বহু ইকনমিস্টের মতে, ১৯৩০-এর দশকে বিশাল মন্দাবস্থা বা গ্রেট ডিপ্রেশনের পর ২০০৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত চলমান এই অর্থনৈতিক সংকটই সবচেয়ে কঠিন।
বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইওরোপ জুড়ে যে সংকট গত সাতটি বছর ধরে চলছে তার মূল কারণ হচ্ছে সেখানের ব্যাংকিং সিসটেমে লোভ, দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা। এই সংকটের ফলে বহু ব্যাংক ও ফাইনানশিয়াল সংস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। বিভিন্ন দেশের সরকারকে এগিয়ে আসতে হয় ব্যাংক, ইনশিওরেন্স ও অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে বাচিয়ে রাখার জন্য। সরকারগুলো এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছিল, কারণ গোটা পুজিবাদী ব্যবস্থাই বিলীন হওয়ার মুখে পড়েছিল।

৭ আগস্ট ২০০৭-এ একটি ফ্রেঞ্চ ব্যাংক যার অন্যতম হেড কোয়ার্টার্স ছিল বৃটেনে, তারা ঘোষণা করে তাদের কোনো তারল্যই আর নেই, অর্থাৎ তাদের কোনো টাকাই আর নেই। তাই তারা বাধ্য হয়ে তাদের তিনটি হেজ (Hedge) ফান্ড থেকে কাস্টমারদের টাকা তোলা বন্ধ করে দিয়েছে।


এর পরপরই বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লিকুইডিটি ক্রাইসিস বা তারল্য সংকট বা আরো সহজ ভাষায় নগদ টাকার অভাব দেখা যায়। ব্যাংক-ইনশিওরেন্স কম্পানিগুলো মুখথুবড়ে পড়ে। আমেরিকার প্রায় ৯৫% ইনশিওরেন্স ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এআইজি (AIG) যার লোগো তখন বৃটিশ ফুটবল কাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সিতে দেখা যেত, তারা প্রায় দেউলিয়া হয়ে যায়। পাশাপাশি আরো কিছু কম্পানি, যারা বাংলাদেশের হাউজ বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশনের মতো বাড়ি কেনার জন্য কাস্টমারদের দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দিত তারাও গভীর বিপদে পড়ে যায়। এর ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকার হাউজিং মার্কেটে, যেটা ২০০৬-এ সবচেয়ে ওপরে উঠেছিল, সেখানে বিশাল ধস নামে। আমেরিকার হাউজিং বাবল (Bubble) বা গৃহায়ন বুদবুদ বার্স্ট করে। নতুন ক্রেতারা আর ঋণ পাচ্ছিল না। সার্বিক মন্দাবস্থার কারণে বহু মানুষের চাকরি চলে যায়। তারা হঠাৎ বেকার হয়ে পড়ে। এর ফলে বহু পুরনো বাড়ি ক্রেতা তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারে না। আর তার ফলে তাদের সম্পত্তি নিলামে ক্রোক করা হয়।


আর্থিক মন্দাবস্থা ও অনিশ্চয়তার কারণে বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারে ধস নামতে থাকে। ফলে বহু মানুষ নিঃস্ব হয়ে যায় এবং তার ফলে গোটা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো গভীর সংকটে তলিয়ে যেতে থাকে। মানুষকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, দোকানপাট হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া, ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া, বহু কর্মচারী ছাটাই হওয়া প্রভৃতি বিভিন্ন দেশে নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে ওঠে। বিভিন্ন দেশের সরকার আশঙ্কা করে ক্ষতিগ্রস্ত ুব্ধ মানুষের সংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ার কারণে যেকোনো মুহূর্তে দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু হয়ে যেতে পারে। দোকানপাট ও ব্যাংক আক্রান্ত হতে পারে।

গর্ডন ব্রাউনের উদ্ধার ফর্মুলা
এই ভয়াবহ অবস্থা এড়ানোর জন্য পশ্চিমের সরকারগুলো সিদ্ধান্ত নেয় যথাসাধ্য সম্ভব ব্যাংক ও ইনশিওরেন্স কম্পানিগুলোর পতন ঠেকাতে হবে। স্থির হয় এই লক্ষ্যে :

এক. বিপন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাময়িকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হবে। সেখানে সরকার অর্থের জোগান দেবে। সংকট উতরে যাবার পর প্রতিষ্ঠানের মালিকানা অরিজিনাল শেয়ারহোল্ডারদেরকেই আবার ফিরিয়ে দেয়া হবে। এই স্কিমের আওতায় বৃটেনে আরবিএস (RBS) গ্রুপ বা রয়াল ব্যাংক অফ স্কটল্যান্ড গ্রুপ (যার অধীনে রয়েছে ন্যাটওয়েস্ট ব্যাংক, নর্দার্ন রক বিলন্ডিং সোসাইটি প্রভৃতি)-কে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়।

দুই. বিপন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত হতে রাজি না হলে তাদের ইনসেনটিভ বা প্রণোদনা প্যাকেজে আর্থিক সাহায্য করা হবে। এই স্কিমের আওতায় ২০০৮ ও ২০০৯-এ আমেরিকান সরকার ৭০০ বিলিয়ন ডলার ইনসেনটিভ দেয় তাদের ব্যাংক ও ইনশিওরেন্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে। শুধু তাই নয়, সেই সময়ে আমেরিকার সবচেয়ে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান জেনারেল মোটর্সসহ আরো কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকেও ইনসেনটিভ দেয় আমেরিকান সরকার।

অর্থাৎ ব্যাংক, ইনশিওরেন্স, অটোমবিল সহ ইকনমির কয়েকটি বড় সেক্টরে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেকের তখন মনে পড়ে যায় অক্টোবর ১৯৬০-এ যখন তদানীন্তন সমাজতান্ত্রিক দেশ সভিয়েট ইউনিয়নের নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে একটি ভাষণে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের নাতি-নাতনিরা ধনতান্ত্রিক দেশে নয়, সমাজতান্ত্রিক দেশে বসবাস করবে। তার মানে, ক্যাপিটালিজম ছেড়ে ইউনাইটেড স্টেটস সোসালিজম গ্রহণ করবে। ৪৮ বছর পরে ক্রুশ্চেভের সেই ফোরকাস্ট আংশিক সত্য হয়েছিল।

তিন. বিপন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান চাইলে তাদের শেয়ার বিদেশিদের কাছে বিক্রি করে তারল্য সংকট কাটাতে পারবে। এই স্কিমের আওতায় বৃটেনের প্রায় ৩২০ বছরের পুরনো বার্কলেজ (Barclays) ব্যাংক ফান্ড তোলে কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথরিটির কাছে শেয়ার বিক্রি করে। বাংলাদেশে যারা টিভিতে ইংলিশ পৃমিয়ার লীগ ফুটবল ম্যাচ দেখতে অভ্যস্ত তারা নিশ্চয়ই বার্কলেজ নামটির সঙ্গে পরিচিত।

