বিশেষ সাক্ষাত্কার-সরকারকে শর্তহীন তহবিলপাওয়ার জন্যকাজ করতে হবে by আইনুন নিশাত

ড. আইনুন নিশাত আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ইউনিয়নের (আইইউসিএন) জ্যেষ্ঠ জলবায়ু উপদেষ্টা। সম্প্রতি কোপেনহেগেনে জলবায়ু সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে সংলাপ চালান। তিনি বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং অর্ডার প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।


গঙ্গার পানি চুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সরকারের কর্মপরিকল্পনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছেন। দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানিসম্পদ কৌশল বিভাগে। ১৯৮১ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরকৌশলে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। দীর্ঘ সময় ধরে পানিসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা, নদী-ব্যবস্থাপনা ও নদী-শাসন, উপকূলীয় অঞ্চল ও জলাভূমি সংরক্ষণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়েসক্রিয় রয়েছেন।
সাক্ষাত্কার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ

প্রথম আলো  সম্প্রতি কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের অর্জন ও ব্যর্থতার বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আইনুন নিশাত  জলবায়ু নিয়ে আলোচনায় গোড়ায় দুটো দিক ছিল। ১৯৯২ সালে উন্নত দেশগুলো মেনে নিল যে, তারাই মূলত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে। তখন থেকে দুটো ধারায় কাজ হয়েছে। একটি হলো, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো অর্থাত্ মিটিগেশন। অন্যটি হলো, বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া ও ক্ষতি মোকাবিলার কৌশল অর্থাত্ অ্যাডাপটেশন। কোপেনহেগেনের সাফল্য হচ্ছে—এখানে বলা হলো, মিটিগেশন ও অ্যাডাপটেশন উভয়কেই সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। ১৯৯৭ সালে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক কিয়োটো প্রটোকল করা হয়। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাদে উন্নত দেশগুলো তাদের দায় মেনে নিয়ে ২০১২ সালের মধ্যে ১৯৯০ সালের তুলনায় গ্যাস নিঃসরণ ৫ শতাংশ কমানোর অঙ্গীকার করে। কিন্তু স্বাক্ষরকারী দেশগুলো যেখানে সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে, সেখানে আইনি বাধ্যবাধকতার বাইরে রয়ে যাওয়া দেশ, তথা যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো করে ৭০ শতাংশ। পরে এদের কার্বন উদিগরণের হার আরও বাড়ে।
কোপেনহেগেনের দ্বিতীয় সাফল্য হলো—উন্নত দেশগুলো বলবে, ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কত শতাংশ কমাবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোও স্বেচ্ছায় জানাবে, তারা কত কমাবে। অনুন্নত দেশগুলো বলবে, যতখানি প্রযুক্তি ও অর্থায়ন তারা পাবে, সেই অনুপাতে তারাও গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাবে। অনুন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে আমরা বলেছিলাম, পরবর্তী অঙ্গীকারের সাল ২০১৮ হোক, কিন্তু চূড়ান্তভাবে সেটাকে ২০২০ সাল করা হয়েছে। এটাও এক বিরাট সাফল্য। তৃতীয় বিষয় হচ্ছে—আমরা বলেছিলাম, কার্বন নিঃসরণ ৪৫ শতাংশ কমাতে হবে। চূড়ান্তভাবে সেটা কত হবে, তা ঠিক হবে ২০১০ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে।
প্রথম আলো  কিন্তু বিশ্বের তাপমাত্রা কমানোর ব্যবস্থা নেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতাসম্পন্ন চুক্তি হয়নি। তাহলে সাফল্য কোথায়? অন্যদিকে ভারত-চীন নির্দিষ্ট অঙ্গীকার করেনি, যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারও নগণ্য।
আইনুন নিশাত  আমি আপনার সঙ্গে একমত যে, তারা বাধ্যবাধকতায় আসেনি। আইনি প্রক্রিয়া তো ২০১০ সালের পরেও হতে পারে। আসল কথা হচ্ছে, তারা দায় স্বীকার করেছে এবং অঙ্গীকারও করেছে। কেবল তো শুরু। ১৯৯৭ সাল থেকে কোপেনহেগেনে আসতে কত বছর লাগল? কোপেনহেগেনের দাবিও পূর্ণ হতে সময় লাগবে। তারপর কোপেনহেগেনে সই করলেও তো দেশে এসে অনুস্বাক্ষর করতে হতো। সেটা করতেও তো অনেক সময় লেগে যাওয়ার কথা। কিয়োটো প্রটোকল হওয়ার পরও সাত বছর লেগেছে অনুস্বাক্ষর হতে।
