সরল গরল-সুরঞ্জিতের রাজনৈতিক ‘অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’! by মিজানুর রহমান খান

রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগের ঘোষণা বাংলাদেশের ঘুষ-দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির ইতিহাসে একটি চমকপ্রদ ও স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। তাঁর পদত্যাগের মধ্য দিয়ে ‘টাকার বস্তা’ উপাখ্যানে ছেদ পড়বে, যবনিকাপাত ঘটবে না। দেশবাসী পরের অঙ্কের দিকে তাকিয়ে থাকবে।


বাংলাদেশে দুর্নীতির বিচার হয় না। পদত্যাগ কোনো বিচার নয়। গত সাড়ে তিন বছরে দুদকের করা একটি মামলায়ও দেশের একজন ব্যক্তিও সর্বোচ্চ আদালত থেকে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজা ভোগ করছেন না—এই একটিমাত্র তথ্য সম্ভবত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের স্পন্দন অনুভব করার জন্য যথেষ্ট।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের রাজনীতির একটি বিশেষ চরিত্র। দেশের ঊষালগ্নে যখন বিরোধী দল বলে কিছু ছিল না, তখন তিনি একা সেই শূন্যস্থান পূরণ করেন। গত দুই দশকে বহুবার তাঁর সঙ্গে একান্তে আলোচনার সুযোগ হয়েছে। রাজনীতিতে নীতি-নৈতিকতা, আচরণবিধি ইত্যাদি নিয়ে তাঁর বলার একটি ঝোঁক ছিল। তাঁর বড় আক্ষেপ, বাংলাদেশের সাংসদদের জন্য কোনো প্রিভিলেজ বা অধিকার আইন নেই। তিনি বলেছিলেন, সাংসদ ও মন্ত্রী উভয়ের জন্য আইনের মর্যাদায় আচরণবিধি বাঞ্ছনীয়। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি প্রথম আলোর এই কলামে তা লিখেও ছিলাম।
মন্ত্রিত্ব তাঁর স্বপ্ন ছিল। চেয়েছিলেন আইনমন্ত্রী হতে। সারা জীবন যে বিষয়ে তিনি বিচরণ করেছেন, সেখানে তাঁর ঠাঁই হলো না। নিতান্ত ঠেকায় পড়ে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল রেল। আমাদের হাতেগোনা যে কয়েকজন রাজনীতিক পার্লামেন্টারিয়ান হয়ে উঠতে পেরেছিলেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। চৌকস বাগ্মী হিসেবে তাঁর সুনাম সুবিদিত। রসময় অভিব্যক্তি ও ঠাট্টা তাঁর ভাষণের উপজীব্য। একই সঙ্গে তাঁর এলাকার রাজনীতিতে তাঁকে ঘিরে কিছু দুর্নামও ছিল। দুর্নীতির নির্দিষ্ট অভিযোগের তথ্য দিয়ে তাঁর এলাকার এক ভদ্রলোক আমার কাছে ই-মেইল করেছিলেন। সেটা খতিয়ে দেখা হয়নি।
তবে পিলখানায় টাকার ‘বস্তাবাহী গাড়ি’র তাঁর বাড়িমুখী গন্তব্যের কথা জেনে সত্যিই পিলে চমকে গিয়েছিল। পদত্যাগকে কী করে মহীয়ান করে তুলতে হয়, তা সেনগুপ্তের ভালোই জানার কথা ছিল। কিন্তু কথিত টাকার বস্তা ধরা পড়ার কাহিনি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি যথোচিতভাবে ঝলসে উঠতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ১০ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া তাঁর বক্তব্য ছিল স্ববিরোধী, পলায়নপর ও প্রশ্নসাপেক্ষ। তিনি প্রায় সব ধরনের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় পদত্যাগের ‘সাহসী’ ঘোষণা দিয়েছেন।
সুরঞ্জিতের একটি প্রিয় পঙিক্ত হচ্ছে, ‘পিপাসায় আর্ত হয়ে চাহিলাম জল/কোথা থেকে এনে দিলে আধখানা বেল।’ তাঁর এ পঙিক্ত আমি স্মরণে এনেছিলাম। যখন তিনি পদত্যাগ না করে উল্টোপাল্টা বক্তব্য দিয়ে জাতিকে ‘জলে’র পরিবর্তে ‘বেল’ দিয়ে যাচ্ছিলেন।
