আরেক আলোকে-ফ্রান্সের নেকাব ইস্যু অগ্রাহ্য করাই সঙ্গত by ইনাম আহমেদ চৌধুরী

মঙ্গলবার সকালে গলফ কোর্সে গিয়েছিলাম। উইক ডে। শেষ চৈত্রের পূর্বাহ্ন। রোদ কিছুটা তেতিয়ে উঠেছে। বেশ ফাঁকা। ভেবেছিলাম, একা একাই খেলা যাবে_ প্র্যাকটিস হবে। না, শুরু করতেই একজন বিদেশি সঙ্গী জুটে গেল। আলাপে জানালেন, তিনি একজন ইউরোপীয় ব্যবসাদার। বাড়ি স্পেনে।


কিন্তু গার্মেন্ট-সংক্রান্ত ব্যবসায় আজকাল প্রায়ই ঢাকায় যাওয়া-আসা করছেন। সম্প্রতি ঢাকাতে স্পেনের স্থায়ী দূতাবাসও হয়েছে, বেশ সক্রিয়। মধ্যবয়সী ওই ভদ্রলোক বেশ অমায়িক ও মিশুক। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তিনি কিছুটা ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করলেন_ আচ্ছা, আপনাকে একটি প্রশ্ন শুধোতে পারি? আমি ভাবলাম, নিশ্চয়ই অধ্যাপক ইউনূস ও নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে যে চরম লজ্জাকর এবং জাতীয় মর্যাদাহানির অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সে সম্পর্কে কিছু। প্রায় সব বিদেশি সরকার, বিশেষ করে ফ্রান্স ও স্পেন সরকারিভাবেই তাদের অসন্তোষ ও মনোবেদনা প্রকাশ করেছে। ভাবলাম, এ প্রসঙ্গ আলোচনা করে এই সুন্দর সবুজে আমের মুকুলের গন্ধ নিয়ে বয়ে যাওয়া ঝিরঝিরি চৈতি হাওয়াকে দুঃখ-ভারাক্রান্ত করে তুলব না। জিজ্ঞেস করলে ক্ষমা প্রার্থনা করে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাব। না, ভদ্রলোক অন্য একটি কথার অবতারণা করলেন। বললেন, ফ্রান্স যে সম্প্রতি মুসলিম মহিলাদের মুখাবরণ নিয়ে বাইরে বেরোনো আইনগত নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় করেছে, এতে আমার বা বাঙালিদের প্রতিক্রিয়া কী? যাক! ভেবে স্বস্তি পেলাম, এবার অন্য দেশের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
হ্যাঁ, সকালে কাগজেই দেখে এসেছি, ফ্রান্সে সোমবার থেকে প্রকাশ্যে বোরকা বা মুখ ঢাকা হেজাব পরা নিষিদ্ধ করে তাদের পার্লামেন্টে পাস করা আইনটি কার্যকর হয়েছে। আমি তাকে বললাম, হ্যাঁ, তবে আইনটি শুধু মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য নয়। যে কোনো মহিলাই মুখ ঢেকে ঘোরাফেরা করলে সেটা আইন নিষিদ্ধ হবে বলে আমি মনে করি। যদিও আমি আইনের কথাগুলো হুবহু পড়ে দেখিনি, তবে নিশ্চয়ই এটা কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বীর ওপর প্রযোজ্য হবে না। তবে যেহেতু কিছু কিছু মুসলিম মহিলার মধ্যে এ জাতীয় বোরকা পরার রেওয়াজ হয়েছে, সেহেতু ধারণা করা হচ্ছে যে, এটা মুসলিম মহিলাদের জন্যই প্রযোজ্য। আমি অবশ্য প্রথমে হেসে বিষয়টি লঘু করার জন্য বললাম, আমার কাছে মনে হয় আইনটি বিরাট বৈষম্যমূলক। কেননা এ আইনটি যে কোনো মানুষের জন্য প্রযোজ্য হওয়া সঙ্গত ছিল। পুরুষরা কেন বাদ যাবে। আমি পুরুষ হয়ে যদি মুখ ঢেকে ঘুরে বেড়াই, তাহলে ফ্রান্সের পুলিশ কি আমাকেও শাস্তি দেবে? প্রশ্নকর্তা হাসলেন। বললেন, আপনার কৌতুকবোধের প্রশংসনীয়। কিন্তু সত্যি বলুন তো, এ দেশে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে? কেননা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের নিষিদ্ধকরণ উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা ইতিমধ্যে সূচিত হয়েছে। তার ফলে মুসলিম দেশগুলোতে বা ইউরোপের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা বোঝা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, স্পেনের সঙ্গে আরব দেশগুলোর বহু শতাব্দীব্যাপী গভীর যোগাযোগ। সুতরাং তিনি বললেন, এ সমস্যা নিয়ে স্পেনকে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। আমরা যারা ব্যবসা করি, তাদের জন্য এ প্রশ্নের উত্তর জানা আরও গুরুত্বপূর্ণ।
