জাতীয় সম্পদ-উন্নয়নের নামে জবরদখল

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র-তীরবর্তী কয়েক কিলোমিটার এলাকা দখল করে সুতাকল বসানোর যে সংবাদ মঙ্গলবারের সমকালে প্রকাশ হয়েছে, তা নিমজ্জিত হিমশৈলের দৃশ্যমান চূড়ামাত্র। দেশজুড়েই নদী দখলের যে 'মহোৎসব' চলছে, তার এমন খণ্ডচিত্র মাঝে মধ্যেই সংবাদমাধ্যমে স্থান পায়। ভিন্নতা কেবল দখলদারের।


দখল প্রক্রিয়া, সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের ধরি মাছ না ছুঁই পানি জাতীয় প্রতিক্রিয়া_ সবই অভিন্ন। উচ্চ আদালতের নির্দেশও আড়াইহাজারে প্রথম অমান্য হয়নি। অন্যান্য নদী দখলের ক্ষেত্রেও এভাবে আইন ও আদালত অগ্রাহ্য হয়েছে। কেবল কি নদী? আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি_ জলাভূমি, পাহাড়, বন, খাসজমি, এমনকি সড়কও দখলের কবলে পড়ছে। যদি বলা হয় গোটা দেশেই এখন দখলদারদের কবলে, অত্যুক্তি হবে কি? খোদ রাজধানীতেই কি ফুটপাতের পর ফুটপাত দখল করে কতিপয় গোষ্ঠী পকেট ভারী করছে না? বারোয়ারি ফুটপাতকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহারের আপাত ক্ষুদ্র ও অস্থায়ী দখলদারিত্বই কি ক্রমে ক্রমে নদীর মতো বৃহৎ সম্পদ গ্রাসের দুঃসাহস জুগিয়েছে? নগর সংশ্লিষ্ট নদীগুলোতে দখলদাররা রেহাই পেয়েছে বলেই না এখন পাহাড় ও প্রান্তরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতেও থাবা বসানো শুরু হয়েছে। শীতলক্ষ্যা দখল সম্পন্ন হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জের দখলবাজরা পুরাতন ব্রহ্মপুত্রকেও পৈতৃক সম্পত্তি ভাবতে শুরু করেছে। জলাভূমি, পাহাড় ও বনের মতো সামষ্টিক সম্পদ এভাবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর নির্বিচার ভোগে লাগার কুফল আমরা ইতিমধ্যেই প্রত্যক্ষ করছি। দখল ও দূষণের কবলে পড়ে নদী বিপন্ন হওয়ার কারণে মৎস্যসম্পদ, সেচ, যোগাযোগ, জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বন ও পাহাড় দখলের কারণে টান পড়েছে বনজ উৎপাদনে। সার্বিক জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ সুরক্ষায়ও জলাভূমি, পাহাড় ও বনভূমির দখলদারিত্বে শূন্য সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করা জরুরি। সামষ্টিক অধিকারের প্রশ্নও আমলে নিতে হবে। আমাদের দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা এসব সম্পদনির্ভর। বড় কথা প্রাকৃতিক সম্পদ অক্ষুণ্ন রাখা না গেলে তো গোটা উৎপাদন ও উন্নয়ন ব্যবস্থাই ধসে পড়বে! বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠী নয়, সবার জন্যই সেটা হবে বিপর্যয়। দখলদারদের এখনই থামানো না গেলে দখলের বিষবৃক্ষ শিকড় ও শাখা ছড়িয়ে বনে পরিণত হবে। দুর্ভাগ্যবশত দলের বিরুদ্ধে যারা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, কখনও কখনও তাদের বিরুদ্ধেই ওঠে অভিযোগের তর্জনী। ভুল নীতিও অনেক ক্ষেত্রে দখলদারদের জন্য পোয়াবারো হয়ে ওঠে। ঢাকার চারপাশের নদী দখলের বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীদের দীর্ঘ আন্দোলন ও আইনি লড়াইয়ের পর উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সীমানা পিলার দিয়ে নদী চিহ্নিত করতে। বাস্তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেভাবে কাজটি সম্পন্ন করেছে, তাতে করে দখলের সুযোগই বেড়েছে। রাজধানীর উপকণ্ঠে গড় অঞ্চলে শালবনের কোনো কোনো অংশ ইজারা দেওয়ার নীতি গ্রহণ করার ফলে এখন গোটা সবুজই বিবর্ণ হতে বসেছে। 'অনিবার্য প্রয়োজনে' পাহাড় কাটা নীতি গোটা পাহাড়ি অঞ্চল সমতল ভূমিতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। আমরা মনে করি, সামষ্টিক সম্পদ তথা সংখ্যাগরিষ্ঠের অস্তিত্ব ও অধিকার রক্ষার সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। প্রয়োজন নীতিনির্ধারকদের দেশপ্রেম ও দায়িত্বশীলতা। আড়াইহাজারে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রকে দখলমুক্ত করার মধ্য দিয়েই গুণ দুটি প্রদর্শিত হোক।
 

No comments

Powered by Blogger.