আমাদের ঘুম ভাঙবে কবে by অনিরুদ্ধ সাগর

ছোটবেলা নানুর মুখে একটা গল্প শুনেছিলাম। গল্পটি হলো- অনেকদিন আগের কথা। এক দেশে ছিল এক গোয়ালা। গোয়ালার ছিল বিভিন্ন প্রজাতির কয়েকশ’ গরু। আর এই গরুগুলোকে কেন্দ্র করে গোয়ালা স্বপ্নের জাল বুনত। কারণ, গোয়ালার পৈতৃক নিবাস ছিল অজো পাড়াগাঁয়ের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

সেখানকার মানুষগুলো ছিল অত্যন্ত দরিদ্র এবং অশিক্ষিত। আর যেখানে অশিক্ষা বাসা বাঁধে সেখানে কুসংস্কার দাপিয়ে বেড়ায়। কুসংস্কারের কালো থাবায় আচ্ছন্ন সমাজ বা গোষ্ঠীর মানুষগুলোর শিক্ষা ও চেতনা ক্রমেই লোপ পায়। শিক্ষাহীন জাতি কখনোই ভাগ্যের উন্নয়ন করতে পারে না। ফলে তারা ক্রমেই ধাবিত হয় দারিদ্র থেকে দারিদ্রসীমার আরও নীচে। ক্ষুধা নিবারণের জন্য দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের যোগাড় করাটাই তাদের পক্ষে অত্যন্ত দূরূহ হয়ে দাঁড়ায়। দরিদ্রতার যাতাকলে নিষ্পেষিত অভূক্ত মানুষগুলো পুষ্টিহীনতার ফলে রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে জরাগ্রস্ত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এই জরাজীর্ণ মানুষগুলোকে বোঝা থেকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করাই ছিল গোয়ালার বাবার লক্ষ্য। তাই বিভিন্ন দেশ থেকে উন্নত প্রজাতির গরু কিনে এনে গড়ে তুলেছিলেন এই ফার্ম। গোয়ালার বাবা স্বপ্ন দেখতেন এই ফার্মটি অনেক বড় হবে এবং সেই সাথে হবে এলাকার দুস্থ অসহায় মানুষের কর্মসংস্থান। পুষ্টিহীনতার ফলে একটি মানুষও রোগে ভুগবে না। কর্মচাঞ্চল্যে মুখর নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে সচেষ্ট হবে।


 স্বপ্নপূরণের আগেই গোয়ালার বাবা তিন দিনের জ্বরে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। বাবার মৃত্যুর পর সুযোগ্য পুত্র হিসেবে গোয়ালার ফার্মটির হাল ধরে। অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে কিছু দিনের মধ্যে ফার্মের পরিধির প্রসার ঘটে। গরুর সংখ্যাও বেড়ে যায় কয়েক গুণ। সেই সাথে যুক্ত হয় কিছু তোষামোদকারী ও চাটুকারের দল। তোষামোদকারীরা মধুর মাছির মতো গোয়ালার চারপাশে সারাক্ষণই ঘ্যাঁন ঘ্যাঁন করত।

গোয়ালারকে চাটুকারদের চটকদার মিষ্টি কথার ফাঁদে ফেলতে খুব একটা সময় লাগল না। গোয়ালা চাটুকারদের শুভাকাঙ্খি ভেবে ফার্ম রক্ষণাবেক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলোতে তাদের নিয়োগ দিল। চাটুকাররা নিয়োগ পেয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে দেখল, গোয়ালা যদি প্রতিদিন ফার্মে এসে তদারকি করে তবে তাদের স্বার্থসিদ্ধি করা কিছুটা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই তারা একদিন গোয়ালাকে বলল- ‘প্রতিদিন কষ্ট করে আপনার ফার্মে আসার দরকার কি? আমরা তো রয়েছি। আপনি মালিক মহাশয়। আপনি বসে বসে আয়েশ করবেন, ঘুমোবেন আর আমাদের হুকুম দেবেন। আপনার বাবা ছিলেন আমাদের জ্যাঠামশাই। মানুষের কল্যাণ করাই ছিল তার কাজ। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যদি আপনি এতটা পরিশ্রম করতে পারেন তবে আমরা পারব না কেন?”