অনেকের ধারণা, এই উদ্ধার ফর্মুলার জনক ছিলেন বৃটেনের তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন, যিনি পরে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। বলা হয়, তারই প্রেসকৃপশন গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং প্রাইম মিনিস্টার ব্লেয়ার। এসব সম্মিলিত প্ল্যান, একশন ও দূরদর্শিতার ফলে পশ্চিমের পুজিবাদী ব্যবস্থা ঝড় সামলে নিতে থাকে। আমেরিকান কংগ্রেস ২০০৯-এ পাস করে আমেরিকান রিকভারি অ্যান্ড রিইনভেস্টমেন্ট আইন। বৃটিশ সরকার শুরু করে কৃচ্ছ্রতা। তারা সরকারি খরচ কমিয়ে দেয় এবং বাড়িয়ে দেয় ট্যাক্স।

কিন্তু সেই ঝড় এখনো চলছে এবং এখনো পশ্চিমে গভীর মন্দাবস্থা চলছে। পুজিবাদী ব্যবস্থা লুপ্ত না হলেও সে তার হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পায়নি। বরং ২০১২-তে এসে আরেক দফা ঝড়ে কবলিত হয়েছে বিশেষত কয়েকটি দেশ, যেমন, গ্রেট বৃটেন, ইটালি, আয়ারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, গৃস, স্পেন ও পর্টুগাল।

ঝড়ের ধাক্কা বাংলাদেশেও
এমনকি সেই ঝড়ের ধাক্কা এখন বাংলাদেশেও এসে পড়েছে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের একটি অনিয়ম সম্প্রতি ব্যাংকিং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উন্মোচিত করেছে। বাংলাদেশে যারা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের (সংক্ষেপে স্ট্যানচার্ট) কাস্টমার তারা জানেন অতীতের চার্টার্ড ব্যাংকের প্রথম ব্রাঞ্চ খোলা হয়েছিল ১৮৫৪-তে কলকাতায়। গৃন্ডলেজ ব্যাংক এবং এএনজেড গৃন্ডলেজ ব্যাংকের একীভূত ব্যাংকই আজকের স্ট্যানচার্ট।

৮ আগস্ট ২০১২-তে বিশ্বের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যে, ইরানের সঙ্গে ব্যবসা বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেসব আইন আছে, তা লঙ্ঘন করেছে স্ট্যানচার্ট। অভিযোগ করা হয়, ২০০১ থেকে ২০১০-এর মধ্যে স্ট্যানচার্ট ইরানের ২৫০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে অবৈধ ব্যবসা করেছে এবং এ সম্পর্কে স্ট্যানচার্টের বিরুদ্ধে ফৌজদারি তদন্ত করা হবে।

আমেরিকায় এই রিপোর্ট প্রকাশের পর বৃটিশ ব্যাংক স্ট্যানচার্ট শেয়ারের দাম ২২% পড়ে যায় এবং এখন পর্যন্ত শেয়ারের দাম ৮ বিলিয়ন ডলার কমে গিয়েছে। তবে স্ট্যানচার্ট কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ইরানের সঙ্গে তাদের ব্যবসা আমেরিকান আইনের ৯৯.৯% মেনে চলেছে।

বাংলাদেশে যারা স্ট্যানচার্টের সাধারণ কাস্টমার তাদের উদ্বিগ্ন হবার কারণ নেই। কারণ পশ্চিমের অন্যান্য ব্যাংকের সাম্প্রতিক অসুবিধার মতো এটিও স্ট্যানচার্ট সামলে নিতে পারবে। তবে সম্ভবত তাদের খুব বড় পরিমাণে জরিমানা দিতে হবে।

অবৈধ কাজে জড়িত বড় সব ব্যাংক
শুধু স্ট্যানচার্টই নয়, সাম্প্রতিক কালে বিশ্বের আরো কয়েকটি বড় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অবৈধ অথবা অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

যেমন, এইচএসবিসি (HSBC) ২০০৫-২০০৬-এ ইরানের সঙ্গে ১৯.৪ বিলিয়ন ডলার অবৈধ ব্যবসা করেছে।

আইএনজি (ING) ২০০২-২০০৭-এর মধ্যে ১.৬৫ বিলিয়ন ডলার অবৈধ ব্যবসা করেছে কিউবা, ইরান, মিয়ানমার ও সুদানের সঙ্গে। এই অভিযোগে আইএনজিকে অর্থদণ্ড দিতে হয়েছে ৬১৯ মিলিয়ন ডলার।
কমার্জব্যাংক (Commerzebank) ২০০৫-এ ০.০৯ মিলিয়ন ডলার অবৈধ ব্যবসা করেছে কিউবার সঙ্গে। এই অভিযোগে কমার্জব্যাংককে অর্থদণ্ড দিতে হয়েছে ২০০০০০ ডলার।

জেপি মরগ্যান (JP Morgan) ২০০৫-২০০৬-এ কিউবা, লাইবেরিয়া, ইরান ও সুদানের সাথে ১৮১ মিলিয়ন ডলার অবৈধ ব্যবসা করেছে। জেপি মরগ্যানকে ৮৮ মিলিয়ন ডলার অর্থদণ্ড দিতে হয়।

সোসাইটি জেনারেল (Societe Generale) ২০০৬-২০০৭-এ ইরানের সাথে অবৈধ ব্যবসা করেছে ০.৩ মিলিয়ন ডলার। সোসাইটি জেনারেলকে ১১১০০০ ডলার অর্থদণ্ড দিতে হয়।

বার্কলেজ (Barclays) ১৯৯০ দশকের মধ্যে থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সুদান, ইরান, মিয়ানমার ও কিউবার সঙ্গে অজানা পরিমাণের অবৈধ ব্যবসা করেছে। বার্কলেজকে ১৭৬ মিলিয়ন ডলার অর্থদণ্ড দিতে হয়।

এবিএম আমরো (ABM AMRO) ১৯৯৫-২০০৫-এর মধ্যে অজানা পরিমাণের অবৈধ ব্যবসা করেছে কিউবার সঙ্গে। এবিএম আমরোকে ৫০০ মিলিয়ন অর্থদণ্ড দিতে হয়।

লয়েডস টিএসবি (Lloyds TSB) ২০০১ থেকে ২০০৪-এর মধ্যে ৩০০ মিলিয়ন ডলার অবৈধ ব্যবসা করেছে ইরান ও সুদানের সঙ্গে। লয়েডস টিএসবিকে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থদন্ড দিতে হয়।

ইউএসবি (USB) ১৯৯৬ থেকে ২০০৩-এর মধ্যে অজানা পরিমাণের অবৈধ ব্যবসা করেছে কিউবা, ইরান, লিবিয়া ও যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে। ইউএসবিকে ১০০ মিলিয়ন ডলার অর্থদণ্ড দিতে হয়। এসব অর্থদণ্ডের অধিকাংশই কালেকট করে আমেরিকান ট্রেজারি।

