গুড জার্নালিজম by সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

গণমাধ্যমে ইদানীংকালে যেভাবে বড় পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে তাতে একটি ধারণা হওয়া খুব স্বাভাবিক যে সাংবাদিকতা একটি ভালো ব্যবসাও বটে। কিছু কিছু কাগজ আর চ্যানেলের লাভের অংকও (যা শুনা যায়) রীতিমত বিস্ময়কর।

তবে একটি কথা খুব সাধারণভাবে বলেন মানুষ, আর তা হলো “ভালো সাংবাদিকতা কতটুকু হচ্ছে?” এমন প্রশ্নের উত্তর তো খুব সহজ নয়।
  
এমন একটা অবস্থা শুধু এদেশে নয়। অনেক দেশেই। কখনো কখনো এমন হয় যে ভালো সাংবাদিকতা মানেই খারাপ ব্যবসা। কারণ যে সংবাদমাধ্যম ভালো সাংবাদিকতার চেষ্টা করে তার ওপর বিরূপ হতে পারে বিজ্ঞাপণদাতারা, তার ওপর চড়াও হতে পারে প্রভাবশালী গোষ্ঠী। আবার কোনো কোনো গোষ্ঠি তো লাভের কথাই ভাবেন না, ভাবেন গণমাধ্যম এক হাতিয়ার।

কেন বড় পুঁজিপতিরা মিডিয়া ব্যবসায় আসেন? মিডিয়ার অনেক ক্ষমতা বলে? যদি তাই হয় তা হলে মিডয়ার ভূমিকা কি হওয়া উচিত? প্রশ্ন উঠছে গণমাধ্যম কি সরকারের করে দেয়া কোনো নীতিমালায় চলবে নাকি নিজেই একটি শুদ্ধ অবস্থান বেছে নিয়ে চলবে? স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয়টাকেই শ্রেয় মনে করবেন যাদের ভেতর নীতিবোধ আছে।

একটা কথা বলতেই হবে যে আজকাল বাংলাদেশর বেশ কিছু টেলিভিশন চ্যানেল বিশ্বমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। যার কারণে এসব চ্যানেলকে বড় বিনিয়োগে যেতে হয়েছে। একইভাবে বেশ কিছু সংবাদপত্রও হয়েছে অনেক বড় বাজেটে। এই পরিবর্তনটা হয়েছে বেশ দ্রুত, অনেক নাটকীয়ভাবে।

কিন্তু সংবাদ তো শুধু টাকার খেলা নয়। সংবাদ হতে হয় সঠিক, তথ্যনির্ভর, বিশ্বাসযোগ্য। যদি তা নয় তবে তো ভাবতে হবে যে Bad money drives good journalism out of media. 

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, ব্যবসা-বাণিজ্যে পাশ করা তরুণ-তরুণীরা আসছে সাংবাদিকতা পেশায়। কোনো কর্পোরেট চাকুরে না হয়ে কেন তারা গণমাধ্যমে আসছে তা তারাই বলতে পারবে। তবে কি দিনে দিনে  সাংবাদিকতা আর  ব্যবসা একাকার হয়ে যাচ্ছে? অবশ্য ভালো সাংবাদিকতা আর ভালো বাণিজ্য দুটোর মধ্যে কোনো বিরোধ নেই- যদি দুটোই ঠিকমতো হয়। 

আজকের সাংবাদিকতা অনেক ক্ষেত্রেই স্ক্যান্ডাল-কে বড় করে দেখে। এটি অনেকের অভিযোগ। বাস্তবে গণমাধ্যমের কাজ হলো গঠনমূলক বিরোধিতা আর গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা। আর তা যদি করতে না পারে তাহলে ভালো বাণিজ্য হলেও, ভালো সাংবাদিকতা হবে না।

গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রসারে, বিশেষ করে সম্প্রচার সাংবাদিকতা আর অনলাইন সাংবাদিকতার বিকাশে একটি বিষয় নিশ্চত হয়েছে, কোনো ঘটনা বা বিষয় গোপন রাখা খুব সহজ নয়।

তবে প্রশ্ন উঠছে সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা নিয়ে। কারণ সংবাদ মাধ্যমে এখন চলছে চরম প্রতিযোগিতা। যখন ঘটনা ঘটছে প্রতিযোগিতার দৌড়ে তা সাথে সাথে শুধু প্রচারই করছে না, সাথে সাথে বিশ্লষণও করছে। সাংবাদিকদের এটি জন্য এমন একটি চ্যালেঞ্জ যেখানে তার বিচার ক্ষমতা থাকাটা খুব জরুরি।

আমরা বিডিআর বিদ্রোহের সময় দেখলাম অনেকগুলো চ্যানেলে সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত কত দুর্বল। এমনকি খুব বিখ্যাত রিপোর্টারও শুধু বিদ্রোহী সৈনিকদের দেয়া তথ্য দিয়ে রিপোর্ট করেছেন। তারা একবার বুঝতে চেষ্টা করেননি সৈনিকরা বিদ্রোহ করে শৃংখলা ভেঙেছে, তারা যাদের কমান্ডিং কর্মকর্তাদের হত্যা করেছে। সেই রিপোর্টার একবারও ভাবেননি তারা যাদের হত্যা করেছে, তাদের সম্পর্কে অশালিন কথা বলছে, তখন তাদের স্বজনরা কতটা কষ্ট নিয়ে এসব টিভি পর্দায় দেখছেন! 

কিভাবে সংকটকালে সম্পাদকীয় বিচার করতে হয়, কিভাবে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হয় তার একটা পরীক্ষা ছিল বিডিআর বিদ্রোহ। আমরা নিশ্চয় অনেক কিছু বুঝতে পেরেছি এই ঘটনা থেকে।

সম্প্রচার যাই করি না কেন, যতই লাইভ বা সরাসরি সম্প্রচারের জয়গান গাই না কেন, দিন শেষে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের শক্ত নৈতিক অবস্থানই পুরো সম্প্রচার কার্যক্রমের ক্রেডিবিলিটি নিশ্চিত করে। তেমনি প্রিন্ট মিডিয়াতেও যতই মাটির তলা থেকে তথ্য নিয়ে আসি না কেন, শেষ পর্যন্ত মানুষ দেখতে চায় পত্রিকা কতটা ন্যায়-নীতির পথে হাঁটছে?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: বার্তা পরিচালক, একাত্তর টেলিভিশন
                              ইমেইল: ishtiaquereza@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.