উন্নয়ন-পরিবেশ বিনষ্ট করে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প! by ম. ইনামুল হক

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি ভারত সফরে গেলে যেসব বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় তার মধ্যে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে ভারতের সহযোগিতা করার বিষয়টি অন্যতম ছিল। এর পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে সে বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভারতীয় জ্বালানি সচিব এইচএস ব্রহ্ম এবং বাংলাদেশের জ্বালানি সচিব আবুল কালাম আজাদ জ্বালানি বিষয়ক যৌথ স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক করেন।


বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ভারতের ঘধঃরড়হধষ ঞযবৎসধষ চড়বিৎ ঈড়সঢ়ধহু (ঘঞচঈ) বাংলাদেশে একটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, জনসম্পদ উন্নয়ন ও পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে পুনর্বাসন করতে ইধহমষধফবংয চড়বিৎ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ইড়ধৎফ-কে (ইচউই) সহযোগিতা করবে। এর আগের রাতে দু'দেশের আন্তঃসীমানায় বিদ্যুৎ গ্রিড লাইন স্থাপনের বিষয়ে সমঝোতা হয়। কমিটি ১.৮ বিলিয়ন ডলার খরচে একটি ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনেরও সিদ্ধান্ত নেয়। ঘঞচঈ ও ইচউই সমানভাবে এই কেন্দ্রের মালিক হবে। প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ ও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়ে গেলে তিন বছরের মধ্যে কেন্দ্রটি চালু করা যাবে।
দু'দেশের এই সিদ্ধান্তের পর ইচউই ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে ঈবহঃবৎ ভড়ৎ ঊহারৎড়হসবহঃধষ ধহফ এবড়মৎধঢ়যরপধষ ওহভড়ৎসধঃরড়হ ঝবৎারপবং (ঈঊএওঝ) ঢাকাকে ওহরঃরধষ ঊহারৎড়হসবহঃধষ ঊীধসরহধঃরড়হ (ওঊঊ) করার কাজ দেয়। খুলনার লবণচরা এবং বাগেরহাটের সাপমারীতে এই সমীক্ষা কাজ শুরু হলে ব্যাপারটি স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। ২০১০ সালের আগস্টের শেষে ইচউই-র চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের নেতৃত্বে একটি দল দিলি্ল সফরে যায় ও ঘঞচঈ-র সঙ্গে ভারতীয় কয়লা আমদানি করে বাংলাদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের যৌথ উদ্যোগ চুক্তি স্বাক্ষর করে। ঈঊএওঝ ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে চূড়ান্ত রিপোর্টে খুলনার লবণচরায় প্রয়োজনীয় জায়গার অভাব বলে বাগেরহাটের সাপমারী স্থানটিকে বিবেচনার জন্য সুপারিশ করে। এই রিপোর্টের এক্সিকিউটিভ সামারিতে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পটি পরিবেশ অধিদফতরের লাল ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত বিধায় পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র প্রয়োজন; এই ছাড়পত্র পাওয়ার লক্ষ্যেই তারা এই সমীক্ষা কাজটি করেছে।
বাগেরহাটের রামপাল থানার রাজনগর এবং গৌরম্বা ইউনিয়নের সাপমারী এলাকায় প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনের জন্য ২০১০ সালের শেষে ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণের সরকারি তৎপরতা শুরু হয়। সঙ্গে সঙ্গে ওই এলাকার জনগণ তাদের কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলনে নেমে যায়। একই সঙ্গে মাত্র ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে সুন্দরবনকে পরিবেশগত বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য পরিবেশবাদীরাও তাদের আন্দোলনে যোগ দেন। পরিবেশবাদীরা এরপর মামলা করলে হাইকোর্ট ২০১১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রয়োজনীয় সমীক্ষা ছাড়াই 'প্রতিবেশগত কারণে সংকটপূর্ণ' সুন্দরবন এলাকায় প্রকল্পটির নির্মাণ কার্যক্রম আপাতত বন্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু দিলি্ল চুক্তির বরাতে ঘঞচঈ ২০১১ সালের এপ্রিল নাগাদ বাংলাদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সমাপ্ত করে ফেলে। ইচউই-র চেয়ারম্যানের বরাত দিয়ে ২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকা জানায়, ইচউই এই সম্ভাব্যতা সমীক্ষার জন্য ঘঞচঈ-কে ২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার পরিশোধ করবে। সমান সমান মালিক হলে ইচউই কেন এই অর্থ ঘঞচঈ-কে পরিশোধ করবে তা বোধগম্য হয় না। তবে ভারতীয় কয়লা নিম্নমানের বলে যথেষ্ট আলোচনা হওয়ায় পরিবেশ দূষণের বিবেচনায় তা বাতিল করে ইন্দোনেশিয়া বা অস্ট্রেলিয়া থেকে উন্নত মানের কয়লা আনার সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করা হচ্ছে বলে ওই পত্রিকার রিপোর্টে জানা যায়।