৮ আগস্ট ২০১২-তে লন্ডনের দি গার্ডিয়ান পত্রিকার ২২ ও ২৩ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ওপরের তথ্য থেকে বোঝা যায়, আমেরিকানদের মতে বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক কয়েক বছরজুড়ে অবৈধ ব্যবসায়ে জড়িত ছিল আমেরিকার কুনজরে আছে এমন কিছু দেশের সাথে। আমেরিকা তাদের এই পুলিশি একশনের যৌক্তিকতাস্বরূপ বলেছে, ওই ব্যাংকগুলোর এই ধরনের ট্রানজাকশন সন্ত্রাস, ড্রাগস, অস্ত্র চোরাচালান, মানি লন্ডারিং ও অন্যান্য কৃমিনাল কাজকে সাহায্য করেছে।

ডাবল স্ট্যান্ডার্ড
আমেরিকার এই অভিযোগ সত্য। তবে চিরকালই ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের অবৈধ ট্রানজাকশন ঘটেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের স্বৈরাচারী সরকার, রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান এবং তাদের আত্মীয়স্বজন, দুর্নীতিবাজ শিল্প ও ব্যবসাপতি, টেররিস্ট, ড্রাগস ব্যারন প্রমুখ বিলিয়ন ডলার এদিক থেকে ওদিক করেছে মালটিন্যাশনাল ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। এই মুহূর্তে পাকিস্তানের বিচার বিভাগ তদন্ত করতে চাইছে সেই দেশের প্রেসিডেন্ট আসিফ জারদারি কত ডলার সুইজারল্যান্ডে পাচার করেছেন। ২০০৭-এ আততায়ীর বোমায় নিহত তার স্ত্রী বেনজির ভুট্টোও অধুনালুপ্ত বিসিসিআই ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার পাচার করেছিলেন সুইজারল্যান্ডে এবং সুইজারল্যান্ডে বেনজিরের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্টের কপি লন্ডনের দি সানডে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বিসিসিআইকে তদানীন্তন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নিজের কাজে লাগিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। আর এখন পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতিসংক্রান্ত অভিযোগে সুইজারল্যান্ডে গ্রেফতার হয়েছেন কানাডিয়ান কম্পানির টিউনিশিয়ান বংশোদ্ভূত অফিসার রিয়াদ বিন ইসা (Riad Bin Essa)। ধারণা করা হয়, ইসা কোনো সুইস ব্যাংক ব্যবহার করেছিলেন।

এই ধরনের ট্রানজাকশনে শুধু সুইস এবং মালটিন্যাশনাল ব্যাংকগুলোই নয়, সাধারণ মানুষের অজানা কিছু ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক কয়েকটি অফশোর আইল্যান্ড (Offshore Island) থেকে কাজ করছে। অফশোর আইল্যান্ড মানে মূল দেশের বাইরে কোনো দ্বীপ। যেমন, আমেরিকার বাইরে কেইম্যানস আইল্যান্ড (Caymans Island) যেখানে বিসিসিআইয়ের অপারেশন ছিল। বৃটেনের বাইরে আইল অফ ম্যান (Isle of man) প্রভৃতি। মূল দেশের ট্যাক্স আইনের আওতার বাইরে থেকে এসব দ্বীপ সরকারের অনুমোদনেই ট্রানসাক্ট করতে পারে।

তার মানে দাড়ায়, এক দিকে আমেরিকান ও বৃটিশ সরকার যেমন, তাদের আরোপিত ফাইনানশিয়াল বিধিনিষেধ কেউ অতিক্রম করলে শাস্তি দিতে পারে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপরোক্ত অর্থদন্ডের মতো) তেমনি অন্যদিকে তাদের আরোপিত ফাইনানশিয়াল বিধিনিষেধ শিথিল করে রাখা হয়েছে অফশোর আইল্যান্ডগুলোতে। বলা যায়, এই দুই সরকার নিজেদের স্বার্থ বজায় রাখার জন্য দ্বৈত নীতি বা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করছে।

ইকনমিস্টদের আশংকা
তাই ইকনমিস্টরা এখন বলছেন, আমেরিকা ও বৃটিশ সরকারের উচিত হবে তাদের ব্যাংকিং নীতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে তার আমূল পরিবর্তন করা। নচেৎ, গোটা বিশ্বের অর্থনীতি ও ফাইনানশিয়াল মার্কেটে দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা চলতেই থাকবে এবং তার ফলে বিশ্ব মন্দাবস্থাও চলতে থাকবে। এর পরিণতিতে লুটপাট, জ্বালাও-পোড়াও, আত্মহত্যা, খুন প্রভৃতি সামাজিক অস্থিরতাও চলতে থাকবে, যা একসময় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এই অস্থিরতা এড়ানোর জন্য মাঝে মধ্যে ব্যাংকগুলোকে ইনসেনটিভ ও অর্থসাহায্য দিলেও কোনো কাজ হবে না। বরং সরকারকে প্রায়ই সাহায্য করে যেতে হবে যেটা ক্যাপিটালিজমের মুক্তবাজার অর্থনীতির পরিপন্থী।

ইওরোপে মুদ্রা সংকট
ইকনমিস্টদের এ কথা সত্য প্রমাণিত হয় জুন ২০১২-র প্রথমার্ধে। বৃটেনের চলতি মন্দাবস্থা মোকাবিলার লক্ষ্যে অন্ততপক্ষে আরো ১০০ বিলিয়ন ডলার বৃটিশ ইকনমিতে পাম্প ইন করার ঘোষণা দেন ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের গভর্নর স্যার মেরভিন কিং। বৃটিশ ব্যাংকগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে ফান্ড দিতে প্রথমটায় রাজি ছিলেন না স্যার কিং। ইকনমি চাঙ্গা করার জন্য তিনি কোয়ানটিটেটিভ ইজিং (Quantitative Easing) বা সংক্ষেপে কিউই (QE) অর্থাৎ আরো নোট ছাপানোর কর্মসূচির পক্ষে ছিলেন। কিন্তু বৃটিশ ইকনমি আরো মন্দাবস্থায় পড়ে যাওয়ার ফলে গভর্নর কিং তার ট্যাকটিকস বদলাতে বাধ্য হন।

১৪ জুন ২০১২-তে লন্ডনে সিটি এলাকায় ম্যানসন হাউজে একটি ডিনারে গভর্নর কিং বলেন, ইওরো মুদ্রা সংকট আরো গভীর হয়েছে। স্পেন সরকার সুদের হার বাড়িয়ে ৭% করেছে। গৃস, আয়ারল্যান্ড ও পর্টুগাল পরিত্রাণের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য চাইছে। ইটালিও সুদের হার বাড়িয়েছে। গৃস যদি ইওরো মুদ্রা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে গোটা ইওরোপে তাশের ঘরের মতোই ইওরো জোন ভেঙে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে বৃটিশ ইকনমিকে বাচিয়ে রাখতে হলে ২০০৮ থেকে দুরবস্থায় পতিত বৃটিশ ব্যাংকগুলোকে সাহায্য করতে হবে এবং ইতিমধ্যেই গৃহীত ৩২৫ বিলিয়ন পাউন্ড কিউই কর্মসূচির সঙ্গে আরো নতুন নোট ছাপাতে হবে।

