স্মরণ-সত্য যে কঠিন by বিপ্লব বালা

মনে পড়ে, কলকাতায় পড়াশোনাকালে, সত্তরের দশকের শেষ দিকে ‘বহুরূপী’র নাটক ইবসেনের দশচক্র দেখেছিলাম; নাটকে সংশপ্তক ডাক্তারের ভূমিকায় মহানট শম্ভু মিত্র শেষ দিকে তাঁর স্ত্রীকে বলেন, ‘আমার সন্তানেরা তার বাবার পরিচয় দিতে যেন লজ্জা না পায়—এইটুকু তো করতেই হবে আমাকে।’


তা শুনে চোখ জ্বালা করে এমন জল ঝরেছিল, ঢোঁক গিলতে কষ্ট হয়েছিল! ইঁচড়ে পাকা কৈশোর থেকেই তো বাবার সমালোচনায় মুখর ছিলাম, নতুন দাঁত গজানো বামপন্থী রোখে আওয়ামী রাজনীতির বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদে বিরক্ত হতাম। ষাটের দশকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী তো কমই ছিল। প্রায়ই তো আমাদের ফরিদপুরের বাড়ির বৈঠকখানার বড় টেবিলটা দলের সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দীন মোল্লার ছেলে ছাত্রলীগের নেতা রুমি ভাই আর কাউকে কাউকে দিয়ে নিয়ে যেতেন অম্বিকা হলে মিটিং করতে। ঊনসত্তরের পরে দলে কর্মী জুটতে থাকে। তারপর সত্তরের নির্বাচনের সময় থেকে অনেক নেতা-কর্মী বাড়তে থাকে। এদের প্রতি খুব একটা সম্মান-শ্রদ্ধাবোধ করিনি হয়তো বামপন্থী হঠকারিতায়। তবু তার মধ্যে একটা আবেগের সততা চোখে পড়ত, আবদুল হাইয়ের মাইকিংয়ে কান খাড়া করতেই হতো, ‘ভাইসব, আগামী অমুক তারিখে, বঙ্গশার্দূল সাত কোটি মানুষের নয়নের মণি বঙ্গবন্ধু অম্বিকা ময়দানে...।’ আমার বাবা গৌরচন্দ্র বালা এদের মধ্যে বেশ একটা শ্রদ্ধা-সমীহের জায়গায় ছিলেন, যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী ছিলেন বলেও হয়তো। যেখানে গিয়েছি বাবার নাম শুনলে খাতির করত সবাই। তা ভালোই লাগত, তবু ঠিক ততটা মনের থেকে নিতে পারতাম না মানুষের সেই প্রীতি-ভালোবাসা। নাম-কাম-ক্ষমতার প্রতি চিরকালই তো মানুষের লোক-দেখানো ভান থাকে।
স্বাধীনতার পর ক্ষমতা-রাজনীতির আসল মাজেজা বেরোতে থাকে। কত যে হঠাৎ গজানো নেতা-পাতিনেতা-উপনেতায় গিজগিজ শহর, মুক্তিযোদ্ধায় কিলবিল—কী তাদের দাপট! পুরোনো নেতা-কর্মীরা এই ধুন্ধুমারে ছিটকে পড়ে কে কোথায়!
নতুন নেতা হওয়ার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শুরু হয়। আরও অনেকের মতো বাবাও ক্রমে কোণঠাসা হতে থাকেন, অথচ তিনি ছিলেন তো জাতীয় পর্যায়ের নেতাই। আওয়ামী লীগের ১০ সদস্যের নমিনেশন বোর্ডের সদস্য, মুক্তিযুদ্ধকালে দক্ষিণ-পশ্চিম বেসামরিক জোনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠজন। তাতে কী! স্বাধীন ক্ষমতাবাজির অকালে কোনো কাজেরই কোনো মানে থাকে না। আর আজ তো দলের পুরোনো নেতা-কর্মী হওয়াই সবচেয়ে বড় অযোগ্যতার বিষয়।
বাবাকে নিয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় গর্ব হলো: সম্ভবত তিনিই আওয়ামী লীগের একমাত্র নেতা, যিনি কোনো দিন মুজিব কোট পাজামা-পাঞ্জাবি পরেননি। সহজ যুক্তি ছিল তাঁর: ‘চেনা বামনের পইতা লাগে না।’ আরেকটা বিষয় নিয়েও গৌরব করা যায়: তিনিই বোধ হয় একমাত্র প্রবীণ নেতা, যাঁর নামে শহরে কিছুই নেই, কোনো রাস্তার নামকরণও নয়: বেশির ভাগ রাস্তা কাদের নামে নামকরণ হয়েছে, তা তো শহরবাসী ভালোই জানেন।
