বিতর্কিত সিদ্ধান্তের আবর্তে বিদ্যুৎখাত by সরকার মোহাম্মদ মাসুম

অতি সম্প্রতি বেসরকারি খাতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য আরো একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, দেশের বর্তমান নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থায় আমদানিকৃত ফার্নেস অয়েলের আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের যৌক্তিকতা কতটুকু?

যেখানে জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম নিজেই বলছেন,  কুইক রেন্টাল কোনো সমাধান নয়, সেক্ষেত্রে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে। ১০২ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ফার্নেস অয়েলভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন হবে নারায়ণগঞ্জে। ১৫ বছরমেয়াদি এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম চুক্তির সময় ৬ টাকা ৯১ পয়সা ধরা হলেও ফার্নেস ওয়েলের দাম বৃদ্ধিতে এখন সে দাম পড়বে প্রায় ১৪ টাকা প্রতি ইউনিট। এ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ আগামী ১২ মাসের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস। এবং আশঙ্কার ব্যাপার এই যে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গ্যাসের মজুদ তুলনামূলকভাবে দ্রুত কমে আসছে। কমে আসাটাই স্বাভাবিক। বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও গৃহস্থালী কাজ ও যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে গ্যাস। এই অতিরিক্ত ব্যবহার বা অপব্যবহার দ্রুত কমিয়ে আনছে বর্তমান সময়ে পুরো জাতির সবচেয়ে বড় ভরসাকে।

জ্বালানি উপদেষ্টা বলেছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখনই আমাদের কয়লা প্রয়োজন। সাধারন যুক্তির ভিত্তিতে তার এই বক্তব্য বেশ আশাব্যাঞ্জক। কারণ দেশজুড়ে এখন পাঁচটি স্থানে রয়েছে কয়লার বিপুল মজুদ। লুকিয়ে আছে উন্নয়নের অগ্রযাত্রার অমিত সম্ভাবনা।

জ্বালানি বিভাগের পরিসংখ্যান মতে দেশে কয়লার সম্ভাব্য মজুদ ৩৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। আর এই পরিমাণ কয়লার তাপ উৎপাদন ক্ষমতা ৮৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুটের সমান। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশে যে পরিমাণ কয়লা মজুদ রয়েছে তা উত্তোলন করা হলে শুধু কয়লা থেকেই অনায়াসে ৫০ বছর একটানা প্রতিদিন ১০ হাজার মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। প্রতিদিন ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ৩০ মিলিয়ন টন কয়লা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে গ্যাসের ওপর চাপ কমিয়ে গ্যাস উদ্বৃত্ত করা সম্ভব। কিন্তু এই পরিসংখান জানা থাকার পরও কেন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তেল আমদানি করে স্বল্পমেয়াদী ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে অথবা কয়লা আমদানি করা হচ্ছে, তা ঠিক বোধগম্য নয়।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎই হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যত, এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর সেই কয়লা দেশের মজুদ থেকে উত্তোলন করা হলে তা বাংলাদেশে অর্থনীতি এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও বিশাল পরিবর্তন আনবে বলে মনে করছেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী কামরুজ্জামান বলেন, খনি এলাকার ভৌগোলিক অবস্থা দেখে তারপর পদ্ধতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ফুলবাড়ী ও বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। স্থানীয় অধিবাসীদের ক্ষতিপূরণ ও তাদের পুনর্বাসন করা গেলে উন্মুক্ত পদ্ধতিই সবচেয়ে উত্তম। কারণ, এ পদ্ধতির মাধ্যমে ৯৫ ভাগ কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। তাছাড়া এ পদ্ধতির মাধ্যমে যেদিক থেকে প্রথম কয়লা উত্তোলন করা হবে সেদিকে পর্যায়ক্রমে ভূমি আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। এ জমি সরকারি খাস হিসেবে বিবেচিত হবে। ভারতসহ জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, মঙ্গোলিয়া প্রভৃতি দেশে উন্মুক্ত পদ্ধতির মাধ্যমে বহু কয়লাখনি থেকে কয়লা উৎপাদন করা হচ্ছে।

আণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান ভূ-তাত্ত্বিক ইউনুস আকন বলেন, দেশীয় কয়লা উত্তোলনে আমি উন্মুক্ত পদ্ধতির পক্ষে। কারণ এ পদ্ধতির মাধ্যমে ৯৫ ভাগ কয়লা উত্তোলন করা যায়। এতে খরচও অনেক কম। তাছাড়া এ পদ্ধতি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। সরকার তেলচালিত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১ ইউনিট বিদ্যুতের জন্য খরচ করছে ১৪-১৫ টাকা। সেখানে কয়লা দিয়ে প্রতি ইউনিট তিন টাকা করে উৎপাদন সম্ভব। তাছাড়া বড়পুকুরিয়াতে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতির মাধ্যমে ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে তেমন সফলতা দেখা যাচ্ছে না। এখনও এক হাজার কোটি টাকা লোকসানে আছে প্রকল্পটি। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কিছু লোকের ক্ষতি হবে ঠিকই। তবে তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। এ প্রক্রিয়ার আর একটি বিশেষ দিক হচ্ছে, যেদিক থেকে কাজ করা হবে পর্যায়ক্রমে তা আবার আবাদি জমিতে পরিণত হবে। আর ভূগর্ভস্থ পদ্ধতির মাধ্যমে ৭০ ভাগের বেশি কয়লা উত্তোলন সম্ভব নয়।

জ্বালানি উপদেষ্টা আরো বলেছেন, ‘‘মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী কয়লা, গ্যাস, নিউক্লিয়ার ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে প্রবেশ করলে তেলভিত্তিক কেন্দ্রের ওপর চাপ কমবে।’’

গ্যাসের মজুদ যেখানে ইতিমধ্যেই আশঙ্কাজনকভাবে কমে আসছে, সেখানে গ্যাসের ওপর আরো জোর দেয়াটাও জনগণের কাছে সুবিধাজনক বলে ঠেকছে না।  ১৯৮০’র দশকের দিকে রাশিয়ার চেরনোবিলে কিংবা হালের জাপানে নিউক্লিয়ার পাওয়ার পস্ন্যান্টের দুর্ঘটনাগুলো থেকে দেখা যায় যে এই বিপর্যয়গুলো রাশিয়া কিংবা জাপানের মতো উন্নত দেশগুলোর ভীত পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এরকম দুর্ঘটনা ঘটলে তা হয়তো জাতির বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

সমস্যা হলো, জ্বালানি উপদেষ্টারা গ্যাসের ওপর চাপ কমাতে বলেন, কয়লার ওপর জোর দেন, আবার তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটার পর একটার অনুমোদন দিচ্ছেন। এর অর্থ একটাই সরকারের গঠনমূলক জ্বালানি নীতি নেই। আর সুদূরপ্রসারী নীতি তো নেই-ই।

সরকার মোহাম্মদ মাসুম: অর্থনীতিবিদ
                                         email: masum349@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.