বৃটিশ অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবোর্ন এই ডিনারে উপস্থিত ছিলেন। তিনি গভর্নর কিংয়ের সঙ্গে একমত হন। জর্জ অসবোর্ন বলেন, জুনের তৃতীয় সপ্তাহে মেক্সিকোর লস কেবস (Los Cabos)-এ জি টোয়েন্টি (G20) অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর যে সম্মেলন হবে, তাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেইগের বদলে তিনিই যোগ দেবেন।

বার্কলেজ কেলেংকারিতে বৃটেন তোলপাড়
এই ঘোষণায় অসবোর্ন বুঝিয়ে দেন ইওরো জোন উদ্ধার প্ল্যানকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে বৃটেন। কিন্তু অসবোর্ন তখন জানতেন না এই ঘোষণার ঠিক ১৫ দিন পরেই বার্কলেজ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে বিশাল দুর্নীতির সংবাদে সারা বৃটেনে তোলপাড় হয়ে যাবে, যার পরিণামে বার্কলেজ ব্যাংকের সিইও বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বব ডায়মন্ডকে রিজাইন করতে হবে।

২৯ জুন ২০১২-তে ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের গভর্নর কিং বলেন, কিছু বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে এবং বৃটিশ ব্যাংকগুলোকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বৃটিশ ব্যাংকগুলোর কালচার ও কাঠামোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত বেতন ও বোনাস নেওয়া, কাস্টমারদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, গুরুত্বপূর্ণ সুদের হার ম্যানিপুলেট করা ইত্যাদি। ব্যাংকিং সার্ভিসে যেসব সৎ ও পরিশ্রমী মানুষ আছেন তারা তাদের ব্যাংকের নেতৃস্থানীয় লোভী ব্যক্তি ও কিছু অসৎ কর্মীর কারণে অসম্মানজনক অবস্থায় পড়েছেন।

কিং জানান, ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ দিতে বার্কলেজ, এইচএসবিসি, লয়েডস টিএসবি এবং রয়াল ব্যাংক অফ স্কটল্যান্ডকে নির্দেশ দিয়েছে বৃটেনের ফাইনানশিয়াল সার্ভিসেস অথরিটি (সংক্ষেপে এফএসএ, FSA)। তিনি বলেন, বার্কলেজকে ২৯০ মিলিয়ন পাউন্ড জরিমানা করা হয়েছে। এত বড় অর্থদন্ড কোনো বৃটিশ ব্যাংককে আগে দিতে হয়নি। ২৭ জুন ২০১২-তে আরোপিত এই অর্থদন্ড দেয়া হয়, কারণ লন্ডন ইন্টারব্যাংক অফার্ড রেট (London Interbank Offered Rate) সংক্ষেপে লাইবর (Libor) ম্যানিপুলেট করেছিল বার্কলেজ।

লাইবরে কারসাজি
লাইবর হচ্ছে এক ধরনের সুদের হার, যেটা প্রভাবিত করে দেশের অন্যান্য সুদের হারকে। লন্ডনের ষোলটি ব্যাংক সম্মিলিতভাবে প্রতিদিন ঘোষণা করে পরদিন কত সুদে তারা লেনদেন করবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী তারা পাঠিয়ে দেয় বৃটিশ ব্যাংকিং এসোসিয়েশন (সংক্ষেপে বিবিএ, BBA)-কে। এরপর বিবিএ গড় সুদের হার প্রকাশ করে। সবচেয়ে বেশি নজর দেয়া হয় তিন মাস মেয়াদি লাইবর রেটের ওপর, যেটা সাধারণত ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের বেধে দেয়া স্ট্যান্ডার্ড বেইস রেটের ০.১৫% ওপরে থাকে। এই ষোলটি ব্যাংক দেশের অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে ঋণ দিতে রাজি ছিল না। তাই তখন তারা লাইবর রেট বাড়িয়ে দিয়েছিল।

ফলে দেশের হাজার হাজার ফাইনানশিয়াল প্রডাক্টের বা পণ্যের দাম বেড়ে যায়। কারণ লাইবরকেই মনে করা হয় ব্যাংক ঋণের প্রকৃত সুদের হারের প্রতীক। মধ্য ২০০৭ থেকে ২০০৮-এর শেষ পর্যন্ত লাইবরের হার স্ট্যান্ডার্ড বেইস রেটের ১%-এরও বেশি ওপরে থাকে। ফলে ব্যাংকগুলো লাভবান হলেও সাধারণ মানুষ ও ক্রেতা দুর্দশায় থাকে। যেমন, স্ট্যান্ডার্ড বেইস রেট ০.৫% হলেও বাড়ি বা ফ্যাট কিনতে গেলে প্রায় ৬% সুদে ঋণ নিতে হয় তাদের। বৃটেনে লাইবরের মতো ইওরোপে সুদের হারের ওপর প্রভাব ফেলে ইওরিবর (Euribor)।


কিছুকাল আগে বৃটেনে যখন নর্দার্ন রকসহ অন্যান্য ব্যাংক বিপদগ্রস্ত হয়, তখন বার্কলেজ নিজেদের অবস্থা ভালো দেখানোর লক্ষ্যে তাদের পৃষ্ঠপোষিত কিছু ট্রেডারকে হাত করে লাইবর রেট কমিয়ে দেয়। ফলে সেই সময়ে ঋণ দেয়ার ওপরে কড়াকড়ি থাকলেও বার্কলেজকে মনে হয় একটি সুস্থ ব্যাংক। এভাবে বার্কলেজ তখন টিকে তো থাকেই বরং অন্য ব্যাংকগুলোর তুলনায় বেশি লাভ করে। এখন বার্কলেজ ব্যাংক ধরা পড়ে যাওয়ার পর জানিয়েছে, আরো কিছু ব্যাংক একই পথ অনুসরণ করেছিল এবং এদের অন্যতম হচ্ছে সিটি ব্যাংক (বাংলাদেশেও যারা অপারেট করছে), ডয়েশ ব্যাংক ও রয়াল ব্যাংক অফ স্কটল্যান্ড। এফএসএ-র তদন্তে বার্কলেজ এসব ব্যাংকের নাম ফাস করতে বাধ্য হয়েছে।

চার বছর ব্যাপী বার্কলেজের কুকর্ম
এফএসএ (FSA) বা ফাইনানশিয়াল সার্ভিসেস অথরিটি বার্কলেজ বিষয়ে ৪০ পৃষ্ঠাব্যাপী একটি তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে। এফএসএ জানিয়েছে, ২০০৫ থেকে বার্কলেজ তার সুবিধা অনুযায়ী রেট ম্যানিপুলেট করেছে এবং এই ম্যানিপুলেশনের রীতি বন্ধ হয় ২০০৯-এ। এফএসএ বলেছে, বার্কলেজের যেসব ম্যানেজার ও কর্মকর্তা এই ম্যানিপুলেশনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তারা জানতেন যে, একটি অবৈধ কাজ তারা করছেন। কিন্তু ব্যাংকের প্রতি আনুগত্য অথবা প্রমোশন ও বোনাস প্রাপ্তির লোভ অথবা কারসাজিতে সহায়ক ভূমিকা না নিলে চাকরি থেকে তাৎক্ষণিক বিদায়ের ভয়ে তারা ষড়যন্ত্রটি গোপন রেখেছিলেন। এফএসএ আরো বলে, সুদের হার বার্কলেজ ম্যানিপুলেট করছে এমনটা জানার পরে যে তদন্তকারী টিম তারা বার্কলেজে পাঠিয়েছিল, তাদেরও ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল পথে চালিত করেছিলেন বার্কলেজের সংশ্লিষ্ট ম্যানেজাররা। ফলে দীর্ঘ চার বছর যাবৎ বার্কলেজ তার কুকর্ম চালিয়ে যেতে পারে।


