অনিশ্চয়তায় রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র by অরুণ কর্মকার

বাগেরহাট জেলার রামপালে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফলে বর্তমান সরকারের মেয়াদে কেন্দ্রটি চালু হওয়া তো দূরের কথা, স্থাপনের কাজ শুরু হবে কি না সে বিষয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে।


বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, আমদানির জন্য কয়লার দীর্ঘকালীন উৎস খুঁজে পাওয়া, সেই কয়লা আনার জন্য সমুদ্রমোহনার আকরাম পয়েন্ট থেকে প্রকল্প এলাকা পর্যন্ত প্রথমে ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও পরে প্রতিনিয়ত নদী খননের প্রয়োজনীয়তা, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার ক্রমবর্ধমান দাম প্রভৃতি এই অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।
বিদেশে কয়লার উৎস সন্ধান ও পরিবহন প্রসঙ্গে প্রকল্পের দেশীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) সম্প্রতি প্রতিবেদন দেওয়ার পর এই অনিশ্চয়তাগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়।
এ ছাড়া কেন্দ্রটি স্থাপনের জন্য অর্থায়ন ও যৌথ ব্যবস্থাপনার ধরন নিয়েও এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) মধ্যে মতৈক্য হয়নি। এমনকি, দুই দেশের এই দুটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে এখন পর্যন্ত যৌথ কোম্পানি গঠনের কাজও সম্পন্ন হয়নি।
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে পারস্পরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। তারপর এই সহযোগিতার ক্ষেত্র চিহ্নিত করে ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি এবং পিডিবি-এনটিপিসির যৌথ উদ্যোগে রামপালে ওই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এখন কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটি স্থাপন যেমন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, তেমনি বিদ্যুৎ আমদানির প্রক্রিয়াও বিলম্বিত হচ্ছে।
কয়লার উৎস ও দাম: মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সিইজিআইএসের প্রতিবেদনে কয়লার তিনটি উৎসের কথা বলা হয়েছে—ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া। এর যেকোনো উৎস থেকে কয়লা আনার জন্য দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতে হবে।
প্রতিবেদন বলা হয়, সুন্দরবনের কাছাকাছি হওয়ায় রামপালে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এমন মানের কয়লা ব্যবহার করতে হবে, যার প্রতি কেজির তাপমান পাঁচ হাজার ৮০০ থেকে ছয় হাজার কিলোক্যালরি। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ায় যে কয়লা পাওয়া যাবে তার প্রতি কেজির তাপমান পাঁচ হাজার ১০০ থেকে পাঁচ হাজার ৭০০ কিলোক্যালরি। অপর দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার প্রতি কেজি কয়লায় পাঁচ হাজার ৮০০ থেকে ছয় হাজার ৩০০ কিলোক্যালরি তাপমানের কয়লা পাওয়া যাবে। এই দুই মানের কয়লা এনে তা একত্রে মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইন্দোনেশিয়ার কয়লার প্রতি টনের দাম বর্তমানে ১৪৫ মার্কিন ডলার। আনার খরচ পড়বে প্রতি টনে প্রায় ২৭ ডলার। দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার কয়লার দাম ১৬০ ডলারের কাছাকাছি। আনার খরচ পড়বে প্রতি টনে প্রায় ৩৯ ডলার।
পরিবহন পদ্ধতি: খরচ অপেক্ষাকৃত কম রাখার জন্য ৮০ হাজার মেট্রিক টনের জাহাজে করে কয়লা আমদানি করার কথা বলা হয়েছে সিইজিআইএসের প্রতিবেদনে। কিন্তু এই মাপের জাহাজ সমুদ্রমোহনার আকরাম পয়েন্ট (মংলা বন্দরের জেটি থেকে ৪৪ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণে) আনতে হলেও কিছুটা খননকাজ করতে হবে। কারণ, আকরাম পয়েন্টের দক্ষিণেও সমুদ্রের তলদেশ ভরাট হয়ে জেগে উঠেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই স্থান খনন করে ৮০ হাজার মেট্রিক টনের জাহাজ আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত এনে সেখান থেকে ছোট ছোট জাহাজে (পাঁচ থেকে ১০ হাজার টন) প্রকল্প এলাকায় আনতে হবে। তবে এ জন্যও জোয়ার কাজে লাগাতে হবে। কারণ, বর্তমানে মংলা বন্দর এলাকায় পানির যে গভীরতা, তাতে যেকোনো সময় ১০ হাজার টনের জাহাজ কোনো পথেই সেখানে আসতে পারে না।
খনন প্রসঙ্গ: উপরিউক্ত পদ্ধতিতে কয়লা আনার জন্য সিইজিআইএস খননের যে প্রয়োজনীয়তার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, তার দুটি অংশ রয়েছে। প্রথমত, ক্যাপিটাল ড্রেজিং বা মৌলিক খনন। এ জন্য সাড়ে ১০ কোটি (১১৫ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার দরকার হবে। এ ছাড়া কয়লা পরিবহনের পথে প্রতিনিয়ত রক্ষণাবেক্ষণ খনন চালাতে হবে। এই কাজে প্রতিবছর ব্যয় হবে তিন কোটি (৩০ মিলিয়ন) ডলার। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যত দিন চলবে বা যত দিন কয়লা আমদানি করতে হবে তত দিন এই ব্যয় চালিয়ে যেতে হবে।
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, খননের বিষয়টি শুধু ব্যয়সাপেক্ষ নয়, সময়সাপেক্ষও। প্রতিবেদনে যে ধরনের খননের কথা বলা হয়েছে, প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে সে ধরনের খনন শুরু করতেই হয়তো পাঁচ বছর লেগে যেতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.