বারাদির সঙ্গে আলাপ : যে মানুষটি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন by রবার্ট ফিস্ক

এখনকার মানুষ কে? অবশ্যই মোহাম্মদ এল বারাদি। কিন্তু তিনি জনগণের মানুষ কি না তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তিনি নিজেও তেমন দাবি করেন না। তাঁর বাড়িতে একটি ছোট কিন্তু গাঢ় নীল রঙের সুইমিং পুলের পাশে ইজিচেয়ারে এসে বসলেন। এখানেই তাঁকে মাঝেমধ্যে দেখা যায়। অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষটি।


মাথায় বেইসবল হ্যাট। চোখা নাকের ওপর ইঁদুর-চশমা। তিনি এ বর্ণনা পছন্দ করবেন না। কিন্তু তাঁকে আমার ধারালো দাঁতের ইঁদুর বলে মনে হয়।
কখনো কখনো এল বারাদিকে খুবই আশান্বিত মনে হয়। তিনি মনে করেন, মিসরের সব বড় নেতাই নির্বাসিত। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি বক্তব্য দিতে গিয়ে দেখেছেন সেখানকার বোর্ডে ১৫ জন মিসরীয় রয়েছেন। এল বারাদি বলেন, 'আমি তাঁদের বলেছি, আপনারা যদি দেশে চলে যান তাহলে আপনারাই মিসরকে পরিচালনা করবেন।'
কিন্তু বিষয়টি অত সহজ নয়। সে কথা এল বারাদি স্বীকার করে বলেন, 'এখন একটি পুরনো কাহিনী সমাপ্ত হচ্ছে। মুবারক হলেন ইসরায়েলের বন্ধু। আমরা সাধারণত মনে করি, মিসরে কোনো পরিবর্তন ইসরায়েলের প্রতি বৈরী কোনো সরকারকে দিয়ে আসবে এবং তাতে ইরানি ধরনের বিলায়েহ ফাকি (শীর্ষ ধর্মীয় নেতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত) সরকার চলে আসবে। কিন্তু আমি মনে করি, এটি একটি বিদ্যমান কল্পনা। আমাদের এই মুসলিম ব্রাদারহুড সম্পর্কে বিদ্যমান কল্পনা ত্যাগ করা প্রয়োজন। এ ভাবনা ত্যাগ করা প্রয়োজন যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে শত্রুতা শুরু হবে। প্রকৃত সত্য হলো, একটি দীর্ঘ শান্তি আসতে পারে দুটি গণতন্ত্রের মধ্যে, দুটি স্বৈরশাসকের মধ্যে নয়। মিসর গণতান্ত্রিক না স্বৈরতান্ত্রিক, সেটা কোনো কথা নয়_এ অঞ্চলের জনগণের মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসবে না।
তিনি জানান, মুবারককে যে চলে যেতে হবে সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। এ কথা আমরা সবাই বলছি। তিনি এটাও বলেন যে তিনি বিশ্বাস করেন মিসরীয় সেনাবাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে না। তবে সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আমার সন্দেহ হয় যে তিনিও আমার মতো সেনাবাহিনী সম্পর্কে পরিষ্কার নন। তিনি বলেন, 'আমি মনে করি, মিসরের সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত জনগণের সঙ্গেই থাকবে। এটি একটি সাধারণ জ্ঞানের বিষয় যে সাড়ে আট কোটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে যারা মুবারককে ঘৃণা করছে। সেনাবাহিনী জনগণেরই অংশ। দিন শেষে যখন একজন সেনাবাহিনীর সদস্য তাঁর গা থেকে পোশাকটি খুলে ফেলছেন তখন তিনি জনগণেরই একজন হয়ে যাচ্ছেন। অন্য সবার সমস্যা তাঁরও সমস্যা, অন্য সবার প্রতি দমন তাঁকেও দমন। সুতরাং আমি মনে করি, শেষ পর্যন্ত জনগণের প্রতি তারা গুলি চালাবে না। কেন তারা জনগণের প্রতি গুলি চালাবে? কী রক্ষা করতে গুলি চালাবে?'
১৯৬৭ সালে মিসরের যুদ্ধে হেরে যাওয়া নিয়ে এল বারাদি লিখেছিলেন, 'একজন সৈনিক যুদ্ধ করেন কিছু একটা ধরে রাখতে। কিন্তু ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ মিসরীয় সেনারা কিসের জন্য করেছিলেন? কিছুই পাওয়ার ছিল না। তাই তাঁদের পিছু হটতে হয়েছে।'
এই বিখ্যাত লোকটি মনে করেন, নাসের ছিলেন সবচেয়ে খারাপ একনায়ক। এল বারাদি মনে করেন, 'তিনি, এমনকি মুদি দোকানকেও জাতীয়করণ করতে চেয়েছেন।'
কিন্তু এখনো একনায়কত্বের সে ধারাই রয়ে গেছে। মাত্র কয়েক মাস আগেও তিনি ভাবতে পারেননি যে কী ঘটতে পারে। তিনি বলেন, 'কয়েক মাস আগে আমার ঘুম ভাঙল। আমি আমার ভাইকেও সে কথা বলেছি। আমি শোকসন্তপ্ত মানুষের চোখের দিকে চেয়েছি। সে চোখগুলো যেন মৃত। সেগুলো যেন মৃত আত্মা। এখন আমি জনগণকে দেখছি। তারা যেন তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। তারা এখন মুক্ত। এটা যেন একটা প্রেসার কুকারের মতো ঘটনা।'
এল বারাদিকে ব্যক্তি মুবারককে নিয়ে কথা বলার সময় বিস্ময়করভাবে নরম দেখা গেল। তাঁদের গত দুই বছর আগে শেষ দেখা হয়েছে। তিনি বলেন, 'জাতিসংঘ থেকে ফিরলে অথবা ছুটিতে এলে আমি তাঁর সঙ্গে (মুবারকের সঙ্গে) দেখা করতাম। তিনি আমাকে সবসময় উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতেন। তাঁর সঙ্গে আমার খুবই আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। সেটা ছিল আমাদের একান্ত সম্পর্ক। সেখানে কোনো আনুষ্ঠানিকতার বিষয় ছিল না। আমি তাঁকে বিভিন্ন বিষয়ে কী করা উচিত তা নিয়ে বলতাম। তাঁর আসলে এমন কোনো পরামর্শক নেই, যিনি তাঁকে সত্যিকারের ভালো পরামর্শ দিতে পারেন।'
যখন আমি তাঁকে পুলিশের লুট করার বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তখন তিনি ইঁদুরের দাঁত দেখালেন। বললেন, 'হ্যাঁ তারা করেছে। আমরা এর প্রমাণাদি দেখছি। কিছু পুলিশ তাদের ইউনিফর্ম খুলে লুটপাটে যোগ দিয়েছে। প্রত্যেকেই বলছে যে তাদের ওপর থেকে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল লুট করতে। যদি এটা সত্যি হয় তাহলে এটি একটি সিনিস্টার ধরনের অপরাধ। আমরা এগুলো খতিয়ে দেখব। কিন্তু এটা নিশ্চিত, এই লুটেরাদের একটি অংশ গোয়েন্দা পুলিশের সদস্য।'

দি ইনডিপেনডেন্ট থেকে ইষৎ সংক্ষিপ্ত
ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.