এফএসএ এই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ এবং বার্কলেজকে জরিমানা করার সময়ে অনেক ই-মেইলের কপি প্রকাশ করে। এতে জানা যায়, বিভিন্ন ট্রেডার পারস্পরিকভাবে সাহায্য করে এবং সুদের হার ম্যানিপুলেট করতে থাকে। অনেক ই-মেইলে বলা হয়, এই কাজের পুরস্কারস্বরূপ তাদের খুব দামি শ্যামপেইন গিফট দেয়া হবে। এসব ই-মেইলে প্রলোভন দিয়ে লেখা হতোÑ দিস ইজ ফর ইউ, বিগ বয় (This is for you, big boy)।

বৃটেনজুড়ে অসন্তোষ ও শ্রেণিযুদ্ধ
এসব রিপোর্ট প্রকাশের পর দেশজুড়ে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। এই অসন্তোষ আরো বেড়ে যায় যখন জানা যায় গত পাচ বছরে বব ডায়মন্ড বেতন-বোনাস বাবদ প্রায় ১২৫ মিলিয়ন ডলার নিয়েছেন। মিডিয়া রিপোর্টিং ও ভোটারদের চাপে বৃটিশ পার্লামেন্টের এমপিরা বব ডায়মন্ডকে তলব করেন যেন তিনি নিজে উপস্থিত হয়ে কি ঘটেছিল তার ব্যাখ্যা দেন।

প্রথমটায় বব ডায়মন্ড রাজি হননি তার বিরুদ্ধে এবং তার ব্যাংকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ মেনে নিতে।

২৯ জুন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন একটি বিবৃতিতে ব্যাংকিং সেক্টরে আমূল সংস্কারের পক্ষে কিংয়ের আহ্বানকে সমর্থন জানান। তিনি বলেন, আমরা জানি সমস্যাগুলো কোথায় হয়েছিল এবং আমরা মোটামুটিভাবে এটাও জানি যে এখন করণীয় কি। আপনারা দেখবেন এসব সমস্যা সমাধানে সরকার ধারাবাহিকভাবে কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছে।

টোরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিরোধী লেবার পার্টির ছায়া অর্থমন্ত্রী এড বলস। তিনি স্বীকার করেন, তার দল যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন এই কেলেংকারি সূচিত হয়েছে এবং তিনি নিজেও ভুলভ্রান্তির জন্য দায়ী। এড বলস আরো বলেন, কিন্তু এখন বার্কলেজে ঔদ্ধত্যপূর্ণ দুর্নীতি আবিষ্কৃত হয়েছে যার পূর্ণ তদন্ত হওয়া দরকার।


বব ডায়মন্ড ও বার্কলেজকে শায়েস্তা করার বিষয়ে সরকারি ও বিরোধী দলগুলো একমত হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি টিভি, রেডিও এবং পত্রিকাতে দুর্দশাগ্রস্ত নিম্ন আয়ের ব্যক্তিরা এবং পচিশ লক্ষ বেকাররা প্রশ্ন তোলে বব ডায়মন্ড কেন এত মোটা বেতন ও বোনাস পাচ্ছিলেন। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠে যায় কেন জনাথন রস, গ্রেহাম নর্টন প্রমুখের মতো টিভি সুপারস্টাররা বিশাল অংকের বেতন বা ফিস পান? কেন ওয়েইন রুনি, জন টেরি প্রমুখের মতো ফুটবল সুপারস্টাররা বিশাল বেতন পান?

বলা যায় বৃটেনে এক ধরনের শ্রেণিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অতিরিক্ত বেতন ও বোনাসভোগী ধনী বনাম বেকার ও নিম্ন বেতনভোগীদের এই লড়াইয়ে বব ডায়মন্ড ও তার দুষ্কৃতিতে সহায়ক ব্যক্তিদের টাইটেল দেয়া হয় ফ্যাট ক্যাট বা মোটা বিড়াল।

ডায়মন্ডস আর নট ফরএভার
জনমত বিপক্ষে চলে যাচ্ছে দেখে কিছু সচেতন টিভি সুপারস্টার স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এখন থেকে কম বেতন নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। বব ডায়মন্ডকে সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিতে উপদেশ দিতে কিং তার প্রতিনিধিকে পাঠিয়ে দেন। ডায়মন্ডের বাড়িতে এই গোপন বৈঠকে আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু এরপরই ডায়মন্ড জানান, তিনি সাক্ষ্য দিতে সংসদীয় কমিটির সামনে উপস্থিত হবেন নাÑ বরং তিনি এখনই পদত্যাগ করছেন।

২ জুলাই ২০১২-তে বার্কলেজের চেয়ারম্যান মার্কাস অ্যাংগাস রিজাইন করেন। পরদিন বব ডায়মন্ড রিজাইন করেন। তিনি রিজাইন করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বার্কলেজের চিফ অপারেটিং অফিসার জেরি ডেল মিসিসার রিজাইন করেন।

১৯৫৬-তে জেমস বন্ড চরিত্র সৃষ্টিকারী ইংরেজ স্পাই থৃলার লেখক ইয়েন ফেমিং তার ডায়মন্ডস আর ফরএভার (Diamonds Are Forever) বা চিরকালের জন্য ডায়মন্ড বইটি প্রকাশ করেন। বার্কলেজ থেকে বব ডায়মন্ড বিতাড়িত হবার পর বৃটিশ মিডিয়াতে হেডলাইন হয় ডায়মন্ডস আর নট ফরএভার। অর্থাৎ ডায়মন্ড চিরকালের জন্য নয়।

