অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নারী শ্রমিকদের স্বীকৃতি নেই রাষ্ট্রে by আদিত্য আরাফাত

১২৬ বছর আগে শিকাগোতে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে সংগ্রাম করেছিল শ্রমিকরা। কিন্তু  আমাদের দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নারী শ্রমিকদের সব সময় কাজ করতে হয়। শ্রম ঘন্টা বলে যাদের কিছু নেই।

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নারী শ্রমিকদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবদান অনেক। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদেরকে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। ২০০৬ সালে প্রণীত শ্রম আইনে গৃহপরিচারিকা ও নির্মাণ শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
গত এক দশকে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের নিমিত্তে প্রায় এক কোটি ত্রিশ লক্ষ বাড়তি শ্রমশক্তি যুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষই নারী শ্রমিক।

গ্রামীণ জীবন যাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান (সিএসআরএল) এর ২০১২ সালের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, শ্রম বাজারে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণ থাকলেও নিয়োজিত (employed) নারী শ্রমিকের প্রায় বাহাত্তর (৭২) শতাংশই হল অবৈতনিক পারিবারিক নারী শ্রমিক।

২০০৫-২০০৬ এর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের এক কোটি বিশ লক্ষ নারী শ্রমিকের প্রায় ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী, যারা মূলত কৃষি, পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছচাষ ইত্যাদি কৃষি সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত। ১৯৯৯-২০০০ সময়কাল থেকে ২০০৯-২০১০ সময়কালে কৃষি-বন-মৎস্য খাতে অংশগ্রণকারী নারীর সংখ্যা ৩৭ লক্ষ থেকে বেড়ে প্রায় ৮০ লক্ষ হয়েছে (১১৬ শতাংশ বেড়েছে) কিন্তু ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নারীর অবদান স্বীকৃতি ও উচ্চারণের বাইরে থেকেছে।

গ্রামীণ জীবন যাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান (সিএসআরএল) জেন্ডার গ্রুপ এর সমন্বয়কারী এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি এ ব্যাপারে বাংলানিউজকে বলেন, ‘ অপ্রতাষ্ঠানিক নারী শ্রমিকদের কাজের অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অত্যন্ত জরুরি। যেমন ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী কৃষি সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত থাকলেও তাদের স্বীকৃতি নেই।’

মজুরি বৈষম্য কমছে না
কর্মক্ষেত্রের প্রায় সবস্তরেই নারীরা শিকার হচ্ছে তীব্র মজুরি বৈষম্যের। শহর এবং গ্রামভেদে এ বৈষম্য আরো প্রকট।
বগুড়া, নাটোর ও গাইবান্ধাসহ উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় দেখা গেছে, একই  জমিতে একই কাজ করে পুরুষ শ্রমিকরা পায় দিন ১৪০ টাকা। আর নারী শ্রমিকরা পায় মাত্র ৮০ টাকা। কিন্তু তারপরও শ্রমের সঠিক মজুরি পাচ্ছে না নারী শ্রমিক।

একই জায়গায় মাটি কাটার কাজে পুরুষ শ্রমিকরা বেলা ১১টা পর্যন্ত পায় ১৭০/১৮০ টাকা কিন্তু নারী শ্রমিকরা সারাদিন কাজ করে পায় ৭০/৮০ টাকা।

রাজধানীর কয়েকটি খাবারের হোটেলের ভেতরে গিয়ে দেখা গেছে, রান্নাঘরে পুরুষ ও নারী সমান কাজ করছেন অথচ পুরুষ শ্রমিককে দৈনিক ২৫০টাকা মজুরি ধরা হলেও নারী শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৩০টাকা।

একই জায়গায় মাটি কাটার কাজে পুরুষ শ্রমিকরা বেলা ১১টা পর্যন্ত পায় ১৭০/১৮০ টাকা কিন্তু নারী শ্রমিকরা সারাদিন কাজ করে পায় ৭০/৮০ টাকা।

শ্রম বিকাশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে গাঁথুনি কাজের জন্য দৈনিক পুরুষ শ্রমিক ২৪০ এবং নারী শ্রমিক ১৩০ টাকা, মসলা তৈরি কাজে পুরুষ শ্রমিক ২০০ এবং নারী শ্রমিক ১১০ টাকা পায়। মিস্ত্রিদের দেওয়া হয় ৩০০ টাকা। অপরদিকে নারী শ্রমিকদের যোগ্যতা থাকলেও তাদের মিস্ত্রি হিসেবে নেওয়া হয় না।

কেন এ বৈষম্য? এ প্রশ্নের উত্তরে নারী নেত্রী শিরিন আক্তার বলেন, ‘নারীর প্রতি বৈষম্য আগেও ছিল এখনও আছে। তবে সবার আগে জরুরি আমাদের উদ্যোক্তাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন।’

তিনি বলেন, ‘অপ্রাতিষ্ঠানিক নারী শ্রমিকদের শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একজন শ্রমিক হিসেবে তার প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করলে দেশের উন্নয়নের গতিও শ্লথ হয়ে পড়বে।’

আইএলও-এর এক জরিপে দেখা যায়, নারীর মোট গৃহস্থালি শ্রম যোগ করলে তা অনেক দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের অর্ধেক হবে। অথচ এই অবদানের সরাসরি কোনো পরিসংখ্যানে স্বীকৃতি নেই।

এক হিসাবে দেখা যায়, নারী শ্রম শক্তির ৮৩ শতাংশ হচ্ছে অবৈতনিক গৃহস্থালি শ্রমিক, ১০ শতাংশ আত্মকর্মসংস্থান, ৪ শতাংশ বেতনভোগী শ্রমিক এবং ৪ শতাংশ দিনমজুর। শহরাঞ্চলে ম্যানুফ্যাকচারিং কৃষি উৎপাদক খাতে বেশিরভাগ নারী কর্মরত। মাত্র ১•৭ শতাংশ নারী কারিগরি ও পেশাদারি খাতে নিয়োজিত।

নারীর শ্রম নির্ঘন্ট
বাংলাদেশে প্রতিদিন নিজের সংসারে শ্রম দিচ্ছেন প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি নারী। অথচ দেশের অর্থনীতিতে তাদের শ্রমের কোনো মূল্যায়ন নেই। দেশের মোট নারীর ৮১ শতাংশই সরাসরি গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত। দৈনিক গড়ে ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টায় বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন তারা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, গৃহিণীরা গৃহপরিচারিকার কাজ করে প্রতিবছর জিডিপিতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার অবদান রাখছে। আইএলওর এক জরিপে দেখা যায়, নারীর মোট গৃহস্থালি শ্রম যোগ করলে তা অনেক দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের অর্ধেক হবে। অথচ এই অবদানের সরাসরি কোনো পরিসংখ্যানে স্বীকৃতি নেই।

শ্রম আইনেও অপ্রাতিষ্ঠানিক নারী শ্রমিকরা বঞ্চিত
সংবিধানের ২৮নং অনুচ্ছেদে আছে, রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন। সংবিধানের ২৯নং অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে নাগরিকের জন্য সমতা থাকবে। অথচ ২০০৬ সালে প্রণীত শ্রম আইনে গৃহপরিচারিকা ও নির্মাণ শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত নারী শ্রম আইনের আওতাভুক্ত নন।

দেশের উন্নয়নে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারী শ্রমিকদের অবদান রাখলেও রাষ্ট্রে এখনও নারীর স্বীকৃতি মেলেনি। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের এইসব অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকে।

No comments

Powered by Blogger.