অবশেষে বিষ পান করলেন তাঁরা by ফখরে আলম ও বাবুল আকতার

এই বিলই তাঁদের জীবন, তাঁদের জীবিকার উৎস। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। এই বিলে যখন আঘাত আসে, তখন জীবনকেও যে তুচ্ছ মনে হয়। তাই হাতে বিষ, মুখে 'জান দেব, তবু বিল দেব না' স্লোগান নিয়ে তাঁরা আত্মহনন কর্মসূচি পালন করলেন। এ সময় তিনজন কিছু পরিমাণ বিষ পানও করেন।


যশোরের ভবদহ এলাকার বিল কপালিয়ার জোয়ার-আধার প্রকল্প (টিআরএম-টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) বাতিল, ২ জুনের সহিংস ঘটনায় আটককৃতদের মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার করা না হলে আত্মঘাতী হওয়ার কর্মসূচি আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল। তাতে সাড়া দিয়ে প্রান্তিক আয়ের শত শত নারী-পুরুষ গতকাল বিষের বোতল হাতে নিয়ে জড়ো হন। এ কর্মসূচিতে নড়েচড়ে বসে প্রশাসনও। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে জেলা প্রশাসক ছুটে যান ঘটনাস্থলে। দেন সমাধানের আশ্বাস। শেষ পর্যন্ত বিক্ষোভ সমাবেশ ও তিনজনের বিষপানের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শেষ হয়।
গত ২ জুন বিল কপালিয়া এলাকায় জোয়ার-আধার প্রকল্পের কাজ উদ্বোধনের সময় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী হুইপ অধ্যক্ষ শেখ আবদুল ওহাবসহ সরকারি কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করে। পুড়িয়ে দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৯টি গাড়ি। এ ঘটনায় হাজার হাজার মানুষকে আসামি করে দুটি মামলা দায়ের করা হয়। এই মামলায় জামিন নিতে ঢাকায় গেলে ছয়জনকে আটক করা হয়। এতে এলাকাবাসী আরো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য গত শনিবার মনিরামপুর উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বি এম মহিতুজ্জামান এলাকায় মাইকে ঘোষণা দেন, 'হুইপ এলাকাবাসীর সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।' এ খবর প্রচারিত হওয়ায় বিল কপালিয়া এলাকার মানুষ লাঠিসোঁটা, বিষের বোতল নিয়ে গত রবিবার সকাল থেকে মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয়। হুমকি দেয় গণ-আত্মহননের। ফলে হুইপের পূর্বনির্ধারিত মতবিনিময় সভা স্থগিত হয়ে যায়।
গতকাল সোমবার সকাল থেকে বিল কপালিয়ার পারে শত শত নারী-পুরুষ ফের ওই সব দাবি আদায়ের জন্য বিষের বোতল হাতে নিয়ে জড়ো হন। দুপুরে পাচাকড়ি গ্রামের মকছেদ সরদার (৭০), বালিদহ গ্রামের আমীর আলী (৬৫) ও জিয়াউর রহমান (৪০) বিষ পান করেন। তাঁদের বালিদাহ গ্রামের পল্লী চিকিৎসক আবদুল আজিজের কাছে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর মধ্যে জিয়াউর রহমানের অবস্থা তুলনামূলক ঝুঁকিপূর্ণ।
২ জুনের সহিংস ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার ২ নম্বর আসামি হুইপের সভা আহ্বানকারী মনিরামপুরের মনোহরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বি এম মহিতুজ্জামান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, '২ তারিখের ঘটনায় আমাকেসহ এক হাজার গ্রামবাসীকে আসামি করা হয়েছে। গ্রামের মানুষ রাতে নিজ বাড়িতে ঘুমাতে পারছে না। আমি অসহায় গ্রামবাসীকে শান্ত করার জন্য হুইপকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তিনি আসতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু দালালচক্রের কারণে তিনি আসতে পারেননি। কপালিয়ার মানুষ যে দাবি করছে, আমারও সেই দাবি। আমি চাই জনগণের মতামত নিয়ে জোয়ার-আধার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হোক। দূর করা হোক হয়রানি।'
মনোহরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আত্মহনন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বলেন, 'টিআরএমের নামে সরকারের লোকজন লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। নামমাত্র টিআরএম করা হবে।' বিষের বোতল হাতে পাচাকড়ি গ্রামের ডলি বেগম বলেন, 'আমার এক বিঘা জমি বিল কপালিয়ায় রয়েছে। টিআরএমের নামে ওই জমির সর্বনাশ করা হবে। এ কারণে আমি বিষ খেয়ে মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।' বিল কপালিয়া রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক আবদুল কাদের সর্দার বলেন, 'আমরা জান দেব, কিন্তু কপালিয়া বিলে টিআরএম করতে দেব না।' তিনি আটককৃতদের মুক্তি ও গ্রামবাসীর নামে মামলা তুলে নেওয়ার দাবি জানান।
এ ব্যাপারে মোবাইল ফোনে দুই দফা যোগাযোগ করা হলে হুইপ আবদুল ওহাব ফোন ধরেননি। জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'আমি বিল কপালিয়া এলাকার মানুষের দাবির কথা শুনেছি। সরকারের কাছে এই দাবিগুলো পৌঁছে দেওয়া হবে। সমঝোতার জন্য আমি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব।'
এলাকাবাসীর কঠোর অবস্থানের ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে জোয়ার-আধার প্রকল্পটি। দেখা দিয়েছে আবারও জলাবদ্ধতার আশঙ্কা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের মনিরামপুরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, 'ভবদহ জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প' নামের ৭৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ২০০৫-০৬ সালে নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৫৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে বিল কপালিয়ায় জোয়ার-আধার প্রকল্প বাস্তবায়িত করা হলে জলাবদ্ধতা দূর হবে। তিনি বলেন, কিছু ঘের মালিক এই প্রকল্পের বাদ সাধছে। পুলিশ প্রশাসনেরও সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। জোয়ার-আধার নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়েছে। প্রকল্পের সময়ও শেষ হয়ে গেছে। প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানোর জন্য প্ল্যানিং কমিশনের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.