প্রথম আলো  ১৯৯০ সালের নিরিখে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকমানোর ঘোষিত সীমা তো মাত্র ৩-৪ শতাংশ, যেখানে কমানোর দাবি ছিল ৩০-৪০ শতাংশ।
আইনুন নিশাত: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে তারা ৮০ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, কিসের নিরিখে কমাবে? ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালে ঠিক করা হয়েছিল, কমাতে হবে ১৯৯০-এর তুলনায়। কিন্তু এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীন বলছে, আমরা ২০০৫ সালের নিরিখে কমাব। কিন্তু আমরা বলছি, তাত্পর্যপূর্ণ কিছু করতে হলে করতে হবে ১৯৯০ সালের নিরিখে। তোমরা যা-ই ঘোষণা দাও, আমরা অঙ্ক করব ১৯৯০ সালের হিসাবে।
২০০৭ সালে আইপিসিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রির নিচে রাখতে হবে। কিন্তু অনেক দেশ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছাড়াই বলেছে, আমরা দেড় ডিগ্রিতেই ভয় পাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশসহ এলসিডিসিভুক্ত দেশ ও এনজিওগুলো বলল, দেড় ডিগ্রির নিচেই রাখতে হবে। এখানে এলডিসি ও জি-৭৭-এর মধ্যে একটা চাপা বিরোধ শুরু হলো। কারণ, আমরা চাচ্ছি, তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে দেড় ডিগ্রির সীমা, কার্বন অনুপাত ৩৫০ ও ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্য চূড়ান্ত হোক। কিন্তু চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের চাপের কারণে এটা উঠে গেছে; অর্থাত্ তারা বিশ্বের স্বার্থ না দেখে নিজেদের স্বার্থ দেখছে।
প্রথম আলো  বিশ্বের জলবায়ুকে উত্তপ্ত করার দায় এবং প্রতিকারের দায়গুলো কীভাবে নির্ধারিত হয়েছে?
আইনুন নিশাত  কার্বন নিঃসরণকে দুভাবে দেখা যায়। একটা হচ্ছে ঐতিহাসিক নিঃসরণ, অর্থাত্ প্রায় ১৮২০ থেকে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ কার্বন বায়ুমণ্ডলে জমা হয়েছে, সেটা। এর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা দায়ী। আর এ মুহূর্তে যে নিঃসরণ হচ্ছে, তার জন্য বেশি দায়ী হচ্ছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। এরাই করছে ৫০ শতাংশ নিঃসরণ। তৃতীয় দায়ী হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশ। চতুর্থ দায়ী হচ্ছে ভারত।
প্রথম আলো  বাংলাদেশে জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলার আলোচনায় কেবল তহবিল পাওয়ার বিষয়টিই বেশি আসে। কিন্তু মিটিগেশন তহবিলের ১০০ বিলিয়ন ডলারের অংশ তো বাংলাদেশের পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আইনুন নিশাত  প্রথমত, জলবায়ু সম্মেলন তো আসলে বাংলাদেশকে নিয়ে হয়নি। যা হোক, সেখানে বাংলাদেশের চাপের কারণে সবচেয়ে বিপন্ন দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের অ্যাডাপটেশন তহবিল ঠিক করা হয়েছে। কোপেনহেগেন ঘোষণার অনুচ্ছেদ ৮-এ বলা আছে, ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিপর্যয় মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ৩০ বিলিয়ন ডলার দেওয়া হবে। কিন্তু ২০১২ সালের পর মিটিগেশন তথা কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল দেওয়া হবে, সেখানে আমাদের কথা নেই। মিটিগেশনের দায়িত্বটা যেহেতু চীন-ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশের, সেহেতু তারাই এটা পাবে। বিপদ মোকাবিলা তহবিলে বাংলাদেশ কিংবা মালদ্বীপ, টুভালুর মতো দেশের অগ্রাধিকারের শর্তের বিরোধিতা করেছে চীন-ভারত। এ-সংক্রান্ত কথা তারা তুলে দিয়েছে। ব্রাজিল বলেছে, তারা অ্যাডাপটেশন তহবিলের টাকা নেবে না। কিন্তু কিয়োটো প্রটোকলের সিডিএমের বেলায় দেখেছি, তারাই মূল সুবিধাভোগী। সুতরাং মিটিগেশন তহবিলের ১০০ বিলিয়ন ডলারের হিস্যা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পাওয়ার সে রকম কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশের এখনই অবস্থান নেওয়া উচিত, ২০১২ সালের পরও যাতে তহবিল পাওয়ার অগ্রাধিকার আমাদের থাকে।
প্রথম আলো  জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলো জোট বাঁধছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জলবায়ু কূটনীতির মূল্যায়ন কী, ভবিষ্যতের কৌশলই বা কী হতে পারে, বলবেন কি?
