নাগরিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের উল্টোপথে পার্বত্য নেতারা by মোহাম্মদ আরজু

স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পরে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের কবলে জাতিগত নির্মূল অভিযানের মুখে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর নেতারা দেশের সমগ্র নাগরিকের এক সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামে জোরালো অবস্থান নেন নাই।

বরং বাঙালি জাতীয়বাদ যেমন বাঙালিত্ব ছাড়া আর সব আত্মপরিচয় মুছে দিতে চায়, তেমনি পার্বত্যাঞ্চলের ভিন্ন সংখ্যালঘু জাতির লোকেদের নানা পরিচয় মুছে দিয়ে- বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিক্রিয়া হিসাবে নিজেদের জনগণের আত্মপরিচয়ের রাজনৈতিক বয়ান হিসাবে জুম্ম জাতীয়তাবাদের বয়ান তৈরি করে লড়াইয়ে নেমেছিলেন।

জুম্ম জাতীয়তাবাদের সেই লড়াই এক পর্যায়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে- প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সামরিক কৌশলগত অভিযানের অংশ হয়েও চালু ছিল। ছিয়াত্তর থেকে সাতানব্বই পর্যন্ত লড়াইয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির সমিতির গেরিলাদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর লড়াইয়ে সেখানকার বাঙালি ও অবাঙালি নানা জাতির যতো সংখ্যক মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিল তা সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে নিশ্চয় কয়েকগুণ বেশি হবে।

কিন্তু জুম্ম জাতীয়তাবাদী স্বশস্ত্র নেতারা শেষ পর্যন্ত নানা কারণেই সরকারের সঙ্গে এমন এক চুক্তিতে অস্ত্র ত্যাগ করলেন, যেখানে জুম্ম জাতীয়তা দূরের কথা- ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্ত্বা হিসাবেও কোনো স্বীকৃতির সুযোগ রইলো না। তারা নিজেদের ‘উপজাতি’ (ট্রাইব) বলে মেনে নিয়ে পার্বত্য চুক্তি সই করলেন উনিশশ’ সাতানব্বই সালের ২ ডিসেম্বর।

অথচ দেখা গেল, বিদ্যমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সাব্যস্ত করে দুই হাজার দশ সালের বারো এবং তেরো এপ্রিল দেয়া রায়ে তো বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের হাই কোর্ট বিভাগ ওই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলাকে অসাংবিধানিক কাজেই অবৈধ বলে ঘোষণা করলেন। আপিল বিভাগ কি ফায়সালা দেবেন তা জানতে এখনো অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এরই মধ্যে সংবিধানের নানা সংশোধনী নিয়ে আদালতের রায় এসেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে। আদালতের তরফে ক্ষমতাসীনদের হাতে চলে আসা এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ন্যায্যতা ও বৈধতার আধিপত্যের মোকাবিলায় কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রস্তুতি বা তৎপরতা নেই পার্বত্যাঞ্চলের রাজনৈতিক দলগুলোর। বরং তারা আবারো উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেছেন।

এর আগে যেমন তারা ১৯০০ সালের চিটাগাং হিলট্রাক্টস রেগুলেশন অ্যাক্টের আওতায় ‘উপজাতীয় মর্যাদা’ দাবি করছিলেন- যেই রেগুলেশনটা করা হয়েছিল ভারতবর্ষে বৃটিশ ঊপনিবেশের মধ্যে একটি অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম রাখার সুবিধার জন্য। সেভাবেই এখন জনসংহতি সমিতি এবং ইউপিডিএফ, দুইটা প্রধান দলই জাতিসংঘের আদিবাসী সনদের বরাতে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতির দাবি করছেন সরকারের কাছে। নাগরিক হিসাবে পার্বত্যবাসী জাতিসমূহের লোকেদের পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের প্রশ্ন তারা এড়িয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মধ্যে পূর্ণ ও সমান নাগরিকত্বের স্বীকৃতির জন্য তৎপরতা চালানোর বদলে একবার ঔপনিবেশিক আইনে ‘উপজাতি’ হিসাবে স্বীকৃতি আদায়ে, আরেকবার আন্তর্জাতিক আদিবাসী সনদের মর্যাদা দাবি করছেন। কেন?