ভদ্রলোক বললেন, শোনা যাচ্ছে, ফ্রান্সে কোনো কোনো মুসলমান নেতা সংগঠিত আইন অমান্য আন্দোলনের কথা চিন্তা করছেন। রেশিদ নেককাজ নামে এক ব্যবসায়ী পুলিশ আরোপিত সম্ভাব্য জরিমানা পরিশোধের জন্য প্রায় ২০ লাখ ইউরোর তহবিল জোগাড় করছেন। ওই আইনে আছে, যে কোনো নারী এ আইন ভঙ্গ করলে তাকে ১৫০ ইউরো জরিমানা করা হবে। আর যারা নারীদের বোরকা বা নেকাব পরতে বাধ্য করবে, তাদের শাস্তি হবে আরও কঠোর। তাদের অর্থদণ্ডের পরিমাণ হবে আরও বেশি। দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডও হতে পারে। ইতিমধ্যে প্যারিসে ১৯ বোরকাধারী নারীসহ ৫৯ বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কোনো কোনো প্রতিবাদকারী নটর ডেম গির্জার সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদমূলক মানববন্ধন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রতিবাদ, গ্রেফতার, বিক্ষোভ ইত্যাদি নিয়ে নানা কর্মকাণ্ড সমাজ জীবনে একটি অস্থিতিকর অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে।
আমার প্রতিক্রিয়ায় তাকে জানালাম, ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় বিষয়টি নিয়ে ধর্মীয় দিক থেকে মুসলমানদের কোনো যুদ্ধংদেহী প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা মোটেই অভিপ্রেত বা কাঙ্ক্ষিত হবে না। বস্তুতপক্ষে ইসলাম ধর্মে মুখ ঢেকে পর্দা করার কোনো বাধ্যবাধকতা আছে বলে আমি মনে করি না। আমি নিজেই জেদ্দায় ইসলামিক রিসার্চ অ্যান্ড গবেষণা কেন্দ্রের সঙ্গে দীর্ঘকাল সম্পৃক্ত ছিলাম। আমার এ অভিমত জেদ্দাতেও বিভিন্ন আলোচনায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেছি এবং লক্ষ্য করেছি যে, আমার (এবং আরও অনেকেরই) এ অভিমত যথেচ্ছ গ্রহণযোগ্য হয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন, মুখ ঢাকলে 'সওয়াব' বেশি। সওয়াব বেশি এবং গুনাহের অবকাশ কম। আমরা তখন হেসে বলেছি, জন্ম না হয়ে পৃথিবীতে না বাঁচলে তো সওয়াব-গুনাহের প্রশ্নই থাকত না। পৃথিবীতে বাঁচতে হলে আল্লাহ সৃষ্টি, নৈসর্গ, বহমান জীবনযাত্রা, আশপাশের দুনিয়া থেকে নিজেকে চিরকালের জন্য দৃষ্টির অন্তরালে নিয়ে আসার কোনো যুক্তিই নেই। ধর্মে পর্দার কথা বলা হয়েছে। তবে তাই বলে এর এ ধরনের কদর্থ করতে হবে, এর কোনো মানে নেই।
বিভিন্ন স্থান ও সমাজে বোরকা পরা নিষিদ্ধ করার এই যে ক্রমবর্ধমান প্রবণতা, এর কারণ হলো পৃথিবীতে সন্দেহ ও অবিশ্বাস বাড়ছে। বোরকা পরা মহিলা অন্যের প্রতি অবিশ্বাস, সন্দেহ ও সংশয়ের মূর্ত প্রতীক। যিনি বোরকা পরেন, তিনি আশঙ্কা করছেন যে অন্য কোনো পুরুষ কিংবা কোনো মহিলাও যদি মুখ বা চুল দেখে ফেলেন, তাহলে তিনি কুদৃষ্টি দেবেন অথবা কোনো কুমতলব ফেঁদে বসবেন। এটাও তারা হয়তো আশঙ্কা করেন, মুখ বা চুল দেখলে দর্শনকারীর মধ্যে অনভিপ্রেত উত্তেজনার সৃষ্টি হবে। এ ধরনের অন্যায় ও