গণতন্ত্রের মুফতি ও বিব্রত শিক্ষামন্ত্রী by আ. ন. ম এহছানুল হক মিলন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি প্রফেসর ড. এনামুল কবির অপসারণের জন্যে উত্তাল আন্দোলনে মত্ত ছিল ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীবৃন্দ। একাধিক বৈঠক করে খোদ প্রধানমন্ত্রী আপাতত সুরাহা করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আনোয়ার হোসেনকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়তে ভিসি হিসাবে পদায়ন করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়র শুরুতেই শিক্ষকদের একান্ত দাবি ছিল আপন প্রতিষ্ঠান  থেকে ভিসি নির্বাচিত করা।

খেয়া নৌকায় পাড়ি দেয়ার জন্যে নতুন ভিসি গণতন্ত্রের বুলি আওড়িয়ে ভিসি নির্বাচনের কথা বলে শান্ত করলেন বিশ্ববিদ্যালয়কে। পরাস্ত শিক্ষকগণ আশ্বস্ত হলেন, একানব্বই সদস্যবিশিষ্ট সিনেট সদস্য নিয়ে ভিসি নির্বাচনী যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবেন বলে।

বাধ ঠেকলো ৭৩’র অধ্যাদেশের ১১(১) ধারা অনুযায়ী দুই যুগ ধরে অনির্বাচিত জাকসুর পাঁচ অনুপস্থিত সিনেট সদস্য নিয়ে । এখানেই শেষ নয়, নির্বাচিত নিবন্ধিত গ্রাজুয়েট ২৫ জনই মেয়াদোত্তীর্ণ। এ দিকে নেই আরও পাঁচ শিক্ষক, পাঁচ গবেষক, শিক্ষাবিদ পাঁচ, সবমিলিয়ে পয়তাল্লিশ সিনেট সদস্য ভোটদানে অযোগ্য। একই ধরনের দাবি উত্থাপিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নির্বাচনে সিনেট সদস্য একশত পাঁচ জনের মধ্যে ডাকসু সিনেট সদস্য পাঁচ জন ছাড়া নির্বাচিত হয়েছিলেন জোট সরকারের ভিসি ড. এস এম এ ফায়েজ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়তেও জাকসুর সদস্য ছাড়াই জোট আমলে ভিসি নির্বাচিত হয়েছিলেন ড. মুস্তাহিদুর রহমান। আদালতের স্মরণাপন্ন সেই সময়ের কাউকে হতে হয়নি। আন্দোলনও হয়নি।

কোনো এক অদৃশ্য কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারপন্থী ভিসি আ আম স আরেফিন সিদ্দিকী নির্বাচন দিতে চাইলেন না। ভিসি বিরোধী আন্দোলন হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়তে ঠিকই, তবে কনভোকেশনের তহবিল তছরুপের অভিযোগ নিয়ে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছিল। তারই বহিঃপ্রকাশ স্বরুপ প্রোভিসি প্রফেসর  হারুন-অর-রশিদ এবং কোষাধ্যক মিজানুর রহমান পদত্যাগ করেছিলেন। হ্যারিকেনের বিপদ সংকেত বাড়তে বাড়তে প্রলংকারী মহা বিপদ সংকেতের দিকে ধাবিত হচ্ছিল, সেই মুহূর্তে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়র আন্দোলনকে স্তিমিত করতে গণতন্ত্রকামি ওয়ান ইলেভেনের সামরিক জান্তর বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী নেতা ড. আনোয়ারকে শান্তির দূত হিসাবে পাঠানো হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তারই অনুজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. অহিদুজ্জামান একই সময়ে হাইকোর্টে রিট করলেন ভিসি নির্বাচন নিয়ে। রুলও পেলেন নির্বাচন কেন দেয়া হবে না এই মর্মে। ডাকসুর সিনেট সদস্য ব্যতিত বাকি সবাই ঠিক ছিল। প্যানেলজয়ী সিনেট সদস্য ছিল তাদের। তারপর সাবজুডিস ম্যাটার বলে নির্বাচন হলো না। বাদী অধ্যাপক অহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব আনা হলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়তে ১৯৯০ সালের ছয় জুলাই সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়। ১৯৯৮ সালের ২৭ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আজাদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এক সভায় ডাকসু ভেঙে দেয়া হয় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়র বিশাল অংকের সিনেট সদস্য অনুপস্থিত থাকার পরেও আদালতের রায়ে চারশ দাঙ্গা পুলিশ নিয়ে নির্বাচনের হুকুম তামিল করলেন গণতন্ত্রমনা ভিসি আনোয়ার হোসেন। কালো দিবস উৎযাপিত হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। গণতন্ত্র মানত করে শেষকালে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী হয়ে গেলেন রাষ্ট্রপতির পছন্দনীয় ভিসি হিসাবে। আত্মীয়করণ, দলীয়করণ, শিক্ষক নিয়োগ, উচ্চপদে পদায়ন, শিক্ষক নির্যাতন, জীববৈচিত্র বিনষ্টকারী, সকল অভিযোগে অভিযুক্ত পদত্যাগকারী সাবেক ভিসি শরিফ এনামুল কবির সাহেব সর্বাধিক ভোট পেয়ে নতুন দলীয়করণের অভয়াশ্রম তৈরিতে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের কনিষ্ঠতম সদস্য হলেন। বলা বাহুল্য,  বিগত জোট সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. জিন্নাতুন নেসা তাহমিদা বেগম হয়েছিলেন পিএসসির চেয়ারম্যান। একানব্বইয়ের জাতীয়তাবাদী সরকারের আমলে পিএসসির চেয়ারম্যান ড. এসএমএ ফায়েজ পরবর্তীতে জোট আমলে হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। আর এবার এনামুল কবির ভিসি থেকে হলেন  পিএসসির কনিষ্ঠতম সদস্য, তাও আবার স্থান পেলেন  প্রাণ রসায়ন ও অনুবিজ্ঞান বিভাগের কনিষ্ঠ অধ্যাপক এমরান কবির চৌধুরীর পরে।

