আমার অগ্রজ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ by সৈয়দ হাসমত জালাল

বড় ভাই যে এমন হঠাৎ করে চলে যাবেন, আমরা কেউ ভাবিনি। মাত্র পাঁচদিন আগেও তাঁর সৃষ্ট অত্যন্ত জনপ্রিয় চরিত্র কর্নেলকে নিয়ে গল্পের 'ডিকটেশন' দিয়েছেন পুজো সংখ্যার জন্য। তারপরই আকস্মিক পেটের যন্ত্রণার কারণে ৩০ আগস্ট মাঝরাতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।


মেডিকেল বোর্ড গঠন করে অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে তাঁর চিকিৎসা শুরু করেন চিকিৎসকরা। পরীক্ষায় দেখা যায়, তাঁর অন্ত্রে একটি বেড়ে ওঠা টিউমারের জন্যই এই যন্ত্রণা। টিউমারটিকে দ্রুত অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকরা। কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত অস্ত্রোপচার করার সুযোগ পাওয়া গেল না।
বয়সের কারণেই বড় ভাই ছিলেন আমাদের ৭ ভাইয়ের কাছে অভিভাবক। কিন্তু বন্ধুর মতো সহজে মিশতেন আমাদের সঙ্গে। বড় ভাই ছিলেন বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহী বিদগ্ধ পণ্ডিত। পারিবারিক সূত্রেই বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার অদম্য উৎসাহ দেখা গিয়েছিল তাঁর ছাত্রাবস্থা থেকেই। বড় ভাইয়ের লেখা শুরু হয়েছিল কবিতার মধ্য দিয়ে। লিখেছেন অনেক দিন। গদ্য লেখায় আসেন পঞ্চাশ দশকের শেষার্ধে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সাহিত্য রচনায় সুখ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এ পর্যন্ত তাঁর গল্প-উপন্যাস ও প্রবন্ধের বইয়ের সংখ্যা দুইশ'রও বেশি। বড় ভাই ছিলেন সব বয়সী পাঠকের প্রিয়। তার সৃষ্ট রহস্যকাহিনীর নায়ক প্রকৃতি বিজ্ঞানী কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ছোট-বড় সবার কাছেই অত্যন্ত প্রিয়।
যে কালে বড় ভাই সাহিত্যিক হিসেবে সারা ভারতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, সে সময়ে প্রতিষ্ঠা তত সহজ ছিল না। অসাধারণ প্রতিভা আর সাধনায় তিনি নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন। সাহিত্যে এসেছিলাম তাঁরই প্রেরণায়। তাঁর 'মায়ামৃদঙ্গ', 'জানমারি', 'স্বর্ণচাঁপার উপাখ্যান', 'নিলয় না জানি', 'তৃণভূমি' এসব উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে এক একটি মাইলস্টোন। তাঁর 'গোঘ্ন', 'উড়োচিঠি', 'সূর্যমুখী', 'মাটি', 'ইন্তিপিসি ও ঘাটবাবু', 'রানীঘাটের বৃত্তান্ত', 'মৃত্যুর ঘোড়া' ছোট গল্পগুলো প্রায় কিংবদন্তির পর্যায়ে পেঁৗছে গেছে। বড় ভাই ছিলেন আমাদের পরিবারের বাতিঘর। আমাদের গর্ব।
প্রথম যৌবনে বড় ভাই রাঢ়ের লোকনাট্য 'আলকাপ'-এর সঙ্গে যুক্ত থাকাকালে 'সিরাজ মাস্টার' হিসেবে গ্রামগঞ্জে খ্যাতি লাভ করেন। প্রবল জনপ্রিয় হয়েই তিনি মিশেছেন মানুষের সঙ্গে। গ্রামগঞ্জ, প্রকৃতি ও সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে প্রত্যক্ষ করেছেন অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। রাঢ় বাংলার দুর্ধর্ষ হিংস্র মানুষদের যেমন তিনি দেখেছেন, তেমনি উপলব্ধি করেছেন দুর্গম প্রকৃতির আদিমতাকে, তার সৌন্দর্য ও কঠিন ঔদাসীন্যকেও। প্রাণী ও উদ্ভিদ, পোকামাকড় ও মাটির ফাটল, উইঢিবি, শ্যাওলা, সাপের খোলসে ভরা সেই আদিম মাটির কাছাকাছি থাকতে থাকতে তিনি উপলব্ধি করেন_ 'সে এক পৃথিবী আছে, দুর্গম রহস্যময়_ যেখানে রক্ত ও অশ্রুর পৃথক মূল্য নেই। সেখানেই আছে খাঁটি স্বাধীনতা।' বস্তুত জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার উপাদানকে বড় ভাই তুলে এনেছিলেন তাঁর সাহিত্যে। তাই ইতিহাসের মানুষই ছিল তাঁর রচনার উপাদান। আমি নিজে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। সহোদর নয়, একজন পাঠক হিসেবে বলি, এই প্রকৃতির মায়াবী চরাচরে, জীবন ও মৃত্যুর প্রান্তরে বিচরণশীল মানুষের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা, হিংসা-বিষাদ, নৈরাজ্য-দ্বন্দ্বকে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ শিল্পীত নৈপুণ্যে, সার্থক শিল্পীর নির্মোহে যেভাবে চিত্রায়িত করেছেন, তা শুধু বাংলা সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করেনি, সহজেই পেঁৗছে গিয়েছে আন্তর্জাতিক সাহিত্যের স্তরে।
তিনি গদ্যের সঙ্গে কবিতা, দর্শন ও প্রকৃতিকে মিলিয়ে লিখেছেন। তাঁর ভাষায় : জীবন ও মৃত্যুর সব রহস্যের উৎস প্রকৃতি_ অথচ জীবনের জন্য যেন তাঁর কোনো করুণা নেই, মৃত্যুর জন্য নেই কোনো শোক। তাঁর কাছে মানুষ কী অসহায়! সে নিজে দ্বন্দ্বহীনা_ অথচ মানুষের সব দ্বন্দ্বের কারণ সে। কী অদ্ভুত! পাণ্ডিত্য, দার্শনিকতা এবং সর্বোপরি এক মানবিকতার বোধ অত্যন্ত সাবলীলভাবে মিশে গিয়েছে তাঁর সাহিত্যে। এমন একজন সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনাবসান বাঙালির সমাজ ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে কী অপূরণীয় ক্ষতি তা প্রকাশ করাও কঠিন। সম্প্রতি সাহিত্য আকাদেমি থেকে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে নিয়ে নির্মিত একটি তথ্যচিত্রে সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, 'আমরা থাকব না, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে সিরাজ চিরকাল থেকে যাবে।'
ইদানীং যখনই তাঁর বাড়িতে যেতাম, ঘরোয়া পারিবারিক কথা বলতে বলতে বড় ভাই সম্পূর্ণ ভুলে যেতেন যে, আমি তাঁর অনুজ, বরং তাঁর মতো একজন পণ্ডিত মনে করে গুরুগম্ভীর আলোচনায় ডুবে যেতেন। আমি যে সাধারণ একজন, সেটা মনেই করতেন না অথবা ভুলেই যেতেন। রাত বাড়তে থাকত। ভাবি তাড়া দিতেন, 'ওকে অনেক দূরে যেতে হবে।' তারপর আলোচনায় ইতি টানতেন। অথচ আজ আমাকে একা রেখে তিনিই চিরতরে অনেক দূরে চলে গেলেন।

সৈয়দ হাসমত জালাল : পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.