অবান্তর সন্দেহ বা অবিশ্বাস কোনো ভদ্র সমাজই মেনে নেবে না। দ্বিতীয়ত, মুখ ঢেকে চলাফেরা করা বা আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা কেউ নিরাপত্তামূলক কারণেও ঝুঁকিপূর্ণ মনে হতে পারে। তাছাড়া সমাজে এটা বিভাজনেরও সৃষ্টি করে। সুতরাং আমার কাছে মনে হয় যে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞামূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জাতিগত বা ধর্মগতভাবে প্রতিবাদ জানানো মোটেই সমীচীন নয়।
কেউ কেউ অবশ্য ব্যক্তিগত অধিকার বা মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলতে পারেন। এর উত্তরে এটা বলা যায় যে, সমাজের রাস্তাঘাটে অল্পস্বল্প বসনে মহিলার ঘোরাফেরা যদি নিষিদ্ধ হতে পারে, তাহলে অতিরিক্ত পরিচ্ছেদ পরিধান নিষিদ্ধ করা মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে কেন? বিশেষ করে বাঙালি মহিলাদের মধ্যে বোরকা পরার প্রচলন হ্রাস পাওয়াটাই কাম্য। আমরা যারা কর্মক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকার চাই, তাদের কাছে বোরকাবন্দি নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি না হওয়াই প্রত্যাশিত।
অবশ্য আমরা এও লক্ষ্য করেছি যে, সাম্প্রতিককালে জাতি বা ধর্মাবলম্বী হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অহেতুক বা চক্রান্তমূলকভাবে মুসলমানদের কোণঠাসা করার একটা অপচেষ্টা চলছে। সামগ্রিকভাবে সর্বক্ষেত্রে ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে এটা প্রক্ষেপণের চেষ্টা হচ্ছে যে, মুসলমান মাত্রই সন্ত্রাসী কিংবা পশ্চাদগামী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অগ্রগতি পরিপন্থী একটি সম্প্রদায়। এমনকি এটাও কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন যে, মুসলমানদের ধ্যান-ধারণা পৃথিবীর অগ্রগতির পরিপন্থী। শান্তি ও স্বস্তির জন্য তারা হুমকি। এমনকি গণতন্ত্রও তাদের মধ্যে বিকাশ লাভ করতে পারে না। এটা যে সত্যি নয়, তা সম্পূর্ণভাবে প্রমাণ করা মুসলমানদেরই কর্তব্য। যে হীন চক্রান্ত এবং ষড়যন্ত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার মুখোশ উন্মোচিত করে তাকে বিধ্বস্ত করা, অরুন্ধতী রায়ের ভাষায়, প্রত্যেক ন্যায়ধর্মী মানবতাবোধ সমন্বিত মানুষেরই কর্তব্য।
কোনো কোনো পরাশক্তি বা শক্তিধর কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মুসলমান সমাজ ও ইসলামী জীবন-দর্শনের এমন একটি বিকৃত ছবি তুলে ধরতে চায়, যা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারই তাদের অভিপ্রায়। এটা মুসলমান সমাজের নেতাদের উপলব্ধি ও বিবেচনা করতে হবে। আমার কাছে মনে হয়, ফ্রান্সে এই নেকাব বা বোরকা নিষিদ্ধকরণকে আমরা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করতে পারি। এটা তাদের স্থানীয় ইস্যু এবং কেবল ইসলাম নয়, সব ধর্মাবলম্বীর জন্য প্রযোজ্য। তাদের আইনের যৌক্তিকতা প্রদর্শনের দায়িত্ব আমাদের নয়। যদি এটাকে নিয়ে একটা আন্দোলন বা শোরগোলের চেষ্টা হয়, তা যে শুধু অফলপ্রসূ হবে তা নয়, তা জাতি বা ধর্মাবলম্বী হিসেবে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নই শুধু করবে।

ইনাম আহমেদ চৌধুরী : সাবেক সচিব ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.