কিন্তু এই সময়ে বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক রূপ হচ্ছে আগ্রাসী পুঁজির কর্পোরেট বানিজ্য, জাতীয়তাবাদী রাজনীতি যখন পরাশক্তির তরফে এ অঞ্চলে একটি দখলদার ও নিপীড়ক রাষ্ট্রের অনুগত দোসরে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থার মধ্যে জাতীয়তাবাদের এই চরিত্রের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতায় সক্রিয় না হয়ে কি পার্বত্যবাসী তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব ও রাজনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রের কোনো সম্ভাবনা তৈরি করতে পারবেন? খেয়াল রাখা জরুরি যে, এখন থেকে চার দশক আগেকার উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের কবল থেকেই রেহাই পায়নি পার্বত্য চট্টগ্রাম- আর এখন যখন করপোরেট পুঁজির এবং পরাশক্তির সঙ্গে এর খায়খাতির তুঙ্গে তখন রেহাই হবে?

স্বাধীন বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ কায়েম করেন পার্বত্যবাসী। এর আগেও এই দলটি ছিল পাকিস্তান আমলে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতি নামে। জনসংহতি সমিতি গঠনের দিনই মঙ্গলবার সন্ধা সাড়ে ছয়টায় সমিতির আহবায়ক মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়ে তখনকার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। বাংলাদেশের ভাবি সংবিধানে উপজাতীয়দের ন্যায়সঙ্গত অধিকার সংরক্ষণের জন্য তারা প্রধানমন্ত্রীকে একটা স্মারকলিপি দেন। স্মারকলিপির শেষটা ছিল এমন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ কামনা করে যেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে কিছু ‘অতিপ্রয়োজনীয় বিষয়’ গ্রহণ করা হয়। এক. পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল হবে এবং এর একটি নিজস্ব আইন পরিষদ থাকবে। দুই. উপজাতীয় জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ‘১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি’র ন্যায় অনুরূপ সংবিধি ব্যবস্থা বা স্যাংচুয়ারি প্রভিশন সংবিধানে থাকবে। তিন. উপজাতীয় রাজাদের দফতর সংরক্ষণ করা হবে। চার. পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মতামত যাচাই ব্যতিরেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয় নিয়ে কোনও শাসনতান্ত্রিক সংশোধন বা পরিবর্তন যেন না হয়, এরূপ সংবিধি ব্যবস্থা সংবিধানে থাকবে।

এমন দাবির পরে তখনকার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবস্থান কি ছিল? উনিশশ’ ছিয়ানব্বইয়ে ঢাকার সাহিত্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত তার বই ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা’য় লেখক প্রদীপ্ত খীসা জানাচ্ছেন ‘তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘পার্বত্য বন্ধু’ হতে পারেন নি। . . . তিনি উল্টো এম এন লারমাকে এ ব্যাপারে আর অগ্রসর না হবার পরামর্শ দেন।’ কিন্তু প্রশ্ন যখন আপন জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মর্যাদার তখন লারমা স্বভাবতই বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ মেনে বসে থাকেন নাই।

এম এন লারমা’র রাজনৈতিক গুরু অনন্ত বিহারী খীসার ছেলে প্রদীপ্ত খীসা লিখছেন, ‘পরিণামে তিনি নিয়মতান্ত্রিক স্বাভাবিক রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন’। অন্যদিকে তখন পুরা পার্বত্যঞ্চল জুড়ে জনগণের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছিল বিডিআর এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। খীসার বইয়ে সংবাদপত্রের বরাতে দেয়া তথ্যেই জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যে পাঁচ মাসে প্রচুর শারীরিক নির্যাতন-ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া ও জোর করে অর্থ আদায় সহ ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। আর এসব নির্যাতনই চালানো হয় ‘রাজাকার সন্দেহে’ অথবা ‘রাজাকারের সন্ধানে অভিযান’ চালিয়ে।

তাছাড়া খীসা জানাচ্ছেন যে, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে বেসরকারিভাবে ব্যাপক বহিরাগতের পুনর্বাসন কাজ শুরু হয়।’ ফলে একদিকে বাংলাদেশের ভাবি সংবিধানে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের নিশ্চয়তা ও ‘অস্তিত্ব, সংস্কৃতি ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সাংবিধানিক নিশ্চয়তা’ না পাওয়া, অন্যদিকে চলমান জাতিগত দমন ও নির্যাতনের প্রেক্ষিতে খীসার ভাষায় ‘প্রতিরোধের মানসিকতা থেকে জন্ম নেয় শান্তিবাহিনী বা পিস ফোর্স পরবর্তীকালে যা জনসংহতি সমিতির আর্মড ক্যাডার নামে পরিচিত হয়।