এহেন কথায় সরল গোয়ালা ভীষণ খুশী হয়ে গেল। এরপর থেকে সে বাড়িতে বসে আয়েশ করত আর ঘুমাত। মাসেও একবার ফার্মে যেত না। এই সুযোগে যে যার মতো পারল লুটেপুটে খাওয়া শুরু করে দিল। কিছুদিনের মধ্যে ফার্মটি ধ্বংসের মোহনায় এসে দাঁড়ল। গরুগুলো অসুস্থ হয়ে পড়ল। আর অসুস্থ গরুর দুধ কেউই কিনতে চাইল না। তাই গরুগুলোর চিকিৎসার জন্য বাধ্য হয়ে গোয়ালা সুদী কারবারীদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিল। তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। একে একে সবকটি গরু মারা গেল। নিঃস্ব গোয়ালা চাটুকারদের কাছে সাহায্য চাইল। কিন্তু কেউই তাকে সাহায্য করল না। সবাই তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। অবশেষে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পাগলপ্রায় গোয়ালা অচিন দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। যাওয়ার সময় শুধু বিড়বিড় করে বলল- ‘সেই ঘুম তো ভাঙল, কিন্তু সময় থাকতে ভাঙল না।’


এবার মূল প্রসঙ্গে আসি- সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার। তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে জনগনের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ও অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোন করে বিশ্বব্যাংক। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের এপ্রিলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের সাথে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিশ্বব্যাংকের পর একে একে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান ও ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাথেও পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য আলাদা আলাদাভাবে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।


বহুপ্রতীক্ষিত ও আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু প্রকল্প এখন একটি প্রশ্ন। ২৯০ কোটি ডলার ব্যয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ প্রকল্প- পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারের সাথে অর্থায়নের ঋণচুক্তি দুর্নীতির অভিযোগে সম্প্রতি বাতিল করেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষপর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা এবং বেসরকারি ব্যক্তিদের যোগসাজসে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। যার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য প্রমাণ বিশ্বব্যাংকের হাতে রয়েছে বলেও দাবি করেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের ভাষ্যমতে- দুর্নীতির বিষয়টি তাদের দৃষ্টিগোচর হলে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করে এবং দুর্নীতির বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে জানায়। বাংলাদেশ সরকার যথাযথ সাড়া না দেয়ায় বিশ্বব্যাংক পুনরায় ২০১২ সালের এপ্রিলে দুর্নীতির বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুদককে অবহিত করে এবং দুর্নীতির এ অভিযোগ পূর্ণাঙ্গভাবে তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের সনাক্ত করার আহবান জানায়। বিশ্বব্যাংক ভেবেছিল, বাংলাদেশ সরকার বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেবে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি। এই দুর্নীতির সাথে জড়িতদের শাস্তি প্রদানের জন্যও বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিল।

বিশ্বব্যাংকের দাবি ছিল- ১. যেসব সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের অন্যত্র সরিয়ে দেয়া। ২. অভিযোগ তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি বিশেষ তদন্ত দল নিয়োগ করা।

বাংলাদেশ সরকার তার কিছুই করেনি। এহেন পরিস্থিতিতে দুর্নীতির প্রমাণ  পেয়ে বিষয়টি নিয়ে বিশ্বব্যাংক চোখ বুজে থাকতে পারে না। তাই পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের চুক্তি বাতিল করেছে বিশ্বব্যাংক। একটি প্রকল্পে তখনই বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করতে পারে যখন সে প্রকল্পের স্বচ্ছতা এবং কার্যক্রমের পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হয়। কারণ দাতা দেশগুলোর কাছে বিশ্বব্যাংকের একটা নৈতিক দায়িত্ব আছে।


