চারদিক-সাম্যের মন্ত্রে এগিয়ে যাও! by নেয়ামতউল্যাহ

শীতের সকাল। শৈত্যপ্রবাহে জাঁকিয়ে শীত পড়ছে। লেপ-কাঁথা ছেড়ে বের হওয়াটা ইচ্ছের বাইরে। তবুও ভোলা সদর উপজেলার নলিনী দাস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে এসে দেখা গেল, শীত উপেক্ষা করেই হাজির হয়েছে শিশুরা। তারা সবাই এই স্কুলের ছাত্রী।


কেউ স্কুলের পোশাক, কেউ শাড়ি, কেউ নতুন পোশাকে সুন্দর করে সেজেছে। মাথায় গাঁদা ফুল।
বিপ্লবী নেতা কমরেড নলিনী দাসের আবক্ষ প্রতিকৃতি লালসালুতে ঢাকা। ১ জানুয়ারি ছিল তাঁর জন্মদিন, তাই সবার মনে, চোখে-মুখে এত আনন্দের আভা। কলকাকলিতে মেতে উঠেছে শিশুদের দল।
শত বছর আগে কমরেড নলিনী দাস ভোলার উত্তর শাহবাজপুরে এক নায়েব পরিবারে জন্মেছিলেন। শুধু ভোলাবাসী নয়, সমগ্র জাতি তাঁর জন্য গর্বিত। এ জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর ওয়াক্ফ স্টেটে নির্মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চারপাশে মরিচবাতি জ্বলেছে দুই রাত। কথা ছিল সপ্তাহব্যাপী নলিনী দাস মেলা হবে। চেয়েছিলও সবাই। হয়নি। তাই মনে ব্যথা সবার। দিনব্যাপী অনুষ্ঠানেও মেলা কম জমেনি। চটপটি-বাদাম, চায়ের দোকান আর বইয়ের দোকানও বসেছিল সেদিন। সকাল ১০টায় বিশাল শোভাযাত্রা ভোলার সব লোককে জানিয়ে দিল উত্সব করো! কমরেড নলিনী দাসকে শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকা থেকে এসেছেন অনেকে, তোমরাও এসো! ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেমে ঘোষণা হচ্ছে তা-ই। সাড়ে ১০টায় সেই লালসালুতে ঢাকা বিপ্লবী কমরেড নলিনী দাসের আবক্ষ প্রতিকৃটি উন্মোচন করা হলো। অনেকে ফুলের ডালায় প্রতিকৃতি স্তম্ভের পাদদেশ ভরিয়ে দিলেন। আর নবীনেরা বিভিন্ন ভঙ্গিতে ব্যস্ত ছবি তুলতে। অনেকেই পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে কমরেডের প্রতিকৃতির দিকে, যেন নতুন করে আবিষ্কার করছে মানুষটিকে।
বিশাল মঞ্চ। সামনের সারিতে সব দাড়ি পাকা, চুল পাকা প্রায় শতবর্ষীয় নেতা-ভক্তকুল। তাঁদের অনেককেই চিনি না। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তাঁরা একসময় বিপ্লবী নলিনী দাসের সঙ্গে আন্দোলন করতেন। তাঁদের প্রিয় ‘নলিনীদা’র জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন। কোথায় থাকেন তাঁরা? তাঁদের অনেকেই কষ্টেসৃষ্টে নিভৃত পল্লিতে জীবন পার করছেন। তবুও বুকে ধারণ করেন সব মানুষ সমানভাবে ভালো থাকুক! তাঁদের অনেকে হুলিয়া মাথায় নেওয়া বিপ্লবীদের রাতের অন্ধকারে আশ্রয় দিয়েছেন। দিনের পর দিন রান্না করে খাইয়েছেন। আর যাঁদের চিনি, তাঁরাও বিভিন্ন দলের, বিভিন্ন মতের, ভোলার প্রথম সারির নেতা আজ। তাঁরাও একসময় বিপ্লবী নলিনী দাসের মতো বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন করেছেন। কিন্তু আজ নিজের অধিকার আদায়ে অন্য দল করছেন। কিন্তু নলিনীদাকে শ্রদ্ধা জানানোর ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। এখনো মানুষ বঞ্চিত, এখনো মানুষ শোষিত। তাই আসছেন দলে দলে।
আলোচনা শুরু হলো। নলিনীদা কেমন ছিলেন, তা-ই জানালেন সব দলের ডাকসাইটে জ্যেষ্ঠ নেতা। জোট সরকারের সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মোশারেফ হোসেন শাজাহান বলেন, আমি এবং তোফায়েল আহমেদ বহু যুগ পরে এক মঞ্চে উঠলাম, এক মহান মানুষকে শ্রদ্ধা জানাতে। ব্যক্তিজীবন, সামাজিক জীবন যে রাজনীতির বাইরে নয়, তা এ বিপ্লবীকে না দেখলে জানা যাবে না। তিনি আমাদের এ মন্ত্রেই দীক্ষা দিয়েছেন। ভোলা-২ আসনের সাংসদ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ’৭০ সাল থেকে আমি তাঁর সংস্পর্শে এসেছি। গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য এ মহামানব জীবনের অধিকাংশ সময় জেলে ও আত্মগোপনে থেকেছেন। মৃত্যুর আগে তাঁর সব সম্পত্তি ট্রাস্টি বোর্ডে দান করে যান। জীবন-মরণে তাঁর সবকিছু মানুষের জন্য। তাঁকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারা যায় না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি কমরেড মনজুরুল আহসান খান বলেন, কমরেড নলিনী দাস কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হলেও সব দলের নেতাদের কাছে ছিলেন সমান প্রিয়, সমান শ্রদ্ধার। সোনার বাংলাকে সোনায় পরিণত করতে তাঁর লড়াই ছিল শেষ পর্যন্ত। বাকি কাজ আমাদের করতে হবে। এ দেশের মানুষগুলো এখনো মরে যায়নি। এখনো কমরেড নলিনীদাকে শ্রদ্ধা জানাতে সর্বস্তরের বৃদ্ধ, যুবা মিলিত হয়েছেন।
এ বছরই প্রথম নলিনী দাস শতবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটির পক্ষ থেকে ১০টি শাখায় নলিনী দাস পদক দেওয়া হয়েছে। পদক প্রদানের পর দুপুরের কিছুটা সময় উদ্যাপন-ময়দান ফাঁকা ছিল। কিন্তু বিকেলের সূর্যটা হেলে পড়তেই মাঠ ভরে গেল। নলিনী দাসের ম্যুরালকে পেছনে রেখে ছবি তোলার ধুম। সন্ধ্যার পর শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিশাল মাঠ ভরে গেছে। সেই কবিতা-গান, নৃত্য-নাটক শেষ পর্যন্ত উপভোগ করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তিনি যথার্থই বলেছেন, আমরা দলমত-নির্বিশেষে একত্র হয়েছি একজন মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।
বক্তারা আরও বলেন, আজ আমাদেরও সাম্যের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করল অমর কমরেড। হে যুবাগণ, তোমাদের নলিনীদার রেখে যাওয়া কাজগুলো শেষ করতে হবে, তোমরা সাম্যের মন্ত্রে এগিয়ে যাও!

No comments

Powered by Blogger.