এন্ড ডাজ নট জাস্টিফাই মিনস
এটা ঠিক যে, বার্কলেজের চেয়ারম্যান ও বোর্ডের সব ডিরেক্টর এবং সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের সদস্যরা মনে করতেন তাদের ব্যাংকের ক্রমোন্নতির জন্য বব ডায়মন্ড অপরিহার্য। ১৬৯০-এ প্রতিষ্ঠিত বার্কলেজের বর্তমানে ৫০টি দেশ জুড়ে ৪,৭৫০-এরও বেশি ব্রাঞ্চ আছে। এর মধ্যে প্রায় ১,৬০০টি বৃটেনে। বার্কলেজের স্টাফ সংখ্যা প্রায় ১৪৬,১০০। এশিয়া, আফৃকা, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ইওরোপে বার্কলেজের কাস্টমার সংখ্যা ৪ কোটি ৮০ লক্ষ। ৩১ ডিসেম্বর ২০১০-এ বার্কলেজের মোট সম্পদ ছিল ২.৩৩ টৃলিয়ন মার্কিন ডলার। বৃহৎ ব্যাংকগুলোর মধ্যে বিশ্বে বার্কলেজের অবস্থান চতুর্থ স্থানে। তার আগে রয়েছে বিএনপি পারিবা, ডয়েশ ব্যাংক ও এইচএসবিসি। বার্কলেজ দাবি করে ২৭ জুন ১৯৬৭-তে তারাই প্রথম বিশ্বে এটিএম বা ক্যাশ মেশিন চালু করেছিল লন্ডনে। আমেরিকার প্রভাবশালী টাইম ম্যাগাজিনের মতে, আমেরিকান নাগরিক বব ডায়মন্ড নিষ্ঠুর এবং অনৈতিকভাবে দায়িত্ব পালন করলেও বার্কলেজ-কে বিশ্বের চতুর্থ বড় ব্যাংকে রূপান্তরিত করার কৃতিত্ব পেতে পারেন। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, এন্ড ডাজ নট জাস্টিফাই মিনস (End does not justify means) অর্থাৎ, সুফলদায়ক পরিণতি হলেই গৃহীত পন্থাসমূহ জায়েজ বা বৈধ হয়ে যায় না।

ইকনমিস্টস, ব্যাংকার্স, ফাইনানশিয়াল এক্সপার্টস, পলিটিশিয়ান, সবাই দেশ জুড়ে তর্কযুদ্ধে নেমে পড়েন। ২৩ জুলাই ২০১২-তে টাইম ম্যাগাজিনের কভার স্টোরির শিরোনাম ছিল, বার্কলেজ ইজ জাস্ট দি বিগিনিং : হোয়াই লন্ডন বৃডস ফাইনানশিয়াল স্ক্যানডালস অ্যান্ড হোয়াই দিস ওয়ান কুড বি দি বিগেস্ট ইয়েট (Barclays is just the beginning : Why London breeds financial scandals- and why this one could be the biggest yet) অর্থাৎ, বার্কলেজ তো সবে শুরুÑ কেন লন্ডন আর্থিক কেলেংকারির জন্ম দেয় এবং কেন এটাই হতে পারে সবচেয়ে বড় কেলেংকারি।

কেলেংকারি নয়, অপরাধ
কিন্তু এটা কি শুধুই এক ধরনের কেলেংকারি ছিল?


লন্ডনের দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় (৩০.০৬.২০১২) কলামিস্ট জনাথন ফৃডল্যান্ড, দি বার্কলেজ স্ক্যানডাল ইজ নট ‘ইনঅ্যাপ্রোপৃয়েট’। ইটস এ ক্রাইম (the Barclays scandal is not 'inappropriate'. It's a crime), অর্থাৎ, বার্কলেজে কেলেংকারি শুধুই অসৎ ছিল না। এটা ছিল একটা অপরাধ শীর্ষক নিবন্ধে লেখেন, ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে সুদের হারে কারসাজি করে বিশ্ব জুড়ে ৩৫০ টৃলিয়ন ডলারের চুক্তি ও ব্যবসা প্রভাবিত করার কাজটি ব্যাংকিং নীতির সাথে ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ’ ছিল বললেই চলবে না আসলে এটা ছিল একটা অপরাধ... এই ধরনের কেলেংকারিই ২০০৮-এর গ্লোবাল ক্র্যাশ বা বৈশ্বিক মন্দাবস্থার কারণ ছিল... ব্যাংকগুলোতে আরো স্বচ্ছতা আনার জন্য ভিকার্স (Vickers) কমিটি সুপারিশ করেছে বড় ব্যাংকগুলো ভেঙে দিয়ে একাধিক ছোট ব্যাংক করতে এবং বলেছে ২০১৮ পর্যন্ত এই সুপারিশ বাস্তবায়নের সময় ব্যাংকগুলোকে দেয়া হবে... কিন্তু এই দীর্ঘ মেয়াদি প্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার... যারা কেলেংকারি করছে তাদের দ্রুত শাস্তি দেওয়ার জন্য নতুন আইন করা দরকার। এখন পর্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে পাবলিক তাদের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে কিন্তু তাদের ক্রোধ বাড়ছে। তাই বৃটেন যেসব পলিটিশিয়ান ও ব্যাংকাররা দেশ চালাচ্ছেন তাদের উচিত হবে জনগণের ধৈর্যচ্যুতির আগেই ব্যবস্থা নেওয়া।

ইটস টাইম ফর রিফর্মস টু কাম ইন ফ্রম দি কোল্ড (Its time for reforms to come in from the cold) অর্থাৎ, ‘আর অপেক্ষা না করে এখন সময় হয়েছে সংস্কার করার’ শীর্ষক নিবন্ধে (০২.০৭.২০১২) ল্যারি এলিয়ট লেখেন, ফাইনানশিয়াল সার্ভিসেস অথরিটি (এফএসএ)-র চেয়ারম্যান চাইছেন ব্যাংকগুলোর চালচলন বদলাতে হবে। সেটা করতে হলে পাচটি পদক্ষেপ নিতে হবে :

এক. ব্যাংক ইনডাস্টৃর কাঠামো বদলে দিতে হবে। ভিকার্স কমিটির সুপারিশ মোতাবেক বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে রিটেইল ব্যাংকিং ও ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিংয়ের মধ্যে একটা দেয়াল বানাতে হবে। এই দুই ধরনের ব্যাংকিং সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এবং ভিন্নভাবে পরিচালিত করতে হবে।

দুই. ব্যাংক ইনডাস্টৃ যারা চালাচ্ছেন তাদের আরো জবাবদিহিতায় বাধ্য করতে হবে।

তিন. ব্যাংকগুলোর মধ্যে আরো প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য সব নতুন ধরনের ব্যাংক সৃষ্টি করতে হবে।

চার. ব্যাংক কিভাবে তার আর্থিক পলিসি পরিচালনা করে সেদিকে নজর রাখার জন্য একটা ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক তৈরি করতে হবে এবং রয়াল ব্যাংক অফ স্কটল্যান্ডকে পুরোপুরি রাষ্ট্রায়ত্ত করতে হবে। এই দুটি ব্যাংকের মাধ্যমে অন্যান্য ব্যাংকের তার পলিসিকে প্রভাবিত করতে হবে।

পাচ. যারা অবৈধ কাজ করছে তাদের শাস্তি দিতে হবে।

জলদস্যুদের নতুন চেহারা
জনপ্রিয় নারী কলামিস্ট পলি টয়েনবি, দি বার্কলেজ ইথস ইনফেক্টস আওয়ার কালচার। পার্জ দি বোর্ড (The Barclays ethos infects our culture. Purge the board) অর্থাৎ, ‘বার্কলেজ মূল্যবোধ আমাদের সংস্কৃতিকে রোগাক্রান্ত করছে। বোর্ড অফ ডিরেক্টর্সে শুদ্ধিকরণ করুন’ শীর্ষক নিবন্ধে (০৬.০৭.২০১২) লেখেন, ডায়মন্ড ও তার সহকর্মীরা শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন কি না আমরা জানি না। সুদের হার ম্যানিপুলেট করে তারা যখন মোটা বোনাস নিচ্ছিলেন তখন তাদের কি মানসিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?