অপরদিকে পদ্মা সেতু প্রকল্পে তদারকির জন্য প্রাকযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত অন্যতম প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিন। এটি একটি কানাডীয় প্রতিষ্ঠান। কাজ পাওয়ার জন্য তারা বিশাল অংকের ঘুষ প্রদান করেছিল। বিষয়টি তদন্তের জন্য বিশ্বব্যাংক কানাডীয় সরকারের কাছে আবেদন জানায়। কানাডীয় সরকার বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্ত করে এবং দুর্নীতির প্রমাণ পায়। বিশ্বব্যাংক এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে লাভালিনের বাংলাদেশী ইউনিটের উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তদন্তে স্পষ্টভাবে প্রমাণ পাওয়া যায় লাভালিনকে কাজ পাইয়ে দিতে ঘুষ নিয়েছে কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা এবং লাভালিনের বাংলাদেশী এজেন্টরা। তারপরও বিষয়টি সুরাহা করার জন্য বিশ্বব্যাংক একটি উচ্চ পর্যায়ের দল পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের কাছে। বাংলাদেশ সরকার বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কিছুটা রদবদল করে। কিন্তু তা বিশ্বব্যাংকের মনঃপুত হয়নি। যার ফলে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।


 যেখানে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির শাখা প্রশাখাগুলো চিহ্নিত করে বাংলাদেশ সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছে বলে দাবি করছে, যেখানে কানাডীয় সরকারের তদন্তে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির চিত্র স্পষ্ট ধরা পড়েছে, সেখানে আমাদের অর্থমন্ত্রী বলছেন- ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রকৃতপক্ষে কোনো দুর্নীতি আজ পর্যন্ত হয়নি।’


 এখন প্রশ্ন- প্রকৃত সত্য কোনটি! বিশ্বব্যাংকের বিবৃতি না আমাদের অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য? যদি বিশ্বব্যাংকের বিবৃতি সত্য হয়, তবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকার কেন ব্যবস্থা নেয়নি? তার জবাবদিহিতা জনগণের কাছে সরকারকে অবশ্যই করতে হবে। কারণ, একটি গণতান্ত্রিক দেশে সকল ক্ষমতার উৎসই জনগণ। আর যদি অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য সত্য হয়, তবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতিবাজ বলে আখ্যায়িত করে একটি দেশকে কলঙ্কের কালিমায় লেপন করার কোনো এখতিয়ার বিশ্বব্যাংকের নেই। বিশ্বব্যাংক যদি সত্যি সত্যি এহেন কম্মটি করে থাকে তবে অবশ্যই বিশ্বব্যাংককে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। যদি বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ মিথ্যে হয়ে থাকে তবে, বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য বিশ্বব্যাংককে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দায়িত্ব অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারকে নিতে হবে। যেহেতু, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের আঙ্গুলটি ছিল বাংলাদেশ সরকারের দিকেই। যদিও ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের এ অপবাদের বিচার চেয়ে বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য দাতাদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। অপরদিকে, বিশ্বব্যাংককে আর অনুরোধ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রী পরিষদ। দীর্ঘ নিরবতার পর প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করলেই তো আর বিশ্বব্যাংকের দেয়া অপবাদ ঘুচবে না। একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের মুখে কালিমা মেখে দিল, আর আমরা সেই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিরবে সরে এলাম; এটা কারো কাম্য হতে পারে না।

এখন আবার সবকিছু বদলে গেল। আবুলকে বাদ দেয়া হলো। বলা হলো বিশ্বব্যাংকের দাবি মেনে এটি করা হয়েছে। তাহলে আগে কেন করা হলো না?

সেই গোয়ালার মতো আমরাও ঘুমিয়ে পড়েছি! যদি তাই হয়ে থাকে, তবে আজ বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে- ‘আমাদের ঘুম ভাঙবে কবে?’

অনিরুদ্ধ সাগর: কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। সাবেক পরিচালক, মিডিয়া সেল, বাংলাদেশ

                        মানবাধিকার কাউন্সিল। e-mail : aniruddhashagar@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.