শান্তিবাহিনী গঠনের তারিখটি হচ্ছে ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি। তখন থেকেই খীসার ভাষায় ‘উপজাতীয়’ জনগোষ্ঠীর স্বার্থে বিডিআর-পুলিশকে প্রতিরোধ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণের রাখা ও বহিরাগতদের প্রতিরোধে কাজ করে শান্তিবাহিনী। শান্তিবাহিনীর অস্ত্রের প্রধান প্রাথমিক উৎস ছিল ‘রাজাকার এবং সিএএফ-দের লুকিয়ে রাখা অস্ত্র এবং পাকবাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ’। পঁচাত্তরের পরে অবশ্য ইনডিয়ার সহযোগিতা পেতে সক্ষম হয় জনসংহতি সমিতি। অবশ্য ১৯৭৩ সালেই ‘উপজাতীয়দের মনে ক্রমশ অসন্তোষ ও ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে জেনে আওয়ামী লীগ সরকার’ বহিরাগত পুনর্বাসন বন্ধ করে দেন।

আর এই ‘১৯৭৩-৭৪ সাল ছিল শান্তিবাহিনীর রিক্রুটিংয়ের সময়। এ সময় হাজার হাজার যুবককে শান্তিবাহিনীতে ভর্তি করা হয়। তা ছাড়া গ্রামে গ্রামে সহযোগী ‘মিলিশিয়া’দেরও ট্রেনিং দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই শান্তিবাহিনী সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে তোলে।’ এর মধ্যে ১৯৭৪ সালে জনসংহতি সমিতি সমর্থন আদায়ের জন্য ইনডিয়ার তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু ইন্দিরা এটাকে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে আখ্যায়িত করে তাদের ফিরিয়ে দেন। বলে রাখি, তখন সাতবোন রাজ্যগুলাতে আত্মনিয়ন্ত্রাধিকারের দাবিতে জোরদার লড়াই চলছিল। কিন্তু ১৯৭৫-এ শেখ মুজিব নিহত হবার পর প্রদীপ্ত খীসার ভাষায় ‘শত্রু মিত্রের ধারণা পাল্টে যায়’। ইনডিয়া প্রত্যক্ষভাবে জনসংহতি সমিতিকে, আরও বিশেষত জনসংহতির সামরিক শক্তি বাড়ানোর জন্য সহযোগিতা করতে শুরু করে। সব মিলিয়ে প্রদীপ্ত খীসার বই সহ অন্যান্য সংবাদ দলিলপত্রে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের ‘রাজাকার নিধন’ কর্মসূচি থেকে আত্মরক্ষা করতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই  প্রথমবারের মতো স্বশস্ত্র হতে শুরু করে পার্বত্যাঞ্চলের সংগঠনগুলা। কিন্তু পচাত্তরের পরই এতে গুণগত বদল আসে।  ইনডিয়ার আঞ্চলিক স্বার্থের অংশ হয়ে যায় পার্বত্যবাসীর আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই।

ইনডিয়ার সমর্থন ও সহযোগিতায় এরপর ১৯৭৬ সালে প্রথম সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক আক্রমণে যায় জনসংহতি সমিতি। খীসার ভাষায় ‘থানা আক্রমণ করে অস্ত্র লুট এবং পুল, কালভার্ট ও সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি সাধন ছিলো তাদের প্রাথমিক তৎপরতার অংশ। এ সময় শান্তিবাহিনী বিত্তশালী লোক ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের অপহরণ করে অর্থের জন্য মুক্তিপণ দাবি করতে থাকে।’ এই যখন অবস্থা- ইনডিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্যের অংশ হিসাবে জুড়ে যাওয়া একটা স্বশস্ত্র তৎপরতা ঠেকানোর প্রশ্ন যখন জেনারেল জিয়ার সামনে আসলো, তিনি সামরিক ব্যবস্থা নিলেন। রাজনৈতিক সমাধানের পথে অগ্রসর হলেন না। কিন্তু পার্বত্যাঞ্চলের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ওই অঞ্চলের মানুষের গেরিলা লড়াইয়ের সামনে বাংলাদেশের সরকারি বাহিনী ছিল দুর্বলতর। ‘১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে নিয়মিত সংঘর্ষে সরকারি বাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়’, জানাচ্ছেন খীসা।