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে ঈঊএওঝ এবং ঘঞচঈ কী সমীক্ষা করল? ঘঞচঈ-র রিপোর্টটি পাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু ঈঊএওঝ- এর রিপোর্টের এক্সিকিউটিভ সামারিতে প্রকল্পটির পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির জন্য কৃষিজমি যাবে তবে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দিয়ে তা মেটানো সম্ভব, কেন্দ্র পরিচালনার সময় দূষিত পদার্থ নিঃসরণের ফলে ভূউপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির ক্ষতির সম্ভাবনা আছে; তবে ঠিকমতো ব্যবস্থাপনা করলে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। গভীর নলকূপের মাধ্যমে প্রকল্পটির জন্য মিষ্টি পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর নেমে যাবে, তা রোধে বৃষ্টির পানি ব্যবহার বা পুকুরে পানি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় আশপাশের জলজ প্রাণীদের বাসস্থান বিপর্যস্ত হবে, যা রক্ষায় সীমিত হারে কাজ করা যেতে পারে। প্রকল্প চলাকালে বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন হবে; তবে পরিবেশ অধিদফতরের মান রক্ষা করলে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। প্রকল্প বজ্র্যের কারণে ভূউপরিস্থ পানির দূষণ হবে এবং ভূগর্ভস্থ পানির অতি-উত্তোলনের কারণে স্তর নেমে যাবে। এর বিপরীতে মিষ্টি পানি পুনঃভরণ ও মাটির গভীরে ইনজেকশন করা যেতে পারে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের গরম পানি আশপাশের জলজ প্রাণিকুলের জীবন সংকটাপন্ন করবে, যা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সীমিত করা যাবে। ঈঊএওঝ-এর রিপোর্টে দূষণ ও বিপদের উলেল্গখ করে তা দূর করার ব্যাপারে যেসব পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সেগুলোর কার্যকারিতা সম্পর্কে সধু, সরমযঃ, ড়িঁষফ, ড়িঁষফ নব, ংযড়ঁষফ নব এবং অসংখ্যবার সরমযঃ নব বলে দায়সারা গোছের মন্তব্য করা হয়েছে। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অক্টোবর থেকে মে মাস বায়ুপ্রবাহের দিক পরিবর্তনের কারণে প্রায় সাত মাস বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ করে দক্ষিণে সুন্দরবনকে বিপর্যস্ত করবে, সে কথা ঈঊএওঝ-এর রিপোর্টে বলা নেই।
কয়লানির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বিরূপ প্রতিক্রিয়া রোধ সম্পর্কে ঈঊএওঝ-এর রিপোর্টে যেসব পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সেগুলো বাংলাদেশ বা কোথায়ও প্রয়োগ হচ্ছে কি-না বলা নেই। কেন্দ্রটি পরিচালনার প্রয়োজনে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে যে বিপর্যয় হবে তা রোধে যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তা একেবারেই অবাস্তব। সবশেষে বলা হয় 'ঐড়বিাবৎ ঃযব ঢ়ৎবংবহঃ বষবপঃৎরপরঃু পৎরংরং ফবসধহফং ঃযব ঢ়ৎড়লবপঃ ভড়ৎ হধঃরড়হধষ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ. অঃ ঃযব বহফ, রঃ পধহ নব ংধরফ ঃযধঃ ঃযব ঢ়ড়ঃবহঃরধষ নবহবভরঃং সধু ড়ঁঃবিরময ঃযব হবমধঃরাব রসঢ়ধপঃং.' এই সমীক্ষাটি আসলে পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়ার কৌশলী অপতৎপরতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ২০১১ সালে ঘঞচঈ ও ইচউই তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখলে গত ৯ জুলাই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত সংগঠনগুলো বাগেরহাটের ফয়লায় এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। কিন্তু ওইদিন পুলিশ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র সমর্থনকারী কিছু লোক লাঠিচার্জ ও হামলা করে সমাবেশটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। প্রচার চালানো হয় আন্দোলনকারীরা দেশের তথা এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নবিরোধী কাজে লিপ্ত রয়েছে।
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বা উরৎবপঃ ঋড়ৎবরমহ ওহাবংঃসবহঃ (উঋও)-এর জন্য সরকার উৎসাহী। আমরা উঋও-এর বিরোধী নই, কিন্তু যেসব সুবিধা দিয়ে দরজা খুলে এসব আনা হচ্ছে আমরা তার বিরোধী। শিল্পায়ন দেশের অর্থনীতিকে বাড়ায়, কর্মসংস্থান করে, প্রবৃদ্ধি বাড়ায়। কিন্তু শিল্পায়ন কৃষিজমি ধ্বংস করে, পরিবেশ দূষণ করে। ধনী ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত গরিব ছিন্নমূল মানুষ এসব প্রকল্পের সুবিধাভোগী হতে পারে না। প্রকল্প গ্রহণের আগে ধাপে ধাপে অর্থনৈতিক সুবিধা, কারিগরি সম্ভাব্যতা, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া সমীক্ষা করতে হবে। ধাপে ধাপে এই সমীক্ষাগুলো করলে কোনো প্রকল্প সত্যিই দেশ ও জনগণের স্বার্থে হচ্ছে কি-না তা স্পষ্ট হয়ে যায়।

প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক : সাবেক মহাপরিচালক, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ও কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.