আইনের শাসন ও বাংলাদেশ by শাহনেওয়াজ বিপ্লব

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে কি না, শেয়ারবাজার আদৌ স্থিতিশীল হয়ে উঠবে কি না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আওয়ামী লীগ সরকার মেনে নেবে কি নেবে না- এ রকম বহু প্রশ্ন আছে। কিন্তু এসব প্রশ্ন ছাড়িয়ে আপাতত যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশে আইনের শাসন কোথায়? রাজধানী ঢাকার বুকে দিনদুপুরে সড়ক


ভবনের মতো জনবহুল এলাকায় দুষ্কৃতকারীরা গুলি করে পালিয়ে যাচ্ছে; ব্যাংক ডাকাতি, ব্যবসায়ী অপহরণ, সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা এবং চুরি, ছিনতাই বাড়ছে ক্রমেই। এ চিত্র যে শুধু রাজধানী ঢাকায়ই সীমাবদ্ধ তা নয়; বরং চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী, খুলনা থেকে বরিশাল, সিলেট বা বগুড়া- বাংলাদেশের যে এলাকার কথাই বলুন না কেন, সব জায়গায় একই চিত্র। সিন্ডিকেটে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য করার কোনো উপায় নেই। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ বা স্বেচ্ছাসেবক লীগের ছাড়পত্র ছাড়া টেন্ডারে অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, ১২ জুন টেন্ডারবাজি নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগ আর শ্রমিক লীগের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজধানীর রমনায় সড়ক ভবনের ভেতর এলোপাতাড়ি গোলাগুলির ঘটনায় পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
বাংলাদেশের মানুষ সর্বংসহা। ফলে এসব অবস্থায়ও তারা বিচলিত নয়। কিন্তু বাংলাদেশে আজন্ম লালিত নন, এমন কেউ বাংলাদেশের অবস্থা দেখলে, সবিস্ময়ে প্রশ্ন করতে পারেন- বাংলাদেশে কি প্রশাসন নেই? যে দেশে প্রকৃত প্রশাসন থাকে, যে প্রশাসন নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সম্যক সজাগ, সে দেশের অবস্থা এ রকম হতে পারে না। বস্তুত চেষ্টা করলে যে অপরাধ দমন সম্ভব, তার বহু নিদর্শন আছে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, বিদ্যুৎ বিতরণে উন্নতি, চট্টগ্রাম বন্দরে মালামাল ওঠানামায় দ্রুতগতি লাভসহ অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
যা হোক, প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থাকবে, বাংলাদেশে এই সংস্কৃতির জন্ম মূলত বিএনপির আমল থেকেই। দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নির্বিকার প্রয়াসে বিএনপি সরকার এবং এরশাদের সরকারও প্রশাসনকে ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার করে তুলেছিল। সেসব অপশাসনের খেসারত দিয়ে বিএনপির বদলে আওয়ামী লীগকেই জনগণ বেছে নিয়েছিল গত নির্বাচনে; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, শাসক দল বদল হলেও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার ছবিটি বদলে যায়নি। সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুকের গাড়িতে বস্তাসহ টাকা পাওয়ার কেলেঙ্কারির পর সে গাড়ির ড্রাইভার আলী আজমের খোঁজ নেই আজ বহু দিন। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন হয়েছে চার মাস হয়ে গেল, কিন্তু তাঁদের হত্যারহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়নি। ঢাকার রাস্তায় খুন হয়ে গেলেন সৌদি কূটনীতিক খালাফ আলী; কেন এবং কী কারণে, তা-ও জানা গেল না আজও। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর কোনো খোঁজখবর আজ পর্যন্ত নেই। এসব ঘটনার প্রতিটির ক্ষেত্রে প্রশাসন তদন্ত করছে, তদন্ত চলছে- এই বলে বলে সময় পার করছে।
অনেকেই বলেন, প্রশাসনিক এই নিষ্ক্রিয়তার কারণ, অপরাধীদের ধরে থানায় আনার কিছুক্ষণের মধ্যে টেলিফোন বেজে ওঠে এবং অপরাধীদের ছেড়ে দিতে হয়। অবশ্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে এ রকম ফোন আসে তা নয়; বরং কর্তব্য পালন না করতে করতে না করাটাও এখন পুলিশের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। পুলিশের এই দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বা তাঁর হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর। কিন্তু সাগর-রুনি খুনের ঘটনার পর যখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, বেডরুম পাহারা দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয় অথবা সাংবাদিকদের ওপর পুলিশি আক্রমণের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যখন সাংবাদিকদের পরামর্শ দেন পুলিশ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য; সে ক্ষেত্রে পুলিশ কেন অহেতুক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তৎপর হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
তবে একটি কথা, বাংলাদেশ এখন যে পথে চলছে, তাতে তার গন্তব্যে পৌঁছতে বেশি সময় লাগবে না। জলবায়ু বিপর্যয়ের মারাত্মক শিকার হয়ে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে আমাদের ছোট্ট দ্বীপদেশ বাংলাদেশ একবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। কিন্তু জলবায়ু বিপর্যয়ের আগেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বেপরোয়া দুর্নীতির মাধ্যমে আমরা নিজেরাই নিজেদের দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। একদিন হয়তো পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ছাত্রছাত্রীরা পাঠ্যপুস্তকে পড়বে, পৃথিবীতে বাংলাদেশ বলে একটা দেশ ছিল, বেপরোয়া দুর্নীতি আর প্রশাসনহীনতায় আক্রান্ত হয়ে একবিংশ শতকে দেশটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

লেখক : গল্পকার, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত।
shahnewazbiplob@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.