বইয়ে মমতা সরকারের সমালোচনা, প্রকাশককে হেনস্থা

কলকাতার এক জনপ্রিয় প্রকাশনা সংস্থা অভিযোগ করেছে যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সমালোচনা রয়েছে-এমন একটি বই ছাপার জন্য পুলিশ তাদের হেনস্থা করছে।
মুসলমানদের করণীয় নামের ওই বইটি লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা তথা সাহিত্যিক নজরুল ইসলাম।
ওই বইতে নজরুল ইসলাম বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীসহ রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা দীর্ঘদিন ধরেই মুসলমানদের উন্নয়নের নাম করে আসলে ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে ব্যবহার করেছেন।

আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত না হলেও বইটি বিক্রি করতে নিষেধ করা হয়েছে আর তাদের দপ্তরে কোনো বৈধ অনুমতিপত্র ছাড়াই তল্লাসি চালানো হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছে মিত্র ও ঘোষ নামের ওই সংস্থা।

রাজ্য পুলিশের অতিরিক্ত মহানির্দেশক নজরুল ইসলাম পুলিশের চাকরিতে যেমন অত্যন্ত সৎ ও স্পষ্টবক্তা বলে পরিচিত, তেমনই সাহিত্যিক ও গবেষক হিসাবেও তার বেশ নামডাক রয়েছে।

ওই বইটিতে রাজ্যের মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসাবে তিনি যেমন বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার বিশ্লেষণ করেছেন, তেমনই মুসলমানদের ভোট কেনার জন্য স্তোকবাক্য দেওয়ার জন্য দোষারোপ করেছেন রাজনৈতিক নেতাদের।

কিন্তু বইটির প্রকাশক সংস্থার অন্যতম কর্ণধার ইন্দ্রানী রায় জানান, তারা এই বইটি প্রকাশ করার পর থেকেই দিনকয়েক আগে থেকে তাদের ওপর পুলিশি হেনস্থা শুরু হয়।

বইটির লেখক-পুলিশ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম নিজে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। আর পুলিশের তরফ থেকেও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি।

তবে রাজ্য মন্ত্রিসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বলছেন যে ওই বইটি প্রচারিত হলে হিন্দু-মুসলমানদের সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার যেমন আশঙ্কা রয়েছে, তেমনই উত্তেজনাও তৈরি হতে পারে।

তার বক্তব্য, রাজ্য সরকার এমন কোনো কিছু সহ্য করবে না, যার ফলে সম্প্রীতি নষ্ট হয়। তার কথায়, “কথা বলার অধিকার মানে তো সম্প্রীতি নষ্ট করার অধিকার নয়।”

তবে প্রকাশনা সংস্থাটির মতে ওই বইতে এমন কিছুই তারা ছাপেনি- যাতে হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতি নষ্ট হয়। প্রকাশনা সংস্থা মিত্র ও ঘোষের অন্যতম কর্ণধার মিসেস ইন্দ্রানী রায়ের কথায়,  “রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমালোচনা করার ফলেই তারা চটে গিয়ে পুলিশ দিয়ে আমাদের হয়রানি করাচ্ছে।”

বইটির একটি কপি বিবিসি-র হাতে এসেছে – যার শুরুতেই বলা হয়েছে “রাজ্যে মুসলমানদের অবস্থা খুবই খারাপ। রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা মুসলমানদের উন্নতির জন্য রাতে ঘুমোতে পারছিলেন না। সম্প্রতি রাজ্যে শাসক দলের বদল হলেও মুসলমানদের অবস্থার বদল হয়নি এখনও।”

লেখক প্রশ্ন তুলেছেন মুসলমানরা শিক্ষায় পিছিয়ে আছে এই যুক্তিতে কেন একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যলয় গড়া হবে- কেন সাধারণ পঠনপাঠনের সুযোগসহ একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় গড়বে না সরকার- যেখানে মুসলিমরা সব ধরনের শিক্ষা পেতে পারেন?

রাজ্যে দশ হাজার মাদ্রাসাকে অনুমোদন দেয়ার নীতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন নজরুল ইসলাম। তিনি লিখেছেন যে রাজ্যে দশ হাজার মাদ্রাসাই নেই, উপরন্তু কোনো আর্থিক অনুদান ছাড়া ওইসব খারিজী মাদ্রাসা অনুমোদন নিয়ে কী করবে?

ইমাম ও মোয়াজ্জেনদের মাসিক ভাতা দেয়ার নীতির সমালোচনা যেমন করেছেন তিনি, তেমনই মমতা ব্যানার্জির নাম না করে একই বাক্যে খোদা হাফেজ-ইনশাল্লাহ বলা বা রোজা না রেখে, সারাদিন ভরপেট খেয়ে তারপর মাথায় কাপড় দিয়ে ইফতার করাকেও কটাক্ষ করেছেন নজরুল ইসলাম।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বলছে যে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সমালোচনার করার জন্যই পুলিশি তল্লাশি বা বই বিক্রি না করতে বলা হচ্ছে-যেটা আসলে বাকস্বাধীনতার ওপরে হস্তক্ষেপ।

প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গাঙ্গুলি বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে বলেন, নজরুল ইসলামের লেখা তিনি আগেও পড়েছেন-কিন্তু কখনওই সেই রচনাকে তার উস্কানিমূলক মনে হয়নি।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সমালোচনা করলেই যে তিনি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন, তার প্রমাণ আগেও পাওয়া গেছে।

এক জনসভায় কৃষকদের সমস্যার সমাধান কেন তিনি করতে পারছেন না-এই প্রশ্ন করায় এক কৃষককে মাওবাদী আখ্যা দিয়ে দেন তিনি আর তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন।

তার আগে কিছু কলেজ ছাত্রছাত্রী রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তাদেরও মাওবাদী সমর্থক আখ্যা দিয়ে একটি জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান ছেড়ে বেরিয়ে যান তিনি।

ওই ছাত্রছাত্রীদেরই এক শিক্ষক-অম্বিকেশ মহাপাত্রকে একটি কার্টুন ইমেলের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার দায়ে হাজতবাসও করতে হয়। সূত্র: বিবিসি।

No comments

Powered by Blogger.