ইমেজ সংকটে শ্রমিক আন্দোলন by মো. রোকন উদ্দিন আহম্মেদ

International Trade Union Confederation Asia Pacifice-এর উদ্যোগে Labour Law reform-সংক্রান্ত Conference ২০১১ সালে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে একজন Participant হিসেবে যোগদান করার সুযোগ হয়েছিল আমার।


এ Conference-এ অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জর্দান, ফিলিস্তিন, ভারতসহ ৪০টির বেশি দেশ অংশ নেয়। এদের মধ্যে নিউজিল্যান্ড থেকে এসেছিলেন Advocate Lloyed. আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম যে আমরা যতটা জানি, তোমার দেশটি শান্তিপ্রিয়। তোমার দেশে শ্রমিক আন্দোলনের প্রকৃতি কেমন; যদি তোমার কোনো যৌক্তিক দাবি সরকার বা মালিক পক্ষ না মানে তখন তোমরা কী করো?
প্রশ্নের উত্তর ছিল, আমাদের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের সম্পর্ক বেশ ভালো, তা ছাড়া আমাদের ইউনিয়নের যে ফান্ড আছে তা দিয়ে আমরা ভালো কিছু করতে পারি, ফলে, মালিকপক্ষ আমাদের ন্যায্য দাবি মেনে নেয়, কোনো অন্যায় আচরণ করতে পারে না। সরকারের বিষয়ে আমার প্রশ্নের ইঙ্গিত ছিল, তোমরা কোনো Agitation, অবরোধ বা ভাঙচুরে অংশ নাও কি না?
তাঁর মৃদু হাসির সঙ্গে উত্তর ছিল, না বন্ধু। আমরা যদিও বিভিন্ন ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত, কিন্তু শ্রমিকবান্ধব নীতির ক্ষেত্রে আমরা সব সংগঠন ঐক্যবদ্ধ এবং ঐক্যবদ্ধভাবেই আমরা আমাদের দাবির বিষয়ে সরকারকে অবহিত করি, সরকার মর্যাদার সঙ্গে আমাদের দাবি মেনে নেয়। আর যদি কখনো না মানে, তবে আমরা অবরোধ, ভাঙচুরে অংশ না নিয়ে এর থেকে 'আরো বড় কাজটি করি'। অবরোধ করি না, কারণ এতে দেশের মানুষ কষ্ট পাবে এবং সাধারণ মানুষের কাছে আমাদের ইমেজ নষ্ট হবে। ভাঙচুরের তো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, এতেও আমাদেরই সম্পদ নষ্ট হবে_দেশের অর্থনীতির চাকা দুর্বল হবে, এর প্রভাব আবার আমাদের ওপর বর্তাবে। বড় ধৈর্য এবং উৎসাহের সঙ্গে অপেক্ষা করছি শোনার জন্য 'বড় কাজটি' কী?
কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে মৃদু হেসে বললেন, বড় কাজটির কথা_আমরা পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনকে টার্গেট করি এবং গণতান্ত্রিকভাবে পরবর্তী সরকার পরিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা পালন করি। সব রাজনৈতিক দলই আমাদের এ গণতান্ত্রিক শক্তি সম্পর্কে অবগত আছে। ফলে, আমাদের দাবি অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে মেনে নেয়া হয়, তবে কোনো অযৌক্তিক দাবি আমরা করি না।
দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল_তুমি একজন Advocate হয়েও আইন পেশা বাদ দিয়ে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেন? ছোট উত্তর_এটা অনেক মর্যাদার।
সে অনুযায়ী বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, এর চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। এখানে শ্রমিক আন্দোলনের ইমেজ খুব ধীরগতিতে নষ্ট করা হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করতে হলে সর্বপ্রথম যে জায়গাটির প্রতি আঘাত করতে হয়, তা হলো তার ইমেজ।
একটা প্রতিষ্ঠানের ইমেজ বা সুনাম নষ্ট হওয়ার মানে হচ্ছে ওই প্রতিষ্ঠানের সবাইকে সামাজিকভাবে ছোট করা। ফলে কোনো মেধাবী লোক সেখানে থাকেন না এবং পরবর্তী মেধাবী প্রজন্মও এর প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে বরং তাকে ঘৃণা করতে শেখে। সে প্রতিষ্ঠানে কোনো মেধাবী নেতৃত্ব গড়ে ওঠে না, তখন নেতৃত্ব মেধানির্ভর না হয়ে পেশিশক্তিনির্ভর হয়ে পড়ে আর স্বার্থান্বেষী মহল এই পেশিশক্তিকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে। সেখানে সাধারণ শ্রমিকদের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না এবং তাদের স্বার্থের কথাও ভাবা হয় না। যার সুদূরপ্রসারী ফলাফল খুবই হতাশাব্যঞ্জক, কখনো ভয়াবহ।
এর বাস্তবতা বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। এখানে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে শ্রমিক নেতৃত্বের ইমেজকে নষ্ট করা হয়েছে। এর প্রভাব চরমভাবে সারা জাতির ওপর বর্তাবে। কারণ বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার কথা বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, মোট জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শ্রমিক এবং একটি দেশ ও জাতির উন্নয়ন অনেকাংশেই এদের হাতে বিনির্মাণ হয়ে থাকে। এদের নেতৃত্ব পেশিনির্ভর হয়ে পড়লে দেশের অর্থনীতিসহ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব দেখা দেবে। Fair Labour Practice-এর ক্ষেত্রে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত তিনটি পক্ষকেই এগিয়ে আসা প্রয়োজন_সরকার, মালিকপক্ষ ও শ্রমিক নেতাদের খারাপ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য। শ্রমিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাঁরা অনেক সময় Unfair Labour Practice-এ জড়িয়ে পড়েন। বিশেষভাবে মধ্যম শ্রেণীর নেতাদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বেশি দেখা যায়। তাঁরা সংগঠনকে অনেক সময় ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিবিশেষকে দোষারোপ করা হচ্ছে না, যেসব উপাদান এর জন্য দায়ী তা খুঁজে বের করতে হবে। সরকার, মালিক ও শ্রমিক নেতাদের আরো মনোযোগী হলে এখান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব এবং বৃহত্তর স্বার্থে এ কাজটি করা প্রয়োজন। বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ শ্রমিক নেতাদের এ দায়িত্ব নিতে হবে। যদি Advocate Lloyed-এর কথায় ফিরে যাই, তবে নেতারা ইচ্ছা করলে 'বড় কাজটি' করতে পারেন, অর্থাৎ দেশের সরকারকে গণতান্ত্রিক পন্থায় পরিবর্তন বা ক্ষমতা আনয়নে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারেন, কারণ গণতান্ত্রিকভাবে সরকার গঠন বা পরিবর্তনের নিয়ামক শক্তি হচ্ছেন সাধারণ ভোটাররা। এই ভোটারদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোটার নিজে শ্রমিক বা তাঁর পরিবারের সদস্য ভোটার, দরকার শুধু সঠিক policy গ্রহণের মাধ্যমে এই বিশাল ভোটব্যাংকের ওপর শ্রমিক নেতাদের স্বতন্ত্র নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এ ইস্যুতে যদি বর্তমান শ্রমিক নেতারা সফল হন, তবে তাঁদের কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করার প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক দলই তাঁদের তোয়াজ করবে এবং সাধারণ শ্রমিকরা তাঁদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবেন। তাঁদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। অত্যন্ত কষ্টের সঙ্গে বলতে হয়, নেতারা যখন আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, এখনো দেশে শ্রমিকবান্ধব শ্রমনীতি ও নূ্যনতম মজুরি প্রতিষ্ঠিত বা বাস্তবায়িত হয়নি_এ আক্ষেপটি করার আর প্রয়োজন হবে না এবং এখানে কোনো ইমেজ সংকটে কেউ ভুগবে না। এর জন্য দরকার ব্যক্তিগত সততা, Foresightment, পারস্পরিক বিশ্বাস।