আইনুন নিশাত  অনেকে বলছেন, বাংলাদেশের জি-৭৭-এর সঙ্গে থাকা উচিত। আমি মনে করি, চলা উচিত নয়। জি-৭৭ বহুমুখী দেশগুলোর জোট। এখানে অতি শক্তিশালী দেশ আছে, আবার দুর্বল দেশও আছে। এর মধ্যে আবার উপ-গ্রুপও হয়ে গেছে। আফ্রিকার দেশগুলো, ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলো জি-৭৭-এর তোয়াক্কা করছে না। আমি মনে করি, জি-৭৭ -এর প্রধান দেশগুলো দরিদ্র ও বিপন্ন দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কোপেনহেগেনে উন্নত দেশগুলো চেয়েছে অ্যাডাপটেশন ও মিটিগেশন তহবিলকে এক করে ফেলতে। অর্থাত্ মনে হচ্ছিল, তারা কিয়োটো প্রটোকল বাতিল করে দিতে চাচ্ছে। সেটার বিরুদ্ধে এলডিসির দেশগুলো ও বাংলাদেশ রুখে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ সবচেয়ে বিপন্ন দেশগুলোর জোট গঠন করতে চেয়েছিল। কিন্তু চীন-ভারত এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। জলবায়ু সম্মেলনে ১৯২টি দেশ, কিন্তু আলাদাভাবে কথা বলেনি। কথা হয় গ্রুপভিত্তিক, তারপর গ্রুপের বাইরে কোনো দেশ কথা বলতে চাইলে বলতে পারে। কিন্তু যখন দলিল তৈরি হয়, সেটা হয় গ্রুপভিত্তিক। যেমন, এলডিসি, স্মল আইল্যান্ড স্টেটস, আফ্রিকা গ্রুপ, জি-৭৭ ইত্যাদি আছে। আমব্রেলা গ্রুপ বলে আরেকটা গ্রুপ আছে। কোপেনহেগেনে জি-৭৭ বনাম ইউরোপীয় ইউনিয়ন বনাম আমব্রেলা গ্রুপের মধ্যেই ছিল মূল দ্বন্দ্ব। রাজনৈতিকভাবে এমভিসিসি বা সবচেয়ে বিপন্ন দেশগুলোর কোনো জোট হয়নি। এটা বুঝতে হবে, সবাই নিজেকে বিপন্ন বলে প্রমাণ করতে চাইছে। তার মধ্যে আমরা আমাদের কীভাবে সবচেয়ে বিপন্ন বলে চিহ্নিত করব, সেটা গবেষণা করে বের করতে হবে। সব ক্ষতিগ্রস্ত দেশ সমান সাহায্য পাবে, সেটা হাস্যকর ব্যাপার। চীন-ভারতকে বলতে হবে, তোমার তো মোকাবিলার ক্ষমতা আছে এবং তুমি তো অন্যতম দূষণকারী। ফলে তাদের থেকে আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে, যা প্রয়োজন ও প্রস্তুতি অনুসারে পেতে হবে। সরকারের উচিত, দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে এই তহবিলটা আদায় করে নেওয়া।
প্রথম আলো বাংলাদেশের অবস্থান তাহলে কোন বলয়ে?
আইনুন নিশাত  বাংলাদেশ জলবায়ু সম্মেলনে ভারসাম্য রেখে চলেছে, কিন্তু চীন ও ভারতের বিরোধিতা করেনি। আবার উন্নত দেশগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ রেখে চলেছে। কারণ, আমাদের তহবিল পেতে হবে। আমরা দেখেছি, চীন-ভারতের মধ্যে যতই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থাকুক, কোপেনহেগেনে তারা জোট বেঁধে কথা বলেছে। কাজেই নিজস্ব স্বার্থে আমাদেরও দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালাতে হবে। বৈশ্বিক রাজনীতিতে জড়ানোর বদলে দেখতে হবে জাতীয় স্বার্থ। আমার চিত্কারে যদি বড় শক্তিগুলো কান না পাতে, তাহলে আমাদেরও জোট বাঁধতে হবে। এখন নজর দিতে হবে ৩১ জানুয়ারির বৈঠকের দিকে। কারণ, কোপেনহেগেনের সাফল্য নির্ভর করছে সেখানে কে কতটা কমাবে, কী পরিমাণ তহবিল দেবে, তার ওপর। সেখানে বাংলাদেশের বলা উচিত, আমাদের প্রযুক্তি ও অর্থায়ন করা হলে আমরা এতটুকু কার্বন নিঃসরণ কমাব; কিন্তু না দেওয়া হলে উন্নয়নপ্রক্রিয়ার সঙ্গে আপস করব না। তবে যে-ই অর্থায়ন করুক, তা নিঃশর্ত হতে হবে।
তবে বিশ্বরাজনীতিও বুঝতে হবে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোর কী ক্ষমতা আছে যে, আমেরিকাকে বলবে তুমি কার্বন পোড়ানো কমিয়ে ফেলো। তবে উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর প্রতি যতটা সহানুভূতিশীল, এলডিসির মধ্যে যারা উন্নত দেশ যথা চীন-ভারত, তা নয়। তৃতীয় খসড়ায় উন্নত দেশগুলোর যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর কথা লেখা ছিল, সেটা তো তারাই কেটে দিল। কারণ, সমগ্র বিশ্ব কমালে তাদেরও কমাতে হবে। তারা তাদের শিল্পায়নপ্রক্রিয়ার সঙ্গে আপস করেনি। জি-৭৭ যেভাবে কার্বন কমানোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, আমাদের তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া উচিত।
প্রথম আলো  ইদানীং দেখা যাচ্ছে, অতীতের ভুল উন্নয়নপ্রক্রিয়া, পানিশাসন পরিকল্পনা যেমন উপকূলীয় পোল্ডার, কিংবা ভারতের ফারাক্কা বাঁধের মতো মনুষ্যসৃষ্ট কারণে তৈরি প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোর জন্যও জলবায়ু পরিবর্তনকে দোষারোপ করা হচ্ছে। এতে করে দোষীরা কি তাদের দায় ঢাকার সুযোগ পাচ্ছে না?