১৯৯৬ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে লীগ সরকারে ভিসি ড. এস এম নজরুল ইসলাম দলীয়করণে মেডেল পেয়ে মহাজোট সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্রকল্প নিয়ে যোগদান করলেন মহাজোটের সময়ে বুয়েটে। অযোগ্য দলীয় শিক্ষক নিয়োগ, আটান্নজনকে ডিঙিয়ে প্রোভিসি নিয়োগ,অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ, ছাত্রলীগের এক নেতা ফেল করার পরেও তাকে পাস করানো, নিয়মবহির্ভূতভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি,একনায়কতান্ত্রিক কার্যক্রম বুয়েটকে আন্দোলনে নিয়ে গেল।

সেই বুয়েটে শিক্ষকেরা ক্লাস বর্জন করে ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। আন্দোলনরত শিক্ষকরা মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে সম্মান দেখিয়ে সমস্যা সমাধানের জন্যে দুইদিনের বিরতি দিলে তিনি ‘বিব্রত’ হন। যখন জলকামানের আঘাতে আন্দোলনরত বঞ্চিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আত্মহুতি দেন, তখন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ‘বিব্রত’ বোধ করেন না।  ভিকারুননিসা নুন স্কুলে পরিমল জয়ধরের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার পরেও ‘বিব্রত’ হতে দেখা যায়নি মাননীয় মন্ত্রীকে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে বিরোধী দলীয় শিক্ষার্থীরা খুন হলেও মাননীয় মন্ত্রীকে বিব্রত হতে দেখি নাই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হয়েছিলেন। তাই ছাত্রলীগের অপকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেই ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর জরুরি সভা ডেকে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কেঁদেছে সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রবাস পোড়ানোর ঘটনায়ও। কেঁদেছেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীও। কারা কিভাবে পুড়িয়েছেন,কার কী ভূমিকা ছিল তার বিস্তারিত সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে।

সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা অ্যাডভোকেট রণজিত গ্রুপের অনুসারী ছাত্রলীগের সিলেট জেলা সভাপতি পঙ্কজ পুরকায়স্থ, সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি দেবাংশু দাস মিঠুসহ শতাধিক ছাত্রলীগ কর্মী ওই ছাত্রাবাসে আগুন দেয়। এমসি কলেজের অধ্যক্ষ ধীরেশ চন্দ্র সরকার ছিলেন তাদের কাছে অসহায়। আগুন দেয়ার পর সিলেট ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক পরিমল কুণ্ডু ঘটনাস্থলে নিজে উপস্থিত থাকলেও তার কিছুই করার ছিল না। পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতেও পারেনি। । দেখেছি শুধু  এমসি কলেজের ভস্মিভূত হলের প্রাঙ্গনে দাড়িয়ে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে অশ্রুসজল নয়নে কাদতে বিব্রতবোধ করেননি। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না করতে পেরেও তিনি ‘বিব্রত’ হননি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শত ধর্ষণের উদযাপন কালের তৎকালীন ভিসি পদোন্নতি পেয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা উপদেষ্টা হলেও শিক্ষামন্ত্রীকে বিব্রত হতে দেখা যায়নি। পদ্মাসেতুর চাঁদাবাজির টাকা ভাগবাটোয়ারায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মী আব্দুল্লাহ আল হাসান সোহেল খুন হলো। কিন্তু মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর বিব্রতবোধ তখন কোথায় ছিল? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষে আবুবকর সিদ্দিক নামে একজন মেধাবী ছাত্র নিহত হন। মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় আবু বকরের পঞ্চম সেমিস্টারের রেজাল্ট। দেখা গেল প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছে সে। দারিদ্র পরিবারের এই মেধাবী তরুণকে নৃশংসভাবে খুন করলো ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। কোনো বিচার হলো না। অভিযুক্ত এ এফ রহমান হলের ছাত্রলীগ সভাপতি জামিন পেয়ে ক্যাম্পাসে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বুয়েট ঘটনায় বিব্রত হলেও এ ঘটনায় তাকে বিব্রত হতে দেখা যায়নি।

আ. ন. ম এহছানুল হক মিলন: বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক

                                       সম্পাদক এবং সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী
                                       ইমেইল:ehsanulhoquemilan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.