৭ জুলাই ২০১২-তে দি ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকা ফ্রন্ট পেজ লিড নিউজে জানায়, বৃটেনের গোয়েন্দা বিভাগের সিরিয়াস ফ্রড অফিস (Serious Fraud Office, সংক্ষেপে এসএফও বা SFO) স্থির করেছে দুষ্ট ব্যাংকারদের বিচার করার যে দাবি পাবলিক তুলেছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে সুদের হার বেধে দেয়ার কারসাজি সম্পর্কে ফৌজদারি তদন্ত করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে এই তদন্তের পরিণামে বৃটিশ ব্যাংকিংয়ের কিছু রাঘব বোয়ালের জেলদণ্ড হবে।

পরদিন দি অবজার্ভার পত্রিকায় বিজনেস পৃষ্ঠায় একটি সম্পাদকীয়তে বৃটিশ ব্যাংকারদের সম্পর্কে আরো কড়া মন্তব্য প্রকাশিত হয়। আওয়ার ব্যাংকার্স, ড্রাগমেকার্স অ্যান্ড আর্মস ডিলার্স আর দি মডার্ন ফেস অফ বৃটেনস পাইরেটিকাল পাস্ট (Our bankers, drugmakers and arms dealers are the modern face of Britain’s Piratical past) অর্থাৎ, ‘আমাদের ব্যাংকাররা, ড্রাগস প্রস্তুতকারীরা ও অস্ত্র ব্যবসায়ীরা হচ্ছে বৃটেনের অতীত জলদস্যুতার বর্তমান চেহারা’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে লেখা হয় :

বৃটেনের ব্যাংকাররা হচ্ছে জলদস্যু যারা তলোয়ার ঘোরাতে ভালোবাসে। এই ট্র্যাডিশন গত ৪০০ বছর ধরে চলছে। জলদস্যুতায় যে বৃটেনের একক অধিকার ছিল, তা নয়। কিন্তু মুক্ত বাণিজ্য বা ফৃ ট্রেড-এর ছদ্মবেশে আমরা সবসময়ই চুরি করতে এবং জোর করে কিছু আদায় করতে পারদর্শী ছিলাম ও আছি। সমুদ্রের বিশাল জলরাশিতে যে টেকনিক আমরা শিখেছিলাম সেটা প্রয়োগ করে বৃটেনের মার্চেন্ট শ্রেণী বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য সৃষ্টি করেছিল। আমাদের পূর্বপুরুষরা যেসব সম্পদ দেশে এনেছিলেন বলে গর্ব করতেন তাদের অধিকাংশই ছিল অন্যের কাছ থেকে দক্ষভাবে চুরি করা এবং এসব চুরির বেশির ভাগ তারা নিজের হাতে করেছিলেন। দি ইস্ট ইনডিয়া কম্পানি তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিল। তারপর একটার পর একটা বৃটিশ সরকার সেই পথ অনুসরণ করেছিল। ...স্যার ওয়াল্টার র‌্যালে থেকে শুরু করে কেউই দক্ষতা অথবা উৎপাদনশীলতা অথবা সবচেয়ে বড় জাহাজের মালিক হবার ওপর নির্ভর করেননি। তারা নির্ভর করেছিলেন তাদের যুদ্ধ ক্ষমতা দিয়ে শত্রুদের ধ্বংস করার ওপর।

বর্তমান যুগের ব্যবসাবাণিজ্যে ঠিক সেভাবেই প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে আমাদের দৃঢ় সংকল্প করতে হয় বুদ্ধি খাটিয়ে বেচে থাকতে হবে এবং সেই লক্ষ্যে যেকোনো কিছু বিক্রি করার জন্য সব রকম কূটবুদ্ধি প্রয়োগ করতে হবে। ...গ্রেট বৃটেনের সবচেয়ে বড় জেট রফতানিকারকরা হচ্ছে ফাইনানশিয়াল সার্ভিসেস, আর্মস ইনডাস্টৃ এবং ফার্মাসিউটিকাল বিজনেসগুলো। আমাদের দেশের ব্যালান্স অফ পেমেন্ট এই মুহূর্তে ভালো নয়। কিন্তু এই তিনটি সেক্টর ছাড়া অবস্থা আরো খারাপ হতে পারতো। অথচ এই তিনটি সেক্টরেরই এক পা নোংরা কাদায় আটকে আছে।

আমর্স বা সমরাস্ত্র প্রস্তুতকারকরা ইউকে-র বড় চাকরিদতাদের অন্যতম। এসব অস্ত্র যায় কোথায়? একটি গন্তব্যস্থল হলো গৃস। এই সেদিন পর্যন্ত গৃসই ছিল বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ সমরাস্ত্র আমদানিকারক। গৃস বহু বছর যাবত বৃটেন থেকে সমরাস্ত্র কিনে চলেছে এবং গৃসের মতো আর কিছু দেশও আছে যাদের কোনো যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার কোনো ক্ষমতা নেই।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে দুর্নীতিবাজ সেক্টরগুলোর লিস্টে সবচেয়ে ওপরে আছে সমরাস্ত্র ব্যবসা। সারা বিশ্বে ঘুষ ও দুর্নীতি বিষয়ে এই এনজিও মনিটর করে।

...এখন সময় এসেছে ৪০০ বছরের ইতিহাস ঝেড়ে মুছে ফেলার। সততা ও স্বচ্ছতা দিয়ে একটি দেশ চালালে সেটা হয়তো কম আকর্ষণীয় হবে। কিন্তু হুমকি এবং দুর্নীতি দিয়ে দেশ চালালে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা আসবে। সাফল্য আসবে না।

সব পলিটিকাল পার্টি তোয়াজ করে
একই দিনে দি অবজার্ভারে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে কলামিস্ট হেদার স্টুয়ার্ট লিখেছেন, বৃটেনের পার্লামেন্টের ওপর ব্যাংকিং সেক্টরের যে অতি অসাধারণ প্রভাব আছে সেটা গত ২৫ বছরজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে। সব রাজনৈতিক দলই ব্যাংকিং সেক্টরকে তোয়াজ করে চলেছে এবং এর সূচনা হয়েছিল ২০০৮-এর ফাইনানশিয়াল ক্রাইসিসের আগেই। ...কৃত্রিমভাবে পাউন্ডের দাম বেশি করে রাখায় আমেরিকা ও অন্যান্য দেশ থেকে বহু বিলিয়ন ডলার এসেছে বৃটেনে। তার ফলে বৃটেনের ইনডাস্টৃয়াল সেক্টরের ক্ষতি হয়েছে। ইউনিভার্সিটির মেধাবী ছাত্ররা এবং বিভিন্ন কম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের স্টাফরা বেশি বেতন বোনাসের লোভে দলে দলে চলে গিয়েছে ব্যাংকিং সেক্টরে।