মালিকপক্ষের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে, শ্রমিক সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন মানে খারাপ কিছু। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে ইচ্ছা করলেই একজন শ্রমিকের অধিকারকে অস্বীকার করা যাবে না, যা আইএলও কনভেনশন '৮৭ ও '৯৮-এর মাধ্যমে একজন শ্রমিকের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া মানবাধিকারের কথা চিন্তা করলে এখানে শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে, Legally Binding Human Rights Instruments which were adopted by UN �eneral Assembly in 1966. যা নিম্নরূপ_The International Covenant on Civil and Political Rights-Gi Article 22(1),
The International Covenant on Economic Social and Cultural Rights-এর Article 8(1), (a) এবং Universal Declaration of Human Rights 1948-এর Article 23 (4)-এ বলা হয়েছে, Everyone has the right to form and to join trade unions for the protection of his interests_এ আন্তর্জাতিকভাবে উপর্যুক্ত অধিকারগুলোর কথা বলা হয়েছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ Labour Act-2006-এর দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, Section 176-এ বলা হয়েছে, Every worker has right to constitute of a trade union and to join association of their own choice.
এমনকি বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের Article 38-এ একই অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন আসে, ইচ্ছা করলেই তো উপর্যুক্ত অধিকারগুলোকে অস্বীকার করা যাবে না। যদি অস্বীকার করার চেষ্টা করা হয়, তবে তার অর্থ দাঁড়াবে দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মালিকপক্ষসহ দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি প্রয়োজন তা হলো_কোনো কারণে মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা নয়, এর আশু চিকিৎসা করাই হবে শ্রেয়। কারণ যে কয়টি উপাদানের সমন্বয়ে উৎপাদন বা সেবার ব্যবস্থা পরিচালিত হয়, এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল উপাদান হচ্ছে শ্রমশক্তি। এই কর্মশক্তিকে বাদ দিয়ে কখনোই উৎপাদনব্যবস্থা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই এই অপরিহার্য শক্তিকে আরো কিভাবে উন্নততরভাবে কাজে লাগানো যায়, তার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
মালিকপক্ষও এখন বেশ সংগঠিত, তাদের বিভিন্ন সংগঠন রয়েছে এবং এসব সংগঠনের কিছু ভালো কাজ এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আপনাদের কাছে আশার প্রাপ্তিও বৃদ্ধি করেছে। সে দৃষ্টিতে আপনাদের কিছু দায়িত্ব রয়েছে এ জাতির কাছে। এ দেশের উদীয়মান শিল্প ও অর্থনীতির চাকাকে নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে আপনাদের সহায়ক ভূমিকা অতি জরুরি। আপনারা এখন যে ভূমিকা নেবেন তার ফল ভোগ করবে পরবর্তী প্রজন্ম। নিরাপদ শিল্প বিরোধমুক্ত শিল্প ও শ্রমিকবান্ধব পরিবেশের চাবি দিয়ে যেতে হবে। এই মহান কাজটি কখনোই বিশাল শ্রমিক শ্রেণীকে অন্ধকারে রেখে বা বঞ্চিত করে সম্ভব নয়। Trade union-এর actual উদ্দেশ্য হচ্ছে মালিক-শ্রমিকদের সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদনের চাকাকে সচল রাখা, যেখানে প্রতিষ্ঠানের প্রতি শ্রমিকের যেমন দরদ থাকবে আর মালিকের প্রতি থাকবে respect, সেই সম্পর্কটিই কাম্য; প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক নয়। বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক F W Taylor-এর ভাষায়_শ্রমিককে প্রেরণা দাও, সে কাজ করবে, তাকে কষ্ট দিও না, সে প্রতিবাদ করবে। একজন শ্রমিক অল্পতেই তুষ্ট, তাকে প্রেরণা দিন, সে কাজ করবে।
লেখক : প্রভাষক, আমেরিকা-বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
rokonuddin7120@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.