বুয়েটে বাংলাদেশের শিক্ষাবসন্ত by আ ন ম এহ্ছানুল হক মিলন

১৮৭৬ সালে পুরান ঢাকায় নলগোলায় প্রতিষ্ঠিত ঢাকা সার্ভে স্কুলই আজকের বুয়েট। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় বাঙালি সার্ভেয়ারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো ওই স্কুলে। একসময় সিভিল ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্স চালু করে ঢাকা আহ্ছানুল্লাহ স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে রূপ নেয়।

সে সময় ঢাকার নওয়াবদের কাছ থেকে বিপুল অর্থসহায়তা আসায় স্কুলটির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটে ১৯১২ সালে নলগোলা থেকে পলাশীতে স্থানান্তরিত হয়ে। ১৯৪৭ সালে স্কুলটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ করা হয়। ১৯৬২ সালের দিকে পূর্ব পাকিস্তান প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করে এটিকে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার সুবিধা দেয়া হয়। একাত্তরে দেশ স্বাধীন হলে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
যার সুনাম শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়ে ২৫ হাজার প্রকৌশলী তাদের কর্মদক্ষতা দিয়ে বিদেশেও দেশের মুখ উজ্জ্বল করেন। তারই একজন প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খান (এফ আর খান) ১৪৫০ ফুট উঁচু ১১০ তলাবিশিষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের সিকাগো নগরীতে সিয়ার্স টাওয়ার সোজা আকাশের বুকে তুলে দেয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন। তিনি তার কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৩টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছেন, যা বিশ্বে বিরল। আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার বেথলেহেমে লিহা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সম্মানে ‘এফ আর খান চেয়ার’ চালু করা হয়েছে। অপর একজন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসায় গবেষক হিসেবে কাজ করছেন বুয়েট থেকে ১৯৬৯ সালে যন্ত্রকৌশলে স্নাতক করা এম কামরুজ্জামান। তার টার্বোলেন্ট ফো থিওরির জন্য তিনি নাসার সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘নাসা অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ পান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ৯০০ শিক্ষক আর সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী, যার মধ্যে নেপাল, ইরান, জর্ডান, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিস্তিনের শিক্ষার্থী রয়েছে।

বাংলাদেশে তিস্তা ব্যারাজ, যমুনা সেতু, রূপসা সেতু, চট্টগ্রাম বন্দরের সম্প্রসারণ, দেশের সর্বোচ্চ ভবন সিটি সেন্টার, বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক, নগরভবন, গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফাইওভার, হাতিরঝিল প্রকল্প, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র, বিভিন্ন বাঁধ, সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, দেশের একমাত্র নভোথিয়েটার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ভবনসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ও প্রকল্প বুয়েটের বড় বড় কীর্তির উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। দেশের প্রথম লবণ পরিশোধনাগারের ডিজাইন করেছিলেন বুয়েটের প্রকৌশলীরা।

একসময় রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস হিসেবে বুয়েটের সুনাম ছিল। আইয়ুব, মোনায়েম থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই বুয়েটে রাজনীতি ঢোকাতে পারেনি। সেরা মেধাবী শিক্ষার্থী ছাড়া কেউ ভর্তি হতে কিংবা ভিসির সন্তান হয়েও যোগদান করতে পারেনি শিক্ষক হিসেবে। নকল, আত্মীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, ফেবারেটিজমের মতো উপাদান আজ অবধি স্পর্শ করতে পারেনি এই সোয়া শ’ ঊর্ধ্ব প্রতিষ্ঠানটিকে। অথচ এখন পরীক্ষা না দিয়েও ভিসির কৃপায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পাস করে বের হয়। দলীয় বিবেচনায় একের পর এক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। তবে যখনই কোনো সরকার বুয়েটের ওপর রাজনৈতিক খড়গ চাপাতে চেয়েছে, তখন প্রতিবাদে, উত্তাল হয়ে উঠেছে বুয়েট। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দলীয় ভিসি নিয়োগের চেষ্টা করেও পারেনি। এবার ক্ষমতায় এসে দলীয়করণের ষোলো কলাই পূরণ করেছে তারা। ২০১০ সালের ৩১ আগস্ট এস এম নজরুল ইসলামকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে এই প্রথম কোনো দলীয় ভিসি নিয়োগ দেয়া হয়। এর পরই দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির দুষ্ট ছায়া ঢেকে ফেলে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপীঠকে। যে ক্যাম্পাস থেকে বের হবে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ গবেষক, প্রযুক্তিবিদ ও প্রকৌশলী, বর্তমান ভিসি সেই ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী পালন করা শুরু করেছেন। যেকোনো সৃষ্টিশীল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই এটি চরম অন্ধকারের দিক। বুয়েটের সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা টের পেয়েই এই দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছেন। বিএনপি ক্ষমতায় এসে বুয়েটকে কখনোই দলীয়করণের চেষ্টা করেনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে বিএনপি ভিসি নির্বাচনে বুয়েটের ঐতিহ্য ধরে রাখে।

