সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাজের জন্য তাকওয়া by জহির উদ্দিন বাবর

গভীর রাতে নির্জন ঘরে কেউ অবৈধ কোনো কাজ করলে কারও দেখে ফেলার আশঙ্কা হয়তো নেই। তবুও অধিকাংশ মুসলমান এ অবৈধ কাজ থেকে বিরত থাকে। রমজান মাসে দিনের বেলায় ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে কিছু খেয়ে ফেললে হয়তো কেউ দেখবে না। তবুও সাধারণত মুসলমানরা কাজটি করে না।


প্রবৃত্তির তাড়নায় কোনো অন্যায় কাজ করার জন্য তাড়িত হওয়ার পর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় সে অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকে। এসবই অন্তরে তাকওয়া বা খোদাভীতির আলামত। কারও অন্তরে স্রষ্টার প্রতি নূ্যনতম ভয়ও যদি থাকে, সে একটি অন্যায় কাজ করতে অনেক ভাববে। আর যার ভেতর তাকওয়ার বীজটি অঙ্কুরিত হয়নি, সে যখন অন্যায় কাজ করবে, তখন অপার্থিব কোনো পরিণতির কথা কল্পনাও করবে না।
সুষ্ঠু ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য ইসলাম তাকওয়ার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেছে। তাকওয়া সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, 'হে ইমানদারগণ! আল্লাহকে যে রকম ভয় করা উচিত, তাকে তোমরা ঠিক সেভাবে ভয় করতে থাকো এবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।' হজরত ওমর (রা.) তাকওয়ার অর্থ জানতে চাইলে সাহাবা হজরত উবাইদ ইবনে কাব (রা.) বলেন, কাঁটাবনের ভেতর দিয়ে চলতে গেলে যেমন সাবধান ও সতর্ক হয়ে চলতে হয়, তেমনি গুনাহ থেকে আত্মরক্ষা করে চলাকে বলে তাকওয়া। কাঁটা হলো এই ঘাত-সংঘাতময় জীবনে চলার পথে সব গোপন ও প্রকাশ্য পাপাচার। তাকওয়া হলো আল্লাহকে স্মরণ করে এগুলো পরিহার করে চলা। তাকওয়া কেবল ঠোঁটে বা হৃদয়ে বিশ্বাস হলে চলবে না। এটা হতে হবে বাস্তব কর্মভিত্তিক। আমাদের চিন্তা-চেতনায়, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায়, কৃষিতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, শিল্প-সাহিত্যে তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
কেউ কেউ মনে করেন, শিক্ষিত হলে তাকওয়া অর্জন করা যায়। কিন্তু মূলত তাকওয়া অর্জনের জন্য শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। শিক্ষা দিয়ে তাকওয়া কী তা জানা যায়; কিন্তু তা অর্জন করা যায় না। আমাদের সমাজের উঁচুশ্রেণীর মানুষ কি শিক্ষিত নয়? যদি জ্ঞান ও শিক্ষাতেই তাকওয়া অর্জিত হতো, তাহলে সমাজে কেন এত দুর্নীতি, অন্যায়, পাপাচার ও অপকর্ম? সমাজের নিম্নশ্রেণীর লোকজন যে দুর্নীতি ও অন্যায় করে, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি করে উঁচুশ্রেণীর ভদ্রবেশী লোকজন। কারও কারও ধারণা, বয়স বাড়লে তাকওয়া অর্জিত হয়। যদি তা-ই হতো, তাহলে হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনকালে কী করে বয়স্ক মা দুধের সঙ্গে পানি মেশাতে গেলে তার অল্পবয়স্ক মেয়ে তাকে পানি না মেশানোর জন্য সতর্ক করে দিয়ে বলে, 'মা, তোমার মনে কি আল্লাহর ভয় নেই? তুমি কি জানো না যে আল্লাহ গোপন ও প্রকাশ্য সব দেখেন?' এ জন্য শুধুই জ্ঞান ও শিক্ষা তাকওয়া অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয়। তাকওয়া হলো এমন এক অন্তর্মুখী শক্তিসম্পন্ন গুণ, যা সুপ্ত আত্মা ও বিবেককে জাগিয়ে তোলে। এটি অনুভবের, উপলব্ধির ও অনুধাবনের ব্যাপার। তাই এর অভাবে বাস্তব জীবনে দেখি এক অন্ধকার ও তমসাচ্ছন্ন ছবি।
নাগরিক ও সামাজিক জীবনে তাকওয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। মানুষের মনের রাজ্য নিয়ন্ত্রক তাকওয়া কারও ভেতর থাকলে সে অসদাচরণ করতে পারবে না। সে দুর্নীতি করবে না, মানুষকে ঠকাবে না, প্রতারণা করবে না, সুদ-ঘুষের বাণিজ্য করবে না, কালোবাজারির আশ্রয় নেবে না, মিথ্যা কথা বলবে না, অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে হরণ করবে না, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় আইন লঙ্ঘন করবে না। তাকওয়ার মাধ্যমে মানুষকে অন্যায়-অপকর্ম থেকে যেভাবে বিরত রাখা সম্ভব, তা আইন-প্রশাসন দিয়ে কখনও সম্ভব নয়। ইসলামের সোনালি যুগে শক্তিশালী আইন-প্রশাসন তেমন ছিল না; কিন্তু মানুষের ভেতর ছিল তাকওয়ার বীজ। ফলে তৎকালীন সমাজসভ্যতা গড়ে উঠেছিল সুখময় ও শান্তির আবাস হিসেবে। আজও একটি সুষ্ঠু, সুন্দর, সুশীল ও কাঙ্ক্ষিত সমাজের জন্য তাকওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
zahirbabor@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.