কাঁটাতারের প্রাচীর-দুর্গের দুয়ারে করি করাঘাত by শেখ রোকন

সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বহুল প্রচারিত 'অব দ্য রেকর্ড' মন্তব্য নিয়ে যখন ঢাকা-দিলি্ল সরগরম, তখন প্রভাবশালী মার্কিন ম্যাগাজিন 'ফরেন পলিসি'তে অনেকটা নিভৃতে প্রকাশ হয়েছে দু'দেশের কাঁটাতার-লাঞ্ছিত সীমান্ত নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন।


জুলাই-আগস্ট সংখ্যায় স্থান পাওয়া সংবাদভাষ্যটির শিরোনাম_ ভারত দুর্গ (ফোট্রেস ইন্ডিয়া)। প্রণেতা তিনজন_ স্কট ক্যারনি, জ্যাসন মিকলিয়ান ও ক্রিস্তিয়ান হোয়েলকার। তিনজনই নিজ নিজ ক্ষেত্রে এরই মধ্যে সুনাম কুড়িয়েছেন। স্কট ক্যারনি সম্পর্কে জানা যাচ্ছে, তিনি বিশ্বের 'বিপজ্জনক প্রান্তে প্রান্তে' কাজ করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ায়ও কাজ করেছেন অর্ধদশক। বর্তমানে উইয়ার্ড ম্যাগাজিনের প্রদায়ক সম্পাদক। ফরেন পলিসি ও মাদার জোনসের মতো ম্যাগাজিনে তার লেখা নিয়মিত প্রকাশ হয়ে থাকে। অন্য দু'জন অসলোভিত্তিক পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটে গবেষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়া তাদের কাজের অন্যতম ক্ষেত্র।
প্রতিবেদন ও এর প্রণেতাদের প্রোফাইল দেখে বোঝা যায়, এর পেছনে যে সময় ও শ্রম গেছে, তাতে অন্তত আমাদের এখানে এটির 'নিভৃত' প্রকাশ স্বাভাবিক নয়। বিদেশি সংবাদমাধ্যমে দেশীয় বিষয়ে স্থানপ্রাপ্তি আমাদের এখানে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে ধরে নেওয়ার রেওয়াজ তো সুপ্রতিষ্ঠিত। ওই খবর সেখানে যতটা গুরুত্ব দিয়ে ছাপা বা সম্প্রচার হয়, আমাদের সংবাদমাধ্যমে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে স্থান পাওয়ার খবরটি। এমন নজির বিরল নয় যে, একই বিষয়ে অনেক বেশি অনুসন্ধানী বা বিশ্লেষণমূলক খবর হয়তো আগেই এখানকার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। সেই সংবাদটিই যখন কম গভীরতায় এবং অনেক ক্ষেত্রে ভুল ও অসম্পূর্ণ তথ্যে বিদেশি মধ্যম সারির সংবাদমাধ্যমেও ছাপা হয়, তখন তার গুরুত্ব বেড়ে যায়। এ প্রবণতা কেবল মিডিয়া ম্যানেজার বা দর্শক-পাঠকের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান নয়; বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে বেশি গ্রাহ্য করা আমাদের রাজনীতিক, আমলা ও নাগরিক ব্যক্তিত্বদের যেন মজ্জাগত। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির ক্ষেত্রেই কেবল অদ্ভুত ব্যতিক্রম ঘটেছে।
ফরেন পলিসির মতো প্রভাবশালী ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়ার পরও অন্তত এ দেশের সংবাদমাধ্যমের নজর কেন এড়িয়েছে, এর একটি কারণ হতে পারে একই সময়ে চাউর হওয়া মনমোহন সিংহের বেফাঁস মন্তব্যটি। বাংলাদেশে কত ভাগ নাগরিক ভারতবিদ্বেষী কিংবা জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী_ এ বিষয়ে ভিত্তি এবং নানা বিবেচনায় গুরুত্বহীন একটি মন্তব্যের জোর ও জেরের কাছে হয়তো হেরে গেছে দু'দেশের সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া নিয়ে এযাবৎকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমে স্থান পাওয়া প্রসঙ্গটি। শুধু প্রভাবশালী ম্যাগাজিন বিবেচনায় নয়, কাঁটাতার প্রাচীরের প্রসঙ্গটিই যেখানে ব্রাত্য, সেখানে এভাবে আলোচনাহীন হারিয়ে যাওয়ায় ক্ষতি ছাড়া বৃদ্ধি নেই।
সন্দেহ নেই, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ইস্যু অনেক। প্রতিবেশী দেশ দুটি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিকভাবে যেমন ঘনিষ্ঠ, তেমনি অমীমাংসার ক্ষেত্রটিও বিস্তৃত। সীমান্ত চিহ্নিতকরণ সম্পন্ন করা, ছিটমহল বিনিময়, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, পারস্পরিক ট্রানজিটের মতো সমস্যা যেমন_ স্বাধীনতার পর থেকেই ঝুলে রয়েছে; গত চার দশকে স্বভাবতই যুক্ত হয়েছে দু'পাশ থেকে সীমান্ত অতিক্রম, বাণিজ্য ঘাটতি, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর হত্যাকাণ্ড, কাঁটাতারের প্রাচীরসহ আরও নতুন নতুন ইস্যু। নতুন-পুরনো যা-ই হোক, গত চার দশকে পারস্পরিক দোষারোপ ছাড়া অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হয়নি। কেবল দু'দেশের সীমান্তে ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়েছে কাঁটাতারের প্রাচীর।