শুনেছি, ষাটের দশকে পাকিস্তানের মন্ত্রী ওয়াহিদুজ্জামান মারফত বাবার কাছে আইয়ুবী মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব আসে; মাকে জানালে মা-ও ঘোর প্রতিবাদ জানান: ‘কী দরকার দলত্যাগ করে মন্ত্রী হওয়ার, তুমি প্রথম থেকে আওয়ামী লীগ করো, শেখ মুজিব কত ভরসা করেন তোমার ওপর।’ শত অভাবেও তাঁকে টলানো যায়নি তখন। বঙ্গবন্ধু সত্তরের নির্বাচনের পর প্রাদেশিক পরিষদের প্রাথমিক মন্ত্রিসভার কথা ভাবছিলেন। বাবাকে বলেছিলেন, ‘বালা, তুমি প্রাদেশিক সরকারের ডেপুটি চিফ মিনিস্টার হবা, মনসুর আলী চিফ মিনিস্টার।’ সেই তিনি কিনা স্বাধীনতার পর কোনো মন্ত্রিসভার সদস্য হতে পারলেন না! তিয়াত্তরের নির্বাচনে তাঁকে হারানোয় জোট বাঁধে একদল মন্ত্রী-মন্ত্রিত্বপ্রত্যাশী। বঙ্গবন্ধু সব জানতেনও। নির্বাচনের আগে তাই বুঝি তিনি বাবাকে বিদেশে রাষ্ট্রদূত হতে বলেন। বাবা রাজি হননি দেশ ছেড়ে যেতে। সেই যে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই স্বাদ ভুলতে পারেননি। আওয়ামী লীগে তাঁর মন্ত্রিত্ব সবাই প্রাপ্য মনেও করতেন। কিন্তু ক্ষমতা-রাজনীতির ছলের বলে হার হয় তাঁর। আর তারই প্রক্রিয়ায় মন্ত্রী হওয়ার এক খ্যাপামিতে পেয়ে বসে তাঁকে।
পঁচাত্তর-পরবর্তী একের পর এক ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিতে থাকেন তিনি। আমাদের কোনো বাধায় তাঁকে ফেরানো যায় না। যে বাবাকে নিয়ে ছিল গৌরবগর্ব, তাঁর এই অধঃপতনে কারও কাছে মুখ দেখাতে পারতাম না যেন একদিন। পঁচাত্তরের পর কলকাতায় রবীন্দ্রভারতীতে পড়াকালেই দেখেছিলাম দশচক্র নাটকে একলা-হয়ে-যাওয়া এক বাবার প্রাণপণ রোখ: ‘তার সন্তান যেন পিতার পরিচয় দিতে লজ্জা না পায়।’ আর তাতেই অমন আর্ত হাহাকার জেগেছিল। শিল্পের অপার পরাক্রম সেই প্রথম অত প্রবল আঘাতে টের পেয়েছিলাম।
পরে বুঝেছি, ‘কাকে দোষ দেবে বল/ জীবনেরই দোষ/ কমবেশি সেও দায়ী।’ বাস্তব জীবনে ব্যক্তির জয়-পরাজয় এক সমগ্রতায়ই মেলে, কোনো হারই তো আর ব্যক্তিগত মাত্র নয় ‘দলে দলে শিকারি শিকার মানুষের এই ভয়াল জঙ্গলে’। সবই তো ক্ষমতা-রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি। কোনো সরল বানানো নীতিকথায় তাই তল মেলে না, ‘কঠিনে সহজ খুঁজি/ কঠিন সহজ।’
বাংলাদেশের স্বপ্নকল্পনা, নীতি-আদর্শ সবই তো ক্ষমতার রাজনীতির স্লোগানই মাত্র হয়েছে। ভোটের রাজনীতির জন্যই কেবল তার চাহিদা। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একবারই মাত্র উচ্চারণ করেছিলেন মৌল এক সত্য; ধুরন্ধর সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘সংখ্যালঘুর অবস্থান? বাঙালির স্বাধীন দেশে অবাঙালি সংখ্যালঘুদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।’ সেই নীতির কোনো প্রয়োগ-চেষ্টা তো হয়নি, কেউ তো সেটা বিশ্বাস করেনি মনেপ্রাণে। ধর্মনিরপেক্ষ দেশেও সংখ্যালঘু বলতে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানই বোঝায়। তাদের ঐক্য পরিষদ করতে হয় আলাদা করে। এই কি বাঙালির স্বাধীন দেশ!
গতকাল ১৮ জুন ছিল বাবার মৃত্যুদিন। তাঁকে স্মরণ করি, সব ক্ষোভ-অভিযোগ-অভিমান ভুলে গিয়ে।
‘ওরে ভাই, কার নিন্দা করো তুমি? মাথা করো নত/ এ আমার এ তোমার পাপ।’
বিপ্লব বালা

No comments

Powered by Blogger.