সহজ-সরল-আর কত কিছু ভুলে গিয়ে বেঁচে থাকব আমরা? by কনকচাঁপা

জীবনের পথপরিক্রমায় চলতে-ফিরতে যা যা দেখি, শিখি, সবই নাকি আমাদের মগজ জমা করে রাখে। এভাবে জমতে জমতে পাহাড় হয়ে যায়। তাই কিছু কিছু তথ্য ভুলে যাওয়া উচিত! অগ্রাধিকারের ক্রমানুসারে তাদের বাছাই করে গুরুত্ব বিবেচনা করে কোনটা মনে রাখব, কোনটা ভুলে যাব তা নিজেকেই ঠিক করতে হবে।


তাহলেই মগজের জমা খাতায় অনেক দরকারি জিনিস দরকারমতো ঠাঁই পাবে। তো মুশকিল হলো কোনটা ফেলব, কোনটা রাখব, মানে কোন স্মৃতি, শিক্ষা, তথ্য-উপাত্ত মনে রাখব আর কোন অভিজ্ঞতা, আঘাত ভুলে যাব তা কে ঠিক করে দেবে? তেমন কেউ, মানে অভিভাবক আছেন কি, যিনি এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দেবেন? এমনিতে অবশ্য আমরা ভুলে যাওয়ারই জাতি! জাতিগতভাবে আমাদের মৌলিক চাহিদা সরকারের কাছ থেকে আদায় করতে ভুলে যাই, ফিবছর রমজান এলে নিয়ম করে বাজারে আগুন লাগে তা ভুলে যাই, সন্ধ্যাবেলা ছিনতাইকারীরা ক্ষুর নিয়ে জনসমক্ষে ঘোরাঘুরি করে তা ভুলে যাই, সরকারি দল ও বিরোধেী দল যে মাসতুতো ভাই তা ভুলে যাই তাদের উভয়ের প্রতিশ্রুতিতে, যে মিথ্যার স্যাকারিন সুনিপুণভাবে মেশানো থাকে তা ভুলে যাই, ভোটের আগে নেতারা ভিক্ষুক হয়ে বাড়ি বাড়ি আসেন, তাঁদের সেই চেহারা ভুলে যাই। আহা রে, আমরা তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পথভোলা পথিক! আমরা ভুলে যাই যে আজকাল যাঁরা পথ দেখিয়ে পুরো জাতিকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে নাই কোনো আলো, আর তাঁরা নিজেদের প্রয়োজনে পথ চলছেন। আমাদের পথ দেখানো তাঁদের উদ্দেশ্য নয়। তাঁদের প্রয়োজনে শুধু মাথার সংখ্যা বাড়াতে কোনো জনসভায় যোগ দেওয়া উচিত নয়_এ কথাও ভুলে যাই। দেশে একটা খুন হলে তার দোষারোপ করা নিয়ে দুই দলের অভিনীত (দেশ তো আজ দুটি দলে বিভক্ত) কাদা ছোড়াছুড়িতে ভুলেই যাই যে আসলে খুনের বিচারটাই হলো না! আবার খুনি ক্ষমা পেয়ে পগার পার হচ্ছে দেখতে গিয়েও ভুলে যাই সে আসলে কয়টা খুন করেছিল! বিরোধী দল যখন সামগ্রিকভাবে দেশ রসাতলে গেল বলে দাঁত-মুখ খিঁচতে থাকে তখন ভুলে যাই সিংহাসনে আসীন দলও দাঁত খিঁচানোতে প্রচণ্ড পারদর্শী। আমরা ভুলে যাই যে মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তরে কোনো রকম স্বার্থ ছাড়াই শুধু দেশকে ভালোবেসে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন। আমরা ভুলে যাই আমাদের বাংলা ভাষা এত দামি যে তার জন্ম নেওয়া, বেঁচে থাকার ইতিহাসের মূল্য দিতে গিয়েই পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'। আমরা সেই রুবেলের মৃত্যুর কথা ভুলে যাই, সিমির আত্মাহুতির কথা, নূর হোসেনের 'গণতন্ত্র নিপাত যাক' লিখে গণতন্ত্রের জন্য জীবনদানের কথা ভুলে যাই, আমরা ভুলে যাই শামসুদ্দিন মিলনের কথা, যাঁকে চুলায় আগুন জ্বালানোর জন্য ছুড়ে দেওয়া গোবরপিণ্ডের মতো করে মারা হয়েছে। আমরা ভুলে যাই সেই সাতজন বোকা তরুণের দলের কথা, যারা কোনো অভিসন্ধি ছাড়াই অন্ধকারে নিমজ্জিত এক বালুর মাঠে একত্র হয়েছিল, যাদের নিকৃষ্ট কেন্নোর চেয়েও জঘন্যভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে গ্রামবাসী! আমরা ভুলে যাব যে স্কুলফেরত নিষ্পাপ শিশুর ওপর বাস চালিয়ে দিয়ে খুনি চালক বলল, আমার কিছু হবে না_আমার মালিক ঠিকই ছাড়িয়ে নেবে! আমরা ভুলে যাব যে আমাদের দেশের সম্পদ তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর কোনো এক মন্ত্রী বললেন, কোনো মৃত্যুই 'অকাল' নয়? হ্যাঁ, ভুলেই যাব, কারণ আমরা ভুলে গিয়ে ভালোই বেঁচে আছি, তা না হলে একদল সিংহাসনে বসে দুঃশাসনে মেতে উঠলে আরেক দল হয়তো ভালো করবে_এ আশায় কি আর আমরা উজ্জীবিত হতে পারতাম? দেশ, মা, ভাষা, দুঃশাসন, অধিকার_সব একে একে ভুলে যাব আমরা? সাগর-রুনির হত্যা তাঁদের নিজস্ব শোবার ঘরে হয়েছিল, এটাও ভুলতে হবে? তাহলে তো এটাও ভুলতে হবে যে হাজার বছরের সেরা বাঙালি, বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় গৌরব ও অহংকারের সূর্যসন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রায় পুরো পরিবারসহ নৃশংসভাবে খুন হয়ে শহীদ হয়েছিলেন, তাঁর একান্ত বিশ্বাস ও ভালোবাসার স্থান, তাঁর প্রিয় আবাসস্থলটিতে তাঁর শোবার ঘরের সিঁড়ির গোড়ায়? কিন্তু তাই কি হয়, তা কি ভোলা যায়? শেখ মুজিব মানে তো বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মানেই তো মা-মাটি, মাতৃভূমি। এত সব ভুলে গেলে আমার 'আমি'টা কোথায় থাকে! আমি ও আমরা যে মানুষ, তাও কি ভুলে যাব?

লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.