প্রাচীনতম ইস্যু অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন নিয়ে আর কিছু হোক না হোক সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আলোচনা ও লেখালেখির অভাব নেই। সন্তোষজনক না হলেও গঙ্গা নিয়ে কয়েক দফা চুক্তি সম্ভব হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা তিস্তাসহ আরও পাঁচ-সাতটি নদীর ব্যাপারে সুরাহার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার, মেঘনার উজানে টিপাইমুখ বাঁধসহ পানিবণ্টন সংক্রান্ত অন্যান্য ইস্যুও অন্তত টেবিলে রয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতিও বহুল আলোচিত ইস্যু। দেশ বিভাগের সময় থেকে রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের ফাঁদে আটকে থাকা ছিটমহলগুলোর সুরাহার কথাও শোনা যাচ্ছে জোরেশোরে। ট্রানজিটের বিষয়টিও এগিয়েছে অনেক দূর। সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড বন্ধের ব্যাপারেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মতৈক্যের অভাব নেই। কেবল কাঁটাতার প্রাচীরের বিষয়টিই আলোচনায় নেই। অথচ কোনো কোনো বিবেচনায় এ ইস্যুই রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
'ফরেন পলিসি'র ওই প্রতিবেদনে বহুল আলোচিত ফেলানীর মর্মান্তিক মৃত্যুর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে এটা স্পষ্ট করা হয়েছে যে, 'ট্রিগার হ্যাপি' বিএসএফই কেবল নয়, এ ধরনের মৃত্যুর জন্য কাঁটাতারের বেড়া কতটা দায়ী। বলা হয়েছে, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে আড়াই দশক ধরে নির্মীয়মাণ ১২০ কোটি ডলারের ওই সীমান্তপ্রাচীর শেষ পর্যন্ত আগামী বছর সম্পন্ন হতে যাচ্ছে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রতিবেদকত্রয় আক্ষেপ করে বলেছেন, কড়াকড়ির জন্য কুখ্যাত অন্যান্য সীমান্ত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম দখল করে থাকলেও ভারত-বাংলাদেশের এ সীমান্ত বরং পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে রক্তাক্ত নো-ম্যান্সল্যান্ডে। মাত্র ২০০০ সাল থেকে বিএএসফের গুলিতে অন্তত এক হাজার বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। কিন্তু এই সীমান্তপ্রাচীর নিয়ে কোনো কথা নেই।
একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে আলোচিত বার্লিন সীমান্তপ্রাচীরের দৈর্ঘ্য ছিল ১৪০ কিলোমিটার। ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে ঘিরে যে প্রাচীর তৈরি করছে তার সম্ভাব্য দৈর্ঘ্য হবে ৭৬০ কিলোমিটার। মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে নির্মীয়মাণ দেয়াল দাঁড়াবে এক হাজার ২২৩ কিলোমিটারে। আর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে যে কাঁটাতার তৈরি হচ্ছে, তার দৈর্ঘ্য এ সবগুলোর সমষ্টিরও বেশি_ তিন হাজার ৭৮৩ কিলোমিটার। তার মানে, ফরেন পলিসির প্রতিবেদন বলছে, আগামী বছর নাগাদ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার 'সম্ভাব্য প্রত্যেকটি যাতায়াতপথ' কাঁটাতারের বেড়ায় আবদ্ধ হয়ে পড়বে।
আমরা জানি, দু'পক্ষেরই কিছু উগ্র ডানপন্থি রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারীর কথা বাদ দিলে বাংলাদেশ-ভারত বল্পুব্দরাষ্ট্রই। অভিন্ন ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভূগোলের রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত অংশ। কেবল তা-ই নয়, দিন কয়েক আগে ঢাকায় সফরে এসে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক এখন 'ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে' পেঁৗছেছে। দুই তরফেই আশা করা হচ্ছে, এই সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বহুল প্রত্যাশিত বাংলাদেশ সফরে তিস্তার পানিবণ্টন, ছিটমহল বিনিময়, ট্রানজিটসহ দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা বেশ কিছু ইস্যুর মীমাংসা হবে। কিন্তু প্রাচীরে আবদ্ধ ছোট একটি দেশের সঙ্গে বৃহৎ প্রতিবেশীর সম্পর্ক কতটা স্বাভাবিক হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বাংলাদেশকে কাঁটাতারে ঘিরে ভারত আসলে কী অর্জন করতে চাইছে। ফরেন পলিসির প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, জঙ্গিবাদ ও অবৈধ অভিবাসী ঠেকানো মূল লক্ষ্য। প্রশ্ন হচ্ছে, জঙ্গিবাদ কি কাঁটাতার দিয়ে ঠেকানোর জিনিস? বৈশ্বিক এই প্রপঞ্চের স্থানীয় সংস্করণ কি ভারতের অভ্যন্তরেও সৃষ্টি হচ্ছে না? সীমান্তের যেসব এলাকায় ইতিমধ্যে কাঁটাতার দেওয়া হয়েছে, সেখানে কি চোরাচালান বা পারস্পরিক অনুপ্রবেশ বন্ধ করা গেছে? কাঁটাতারে পরীক্ষিত বল্পুব্দর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে ভারতের জন্য লাভের বদলে বরং ক্ষতিই হচ্ছে। কাঁটাতারের অস্বস্তি মীমাংসাযোগ্য অন্যান্য ইস্যুতে কি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে না? সামরিক সরঞ্জামে সুসজ্জিত কাঁটাতারের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আর যা-ই হোক, বল্পুব্দত্ব হয় কি? বাংলাদেশকে কাঁটাতারে ঘিরে নিজে নিজেই দুর্গে পরিণত হওয়া ভারতের দুয়ারে করাঘাত করে এসব প্রশ্নেরই উত্তর প্রার্থনা করছি।

শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.