রক্তঝরা এপ্রিল ও প্রধানমন্ত্রী by নাদীম কাদির

জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু! এই স্লোগান শুনেছি আমার বাবার মুখে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার নেতা, স্বপ্নের নেতা, যে নেতা তার স্বপ্নের স্বাধীনতা এনে দেবেন। এপ্রিল মাস এলে সেই রক্তঝরা দিনগুলোর কথা বারবার মনে পড়ে। আমার বাবা শহীদ প্রকৌশলী লে. কর্নেল এমএ কাদির তার স্বপ্নের বাংলাদেশের যুদ্ধে শহীদ হন।


পাকিস্তানি সেনারা তাকে ১৭ এপ্রিল ধরে নিয়ে যায়। প্রথমে আমরা শুনতে পাই, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিয়ে তাকে ভীষণ নির্যাতন করা হয়। সেখানে রাখা ইলেকট্রিক চেয়ারে (যা এখনও জাতীয় জাদুঘরে রাখা আছে) নির্যাতন করা হয়। আজও মনে পড়ে সেই ১৭ এপ্রিলের কথা। ভোরবেলায় দরজায় বুটের লাথি। কুকুর দুটি তারস্বরে চিল্লাচ্ছে। শত্রু এসেছে, সাবধান! দরজাটা আমি খুললাম। এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে ১০-১২ জন সৈনিক, হিংস্র ও ত্রুক্রদ্ধ। জিজ্ঞাসা করল, বাবা কই? দেখিয়ে দিলাম, শোবার ঘর।
এরপর বাবাকে নিয়ে গেল। বলেছিলাম_ 'আংকেল, বাবাকে ফিরিয়ে দাও।' কিন্তু তা তো হলোই না বরং কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে আমাদের মেরে ফেলার হুমকি দিল। আমার সাহসী মা হাসনা হেনা কাদির বলেছিলেন_ 'মারলে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে মেরে ফেলো।' মারল না, চলে গেল। পুরো বাসা তছনছ করে মায়ের গহনা-টাকা-পয়সা যা পেল নিয়ে গেল। শেষ হলো জীবনের সব আনন্দ, শেষ হলো জীবনের স্মরণীয় দিনগুলো। শুরু হলো বাবাহারা জীবন, সংগ্রামের জীবন। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলেন মা। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তার সঙ্গে বাবার সাক্ষাতের কথা, ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে। আমার মা তো অবাক! লুকিয়ে কার সঙ্গে গিয়েছিলেন! বঙ্গবন্ধু মাকে বলেছিলেন, কর্নেল কাদিরকে স্মরণ করার জন্য কিছু একটা করতে হবে। শেষ পর্যন্ত ১৯৮২ সালে কাদিরাবাদ সেনানিবাস স্থাপন করা হয়। ধন্যবাদ সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. এম মাহবুবুর রহমান, লে. জে. এম নুরুদ্দিন খান ও মেজর জেনারেল মোজাম্মেল হোসেনকে। তারা পুরনো ফাইল পুনরুজ্জীবিত করে নামকরণ করলেন কাদিরাবাদ সেনানিবাস। ১৯৭৮ সাল, আমার জন্য খুবই স্মরণীয়। মা কিছুতেই মানতে রাজি নন যে, বাবা বেঁচে নেই, শহীদ হয়েছেন। প্রমাণ চাই, আর এই প্রমাণের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ১৯৯৯ সালে তিনিও পৃথিবীর মায়া ছাড়লেন। আমার বাবাকে খোঁজার যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৮-এ। কখনও ফয়'স লেক, কখনও ওই পাহাড় এই পাহাড় ঘুরে বেড়িয়েছি তার ছবি হাতে নিয়ে।
অবশেষে ২০০৭ সালে তার খোঁজ পাই। স্মরণ করি ড. মাহফুজুর রহমান, কর্নেল বায়েজিদ (বর্তমানে ডিজিএফআইয়ে কর্মরত) ও নুরুল ইসলাম নামের তিনজন বড় মাপের মানুষের কথা। তাদের সহায়তায় বাবার কবরটা খুঁজে পাই।
এরপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১১-এর ২২ সেপ্টেম্বর তার দেহাবশেষ চট্টগ্রামের বধ্যভূমি থেকে তার নামে নামকরণকৃত নাটোরের কাদিরাবাদ সেনানিবাসে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। আর সেদিনই জীবনের কাছে চাওয়ার সমাপ্তি হয়। আমাদের প্রিয় আপা শেখ হাসিনা তার কথা রেখেছেন। রাখতেই হবে_ কারণ তিনি তো আমার বাবার নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তবে গত মার্চ মাসে হতবাক করা এক ঘটনা_ প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য প্রেস সচিব শাকিল ভাই আমাকে ফোন করলেন, 'নাদিম ভাই, আপনি আপার সঙ্গে ১১ মার্চ কাদিরাবাদ যাবেন।' আনন্দে আত্মহারা হলাম। কারণ তখনও কাদিরাবাদ থেকে কোনো দাওয়াত পাইনি। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য ক'জনারই-বা হয়!
সকালে হেলিকপ্টারযোগে নাটোরে_ আপা বললেন, তুমি এসেছ? আমি আমার লেখা বই 'মাই বিউটিফুল বাংলাদেশ'-এর একটি কপি তাকে উপহার দিলাম।
এরপর চা-চক্রে কিছু কথা হলো আর ছবি তুললাম। পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। ছবি তুলতে তুলতে আপা বললেন, আজকের এই দিনে তোমার হক সবচেয়ে বেশি। আমি তাকে ধন্যবাদ দেওয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এর পরও বললাম, 'আমি জানতাম, আপনি আমার কথা ফেলবেন না।'
লে. জে. নুরুদ্দিন খান ও লে. জে. মাহবুবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর সামনে আমার বাবার কিছু স্মৃতিচারণ করলেন। দু'জনই আমার বাবার ও আমার খুব প্রিয় মানুষ। সেদিন প্রধানমন্ত্রী আবারও বাবার বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন। এতে আমার বাবার আত্মা শান্তি পাবে, কারণ সে আত্মা নিশ্চয়ই আজ বলছে_ 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় শেখ হাসিনা'। এরপর কি আর কোনো কথা থাকে?

নাদীম কাদির :সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.