এই দিনে-এক মে দিবস থেকে আরেক মে দিবসে... by শারমিন নাহার

সকাল ১০টা। বৈশাখের সকাল, তাই রোদের তেজ খানিকটা বেশি। সবে বাস থেকে নেমেছি নগরের নতুন বাজারের বাসস্ট্যান্ডে। বাসস্ট্যান্ডের ফুটওভারব্রিজের নিচে বসে আছেন জনা পঁচিশেক মানুষ। সবার সামনেই ঝুড়ি আর কোদাল। যদিও এই ঝুড়ি, এই কোদালের মালিক তাঁরা, তবু তাঁরা অপেক্ষা করছেন কাজের জন্য।


কিছু সময় বাদে ঠিকাদারেরা এখান থেকে লোক বেছে নিয়ে যাবেন। তাঁদের মাঝে বিরস মুখে বসে আছেন কাদের আলী। বয়স প্রায় ষাটের ঘর ছুঁয়েছে। কাদের আলীর কাছে প্রশ্ন করি, কিসের অপেক্ষা করছেন? কাদের আলীর উত্তর, ‘কামের লাইগা বইসা আছি।’
এবার কিছুটা আবেগ এসে ভর করে তাঁর কণ্ঠে, ‘বয়স বেশি, তাই লেবারের কাম বেশি পাই না। মেলা দিনই খালি হাতে বাড়ি যাই।’
পয়লা মে দিবসটা কীভাবে এল বলতে পারেন?
প্রশ্ন শুনে কাদের আলীর ঝাপসা চোখ আরও ঝাপসা হয়ে আসে। মাথা নিচু করে পা দিয়ে মাটি খুঁড়তে থাকেন কাদের আলী। মে দিবস কী, জানার প্রয়োজন বোধ করেন না তিনি। যেখানে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলেই শুধু কাজের সুযোগ মেলে, সেখানে আলাদা করে মে দিবস কী তা জানার প্রয়োজন বোধ করেন না কাদের আলীর মতো বৃদ্ধ শ্রমিক।
রহমত মিয়া রিকশাচালক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা মূলত তাঁর বিচরণক্ষেত্র। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও আজিমপুর আর লালবাগ এলাকায় রিকশা চালান তিনি। দুপুর ১২টা বাজতেই মধ্যগগণের সূর্য তার সবটুকু ক্ষমতাই দেখাচ্ছে। কাঁধের গামছাটা দিয়ে মুখটা মুছে নেন রহমত নিয়া। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল থেকে রিকশা ঠিক করি কলাভবন পর্যন্ত। দূরত্ব খুব বেশি নয়। কিছু কথা সেরেই রহমত মিয়াকে প্রশ্ন করি, মে দিবস কী, জানেন?
রহমত মিয়া বলেন, ‘মে দিবস সরকারি ছুডির দিন। তাতে আমার কী? আমি তো সরকারি কাম করি না। তাই আমার কোনো ছুডি নাই। তয় বারে বারে হরতাল হওনে রিশকা চালাইতে আরাম। তয় হরতালের মইদ্যে প্রেত্যেক দিন তো আর গ্যারেজ থেইকা রিকশা বাইর করি না। তাই ছুডি পাই মাঝে মাঝে।’
কুমিল্লা থেকে জীবিকার তাগিদে এই ব্যস্ত নগরে আবাস গেড়েছেন আবুল হাশেম। রাজধানীর একটি এলাকায় পড়ন্ত বিকেলে তাঁকে ইট ভাঙতে দেখা যায়। সাবধানতার জন্য হাতে মোটা প্লাস্টিক বাঁধা। ইতিমধ্যে এই বৃদ্ধের একটা আঙুল থেতলে গেছে। থেতলে যাওয়া আঙুলটা ময়লা একটা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়েছেন। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, কয়টা থেকে এইখানে ইট ভাঙেন?
প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারলেন না তিনি। আবার প্রশ্ন করতেই উত্তর, ‘সময়ের কি হিসাব আছেনি? সক্কাল বেলার তইন ভাঙা আরম্ভ করি, চলে সইন্ধ্যা তামাত।’
দিন শেষে মুজুরি?
‘বিয়াল বেলা তামাতি কাম করলি দেয় ১২০ টেয়া। আর সইন্ধ্যা হইলে দেয় ১৫০ টেয়া। তাতে তো কিছুই হয় না। ঘরে বউ আর ছয় পোলা-মাইয়ে। সংসার তো চলে না।’ বলেন আবুল হাশেম।
পাশেই ইট ভাঙছিলেন বৃদ্ধা আয়েশা বেগম। তাঁকে প্রশ্ন করি, ‘আপনি কয়টা থেকে কাজ শুরু করেন?’
আয়েশা বেগমের উত্তর, ‘আমি বেডি মানুষ, আমারে এই কাম দিতে চায় না। যহন কাম দেয় তহন টাইমের হিসাব নাই। কাম পাওনই বড় কথা। তয় চেষ্টা থাকে দিনে ১০০টা ভাঙার।’
তাঁদের কাছে প্রশ্ন, মে দিবসে কাজ করবেন?
দুজনই কিছুটা অবাক। আবুল হাশেম বলেন, ‘কেন করতাম না! না কইরলে পোলাপাইনরে খাওয়াইতাম কী?’
বুঝতে পারি, মে দিবসের মানে তাঁরা জানেন না। জেনেই বা তাঁদের লাভ কী। যেখানে কাজ মেলাই অনিশ্চিত, যেখানে একটা দিন কাজ না করা মানেই অভুক্ত থাকা, সেখানে কোনো মহান দিনের কোনো মহান তাৎপর্য নেই।
অথচ মে দিবস খুব বেশি সময় আগের ঘটনা নয়। ১৮৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকেরা দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি আদায়ে সোচ্চার হন। এর পরিণতি ছিল ভয়াবহ। প্রাণ দিতে হয় অনেক শ্রমিককে। এ ঘটনার কথা পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। একটা সময় আট ঘণ্টা কর্মদিবস আর বাঁচার মতো মজুরি হয়ে ওঠে শ্রমিকের বৈশ্বিক দাবি। ১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৮৯০ সাল থেকেই তা বিশ্বের নানা দেশে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
মে দিবসে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আর সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। তবে যাঁদের জন্য এই দিন, সেই দিনমজুর কাদের আলী, রহমত মিয়া, আবুল হাশেম কিংবা আয়েশা বেগম ঠিকই কাজের সন্ধানে ঘর থেকে পা বাড়াবেন, আরেক অনিশ্চিত দিনের উদ্দেশে, এক মে দিবস থেকে আরেক মে দিবসে...
শারমিন নাহার

No comments

Powered by Blogger.