এই লেখা লিখতে গিয়ে তখনকার একটি মজার ঘটনা মনে পড়ছে। লেখক তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. ওসমান গনির সুযোগ্য সন্তান ড. এম ওসমান ফারুক ছিলেন লেখকের মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। অধ্যাপক আলী মূর্তজাকে মন্ত্রণালয়ে ডেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্ব নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো। অধ্যাপকের ভেতরে এ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। তিনি নির্লিপ্তভাবে জানালেন, ভিসি হবেন না। ঝুটঝামেলা ভালো লাগে না এ রকম একটা ভাব দেখালেন। কিন্তু বহুকালের প্রাচীন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আপন ঐতিহ্য তো তার ভাঙা যায় না! কোনো রকমের দলীয় প্রীতি না দেখিয়ে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতেই শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাকে ডেকে পাঠালে তিনি দায়িত্ব নিতে রাজি হন। এরপর মন্ত্রী তাকে বললেন, বুয়েটের পরিবেশ কেমন যাচ্ছে তা জানতে রাতে হয়তো আপনাকে ফোন করতে হতে পারে। আপনার বাসার ল্যান্ডফোন নম্বরটা একটু দিন। জবাবে নবনির্বাচিত ভিসি বললেন, আমার বাসার ফোন নম্বর কাউকে দিই না। তখন মন্ত্রী একটু আঁতকে উঠলেন এবং অবাক হলেন। জানতে চাইলেন, কেন? আমাকেও দিতে পারবেন না? প্রবীণ অধ্যাপক তখন বললেন, স্যার, আমার একটা মেয়ে আছে। কেউ যদি বাসার নম্বর পেয়ে তাকে জ্বালাতন করে... তাই, বাসার নম্বর কাউকেই দিই না।

শিক্ষক, ছাত্র, কর্মকর্তা ও কর্মচারী কেউই দলীয়করণে বিশ্বাস করতেন না। এ রকম পরিবেশ ও মনোভাব সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু এবার দেখা গেল যে দলীয়করণ করতে প্রায় ৫৯ জন জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে ডিঙিয়ে প্রোভিসি বানানো হয়েছে। নিয়োগ দেয়া হয়েছে অযোগ্য দলবাজ রেজিস্ট্রার। অথচ বুয়েটে প্রোভিসি নিয়োগের রেওয়াজ আগে ছিল না। ছোট ক্যাম্পাসে একজন প্রোভিসির দরকার আছে বলেও মনে করছেন না শিক্ষকেরা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এখন আন্দোলনরত- যেভাবেই হোক এ বিদ্যাপীঠের ঐতিহ্য, মানমর্যাদা রক্ষা করতে হবে। জবাবে ভিসি জানিয়ে দিলেন, প্রধানমন্ত্রীর কথা ছাড়া তিনি পদত্যাগ করবেন না। এ দিকে শিক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন, সারা দেশ উদ্বিগ্ন। কালো বিড়ালও একই কথা বলেছিলেন। ৭০ লাখ ঘুষের টাকা ধরা পড়ার পর জানালেন মন্ত্রী বানিয়েছেন যিনি তার কথায়ই পদত্যাগ করবেন। তারপর সেই থমথমে অবস্থায় মিডিয়ার কঠিন দৃষ্টি এড়িয়ে কালো বিড়াল গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল। সেই যে পালিয়ে গেল কালো বিড়াল আবার স্বমহিয়ায় ফিরে এসেছে সাদা হয়ে। এ যেন জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতা : ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা; যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই- প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই, পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।’ প্রধানমন্ত্রী অদ্ভুত আঁধারের মানুষ। তিনি কালো বিড়ালের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। একই ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের ছেলে সোহেল তাজের ক্ষেত্রেও। শুধু প্রধানমন্ত্রীর দোহাই। বুয়েটের ব্যাপারটা না হয় গোপালগঞ্জের। কিন্তু অন্যগুলো? দুনিয়াজুড়ে প্রচারিত হলো এ দেশের মন্ত্রী-আমলাদের দুনিয়ার খবর। মাথা আমাদের নিচু হয়ে গেল। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ ফায়সালা না করে উদর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছে। সরকার অপমানের শোধ নেয়ার কথাও বলেছে। কিন্তু প্রমাণিত দুর্নীতিগ্রস্তদের বিচারের কোনো ব্যবস্থা করল না।

শুধু একটাই সমস্যার কথা বলে বেড়াচ্ছে সবাই। যদি প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন, তাহলে পদত্যাগ করবেন তারা। এখন প্রশ্ন, সবাই কি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই দুর্নীতি করেছেন? যদি না-ই করতেন তাহলে প্রধানমন্ত্রীর কথা তুলে আনবেন কেন।

পদ্মা সেতু দুর্নীতি ইস্যুতে আবুল হোসেন পদত্যাগ করলে দেশের সাধারণ মানুষের এত দুর্দশা সইতে হতো না। উন্নয়ন সহযোগীদের সাথেও তৈরি হতো না মনোমালিন্য। কিন্তু বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু, বুয়েটের কালো বিড়ালের কোনো দুর্নীতিই দেখেন না।

বুয়েটের বর্তমান এই ভিসি ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়ে সেখানেও তিনি শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মের সাথে জড়িত ছিলেন বলে আন্দোলনের মুখে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বেরিয়ে আসেন। সেই দলীয়করণে পুরস্কারস্বরূপ তাকে বুয়েটের ভিসি হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। এই ভিসি ৩৫ বছরের ক্যান্টিন পরিচালক নুরুল ইসলামকে ভিন্ন মতাবলম্বীর দোহাই দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করেন। ছাত্রলীগ নেতাকে চাঁদা দিতে না পারায় তাকে ব্যবসায় গুটিয়ে বাড়ি ফিরে আসতে হয়।

বুয়েট থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা অর্জনের কোনো প্রতিষ্ঠানই আজ আওয়ামী লীগের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত নয়। চাঁদাবাজি, নির্মম হত্যাকাণ্ড ও যৌন নির্যাতন থেকে শুরু করে এমন হীন কাজ নেই যে ক্যাম্পাস তা থেকে দূরে আছে। এ অবস্থায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে বুয়েটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। এ যেন আরব বসন্তের মতো বাংলাদেশের শিক্ষাবসন্ত।


 আ ন ম এহ্ছানুল হক মিলন:  বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.