এরপর নানা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগ নিলেও ১৯৭৯ সালে বিশাল সংখ্যক বাঙালিকে পার্বত্যাঞ্চলে বসতি তৈরি করে দেন জিয়া। ফলে সমস্যা আরো জটিলতর হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর পরে খীসার ভাষায় ‘তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা পুনরুজ্জীবনের ‘দ্বিতীয় জনক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান।’ এর আগে পর্যন্ত পার্বত্য গেরিলারা নিরস্ত্র জনগণকে মানবঢাল হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ পেতো। কিন্তু ১৯৭৯ থেকে বিশাল সংখ্যক বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের ‘বেসামরিক’ মানুষ হিসাবে হাজির করে মানবঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করে সরকারি বাহিনী। অনেকটা মুশকিলে পড়ে শান্তিবাহিনী। তাছাড়া ১৯৮১ এর শুরু করে জনসংহতি সমিতির মধ্যে ভাঙনও স্বশস্ত্র লড়াইকে দুর্বল করে তোলে। পাশাপাশি আঞ্চলিক রাজনীতির পরিসরে ইনডিয়াও তার অবস্থান বদলায়। নিজের সাতবোন রাজ্যের দিকে তাকিয়ে জনসংহতিকে সহযোগিতা বন্ধ করে।  সবমিলিয়ে আশির দশকেই কার্যত জনসংহতির সামরিক লড়াই দুর্বল হয়ে যায়। পরে উনিশশ সাতানব্বইতে সরকারের সাথে ‘পার্বত্য চুক্তি’ করে তারা। যে চুক্তি বিদ্যমান সংবিধান ও শাসনব্যবস্থার মধ্যে বাস্তবায়নের অযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে গত তের বছরে।



আলাদা জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের কায়েম হওয়ার লড়াইয়ে- একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে পার্বত্যাঞ্চলের সামন্ত নেতৃত্ব ওই লড়াইয়ে অংশ নেন নাই। তারপর বঙ্গবন্ধু কর্তৃক রাজা ত্রিদিব রায়ের নাগরিকত্ব বাতিল করলে ওই অঞ্চলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সামন্ত প্রথা থেকে বেরিয়ে আসে। এম এন লারমা প্রমুখরা জনসংহতি গঠন করে নেতৃত্বে আসেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর একদলীয় শাসনব্যবস্থা- বাকশালের প্রতি অনুগত হয়ে, কয়েকটা জাতির প্রতিনিধি হয়েও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনাব লারমা ও তার দল যে রাজনৈতিক ভুল করেন। তারপর যে স্বশস্ত্র লড়াই তারা করেন, তাকে নিজেদের স্বজ্ঞানে ও সম্মতিতে এমন একটা রাষ্ট্রের আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের অংশ হতে দেন- যেই ইনডিয়া নিজেই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় অনেকগুলা জাতির ওপর দখলদারি বজায় রেখেছে। আর এখন সেই রাজনৈতিক দলটার নেতৃত্বে আছেন জনাব জে এন লারমা। কিন্তু যেই জনগণের কাছে সন্তু লারমা বলে অধিক পরিচিত ও প্রিয় তিনি, সেই জনগণের জন্য যথার্থ রাজনৈতিক ভূমিকা কি রাখতে পারছেন?

পার্বত্য অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতৃত্বের এখন এই প্রশ্নটা নিজেদের করতে হবে। তারা কি জাতিসংঘ ঘোষিত এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় খ্রিস্টান মিশনারিদের সাম্রাজ্যিক খায়েশের সহযোগী হয়ে ওঠা ‘আদিবাসী’ সনদের মধ্যে নিছক আইনি সুরক্ষা খুঁজবেন? (যে সনদ তাদের নিজস্ব জীবন-জীবিকা-ধর্ম-কৃষ্টি-সংস্কৃতির সুরক্ষার কোনো নিশ্চয়তা দেয় না বলে ইতিমধ্যে ইনডিয়ার সাতবোন রাজ্যগুলাতে, অস্ট্রেলিয়ায়, আমেরিকায় প্রমাণিত হয়েছে। যেকোনো রাষ্ট্র যেকোনো সময় যে সুরক্ষা লঙ্ঘন করতে পারে। যে পরিচয় যেকোনো জাতি-গোষ্ঠীর জন্য প্রধান পছন্দ হিসাবে (‘উপজাতি’র চেয়েও অবমাননাকরও বটে।) না কি বিদ্যমান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলার নিপীড়নমূলক চরিত্রের বিরুদ্ধে, আরও বিশেষত কর্পোরেট ও পরাশক্তির স্থানীয় প্রতিনিধিতে পরিণত হওয়া সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে- বৃহত্তর গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের অংশ হিসাবে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাবেন?

মোহাম্মদ আরজু: সাংবাদিক
                           ইমেইল: mohammadarju@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.