আইনুন নিশাত  জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলা বা অ্যাডাপটেশনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, কতটা মানুষের কারণে আর কতটা প্রাকৃতিক কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, তা চিহ্নিত করা। খুব কষ্ট লাগে, যখন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ার জন্য শুধু জলবায়ু পরিবর্তনকে দোষারোপ করা হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ততা মূলত বেড়েছে ফারাক্কার কারণে। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। এখন আমাদের বিজ্ঞ লোকেরা বলেন, উপকূলীয় পোল্ডারের কারণেও হয়েছে। হ্যাঁ, তাও হয়েছে, কিন্তু মূল কারণটা যে উজান থেকে ফারাক্কার কারণে মিঠা পানির প্রবাহ সরে যাওয়া, তা বেমালুম ভুলতে বসেছি। ফারাক্কার কথা এখন বলাই হয় না। কাজেই কিছুটা মানুষের কারণে, কিছুটা উন্নয়নের জন্য আর কিছুটা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতি হচ্ছে।
প্রথম আলো  উন্নয়নের বর্তমান ধরন যেখানে জলবায়ুর ক্ষতি করেছে, সেখানে নতুন ধরনের প্রযুক্তি ও প্রকৃতিবান্ধব বিকল্প উন্নয়ন চিন্তার প্রয়োজন রয়েছেকি না? আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার কর্মকৌশল সম্পর্কে কিছু বলুন।
আইনুন নিশাত  আজকে বাংলাদেশ যে বিদ্যুেকন্দ্র বসাচ্ছে, সেটা তো মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তি। জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষতিপূরণ তহবিল ইত্যাদির পরও একটি বিষয় রয়ে যায়, সেটা হলো প্রযুক্তি হস্তান্তর। আজকে কুতুবদিয়ায় যে বায়ুকল (উইন্ডমিল) বসানো হয়েছে, সেগুলো এক থেকে পাঁচ কিলোওয়াটের। কিন্তু ডেনমার্ক, জার্মানি করছে পাঁচ হাজার কিলোওয়াটের। আমরা পারছি না, কারণ সেই প্রযুক্তি নেই। আমরা চাচ্ছি সরাসরি উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে প্রযুক্তি নিয়ে আসতে। তহবিল ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও সামনে চলেআসছে। এ ব্যাপারে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের বিরোধ ছিল। তারা চাইছে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মাধ্যমে তহবিল ব্যবস্থাপনা করতে। আমরা বলছি, তাদের অনেক শর্ত। তা ছাড়া বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মাধ্যমে গেলে চীন ও ভারতই বেশির ভাগ নিয়ে যাবে। আমার জানামতে, ব্রিটিশউন্নয়ন-সংস্থা ডিএফআইডি চাইছিল, বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা হোক; কিন্তু বাংলাদেশ রাজি হয়নি। বাংলাদেশ সরকার এখনো এই তহবিল নেয়নি। বাংলাদেশের ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাকশন প্ল্যানে বলা আছে, বাংলাদেশ নিজে একটা তহবিল গঠন করেছে; কোনো দাতা দেশ সেখানে টাকা দিতে পারে, অথবা আলাদা তহবিলও গঠন করতে পারে। দাতারা চাইছে স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা ও তদারকি, আমরা চাইছি সহজপ্রাপ্যতা। কোনো শর্ত কিংবা কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যস্থতার প্রয়োজন এখানে নেই।
প্রথম আলো  আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আইনুন নিশাত  ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.