...এখন পাবলিক চায় ব্যাংকিং সেক্টরের রীতিনীতি, কাঠামো এবং দেশের ইকনমির ওপর তার প্রতিক্রিয়া বিষয়ে শুধু ও স্বাধীনভাবে তদন্ত হোকÑ কারণ পাবলিক জানে আমাদের সবার মতোই সকল দলের পলিটিশিয়ানদের বোকা বানিয়েছে ব্যাংকার্সরা।

১৬৯০-এ লন্ডনে বার্কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুজন স্বর্ণকার, জন ফৃম ও টমাস গুল্ড। ৪০ বছর পরে ১৭৩৬-এ জন ফৃমের জামাই জেমস বার্কলে শ্বশুরের ব্যবসায়ে যোগ দেন। পরবর্তীকালে জেমস বার্কলের নামেই বার্কলের ব্যাংকিং ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত হয়।

বার্কলেজের প্রধান চারটি ফাইনালশিয়াল প্রডাক্ট আছে: রিটেইল ব্যাংকিং, কমার্শিয়াল ব্যাংকিং, ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং ও ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট। ১৯৯৬-এ বব ডায়মন্ড বার্কলেজে যোগ দেওয়ার পরে বার্কলেজ ক্যাপিটাল (Barclays Capital), সংক্ষেপে বারক্যাপ (BarCap) শাখা সৃষ্টি করেন। সাধারণ কাস্টমারের সঙ্গে টাকার লেনদেন এবং সাধারণ বিজনেসের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার পাশাপাশি বারক্যাপের মাধ্যমে বার্কলেজ পুজি বিনিয়োগকারী শাখা গড়ে তোলেন বব ডায়মন্ড। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে পুজি বিনিয়োগ ছিল খুব ঝুকিপূর্ণ। তবে যেহেতু ব্যাংকের মূল বিজনেস, রিটেইল ব্যাংকিংয়ে, আমানতকারীদের টাকা ফেরত পাওয়ার গ্যারান্টি দেয় সরকার সেহেতু ওই নিরাপত্তার ওপর ভর করে বার্কলেজ এগিয়ে যেতে পারে তার দ্বিতীয় শাখা, বারক্যাপের প্রসারে। ডায়মন্ড তার সাফল্য দেখান এখানে।

কম্পানির পৃ-ট্যাক্স ইনকামের অর্ধেকেরও বেশি আসে বারক্যাপ থেকে। ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে দি সেন্টার ফর সোসিও কালচারাল রিসার্চ, (The Centre for Socio-Cultural Research সংক্ষেপে (Cresc বা ক্রেসক) বার্কলেজ গ্রুপের সব একাউন্টস প্রফিট অ্যান্ড লস একাউন্ট ও ব্যালান্সশিট) পুংখানুপুংখ রূপে পরীক্ষা করে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যার টাইটেল হচ্ছে দি ম্যাডনেস অফ বার্কলেজ (The Madness of Barclays) অর্থাৎ ‘বার্কলেজের পাগলামি’। এই রিপোর্টে ক্রেসক রায় দিয়েছে, ডায়মন্ড তার ১৫ বছরের কর্তৃত্বে বারক্যাপের মাধ্যমে বার্কলেজকে খুব বড় করেছেন সেটা সত্য। কিন্তু এটা এতই ঝুকিপূর্ণ এবং বিশাল যে শুধু বার্কলেজই নয়Ñ এর ফলে গোটা দেশই হঠাৎ ডুবে যেতে পারে। বার্কলেজ ১.৮ টৃলিয়ন পাউন্ড গ্রোস ক্রেডিট রিস্ক বহন করছে এবং এর পরিমাণ গ্রেট বৃটেনের পুরো বার্ষিক ইনকামের চাইতে বেশি। তারা বলছে যদিও ঝুকি কমানোর জন্য বার্কলেজ কিছু ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছে কিন্তু তাতে ঝুকি থেকেই গেছে, কারণ ইউকেসহ গোটা ইওরোপেই মন্দাবস্থা চলছে। ক্রেসকের মতে, এই অবস্থায় ঝুকিবিহীন শেয়ার ব্যবসা অসম্ভব।

সন্ধিক্ষণে বৃটিশ ব্যাংকিং
বার্কলেজ ও অন্যান্য বৃটিশ ব্যাংক তাদের অবৈধ কর্মপদ্ধতি গোপন রাখার জন্য দুটি পথ অনুসরণ করছিল।

এক. তারা তদবিরকারীদের নিয়োগ করেছিল যাদের বলা হয় লবিইস্ট (Lobbyist)। এদের কাজ ছিল মন্ত্রী, এমপি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড)সহ অন্যান্য সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তদবির করা বা লবি (Lobby) করা। শুধু গত বছরেই লবিইস্টদের পেছনে ব্যাংকগুলো ৯২ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করেছিল।

দুই. বৃটেনের সবচেয়ে বড় চারটি একাউন্টেন্সি ফার্ম, ডেলএট, আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়াং, কেপিএমজি ও প্রাইসওয়াটারহাউজ কুপার্স (সংক্ষেপে পিডাবলিউসি)কে বিভিন্ন ‘ডোনেশন’ ও কনসালটেন্সি কাজ দিয়েছিল।
এই দ্বিমুখী তৎপরতার ফলে ব্যাংকগুলো নিজেদের অনৈতিকতা গোপন রাখার পাশাপাশি বশীভূত সরকার দ্বারা বিভিন্ন ট্যাক্সের হার কম রাখতে পেরেছিল। এমনকি স্টক এক্সচেঞ্জে কোটেড কম্পানিগুলোর ওপর একটি নতুন কর্পরেট সুপার ওয়াচডগ-এর যে প্ল্যান সরকার করেছিল সেটাও বাতিল করাতে পেরেছিল বৃটিশ ব্যাংকগুলো।

গ্রেট বৃটেনের ব্যাংকিং সিসটেম এখন একটা সন্ধিক্ষণে আছে। ক্রেসকের মতো রিসার্চ প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ইকনমিস্ট, ফাইনানশিয়াল ও পলিটিকাল কলামিস্ট এবং সরকার ও বিরোধী, উভয় পক্ষের পলিটিশিয়ানরা এখন উপায় খুজছেন কিভাবে বৃটিশ ব্যাংকিং ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা যায়। একজন সাবেক ব্যাংকার ম্যাট রিডলি প্রশ্ন তুলেছেন ডারউইন বেচে থাকলে কিভাবে বৃটিশ ব্যাংকের বিবর্তন সাধন করতেন। কিভাবে?

১২ আগস্ট ২০১২

ঘোষণা
[এই রচনাটির এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে কালকের লেখায়> এক  দুই  এবং ধীরে ধীরে জানা যাবে পশ্চিমের এই ব্যাংকিং ক্রাইসিসের সঙ্গে বাংলাদেশের বিপন্ন গ্রামীণ ব্যাংকের এবং পদ্মা সেতু দুর্নীতির সম্পর্ক কী?]



শফিক রেহমান: প্রখ্যাত সাংবাদিক ও টিভি অ্যাংকর

No comments

Powered by Blogger.