সোজা কথায় এটি কোনো মামুলি পদত্যাগ নয়। স্বতঃস্ফূর্ত পদত্যাগ নয়, তিনি অপসারিত হয়েছেন। একজন সৈয়দ আবুল হোসেনও পাসপোর্ট কেলেঙ্কারি বাধিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর দিন শেষ হয়ে যায়নি। তাই এখন প্রশ্ন হলো, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দিন শেষ হয়ে গেল কি না।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির শ্রদ্ধাভাজন সদস্য ছিলেন। যদিও বাহাত্তরের সংবিধানে তিনি সই করেননি। সংসদে তিনি কথায় কথায় ওয়েস্টমিনস্টার মডেল ও হাউস অব কমন্সের উদাহরণ টানতেন। সেই উদাহরণ দিয়েই বলি, গত ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ জ্বালানি ও জলবায়ু সম্পদমন্ত্রী ক্রিস হিউন পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তাঁকে তলব করার পর তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেননি। আমাদের রাজনীতির যে মান, তাতে হিউন কোনো অপরাধই করেননি। ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিস একটি মাত্র বিবৃতি দিয়েছিল। তারা বলেছিল, ২০০৩ সালের মার্চ ও মে মাসের মধ্যে তিনি দ্রুত বেগে গাড়ি চালানোর জন্য অভিযুক্ত হন। কিন্তু কর্তৃপক্ষকে হিউন (তখন মন্ত্রী ছিলেন না) বলেছিলেন, ওই সময়ে গাড়ির চালক ছিলেন তাঁর স্ত্রী। স্ত্রীও নিজেকে চালক দাবি করেছিলেন। এ জন্য মন্ত্রী হিউনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা উভয়ে বিচার-প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেন। হিউন পদত্যাগ করে বলেন, ‘আমি নির্দোষ। আদালতে লড়ব বলে মন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ালাম।’ সুরঞ্জিত জানতেন এমন ঠুনকো কারণেও মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়। কিন্তু তিনি সৈয়দ আবুল হোসেন হতে চেয়েছিলেন। গত মাসে মমতার মন বুঝে ভারতে দিনেশ ত্রিবেদী রেলমন্ত্রীর পদ ছাড়েন। সুরঞ্জিত শেখ হাসিনার মন বুঝতে পারেননি।
আরেকটি দৃষ্টান্ত দিই। গত বছর অক্টোবরে ডাকসাইটে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিয়াম ফক্স পদত্যাগ করেন। গার্ডিয়ান পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল, ফক্স তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছেন যে তাতে মন্ত্রীদের জন্য প্রণীত আচরণবিধির লঙ্ঘন ঘটে। ফক্স তাঁর এ বন্ধুকে নিয়ে ১৮ বার বিদেশ সফর করেন। ২০১০ সালে মন্ত্রিসভা গঠনের পরে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দপ্তরে ওই বন্ধু ২২ বার দেখা করেন। এর সঙ্গে একটি ভিজিটিং কার্ডের কাহিনিও আছে। এ কাহিনি বাংলাদেশের কোনো আলোচিত ভিজিটিং কার্ডের গল্পও স্মরণ করিয়ে দিতে পারে। ফক্স-বন্ধুটি তাঁর ব্যক্তিগত ভিজিটিং কার্ডে নিজেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে পরিচয় দিচ্ছিলেন। অথচ এ পরিচয়ের অনুকূলে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না।
গত বৃহস্পতিবার মাছরাঙা টিভিতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের করণীয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে এই লিয়াম ফক্সকে অনুসরণের অনুরোধ করেছিলাম। ফক্স প্রধানমন্ত্রীকে যে চিঠি লেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, সে রকম একটি চিঠি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শেখ হাসিনাকে উপহার দিতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কী কথা হয়েছে, সে বিষয়ে সেনগুপ্তের নীরবতা তাঁর অবস্থানকে কোনো স্বচ্ছতা দেয়নি। লিয়াম ফক্স প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘আমি সারা জীবন বলে এসেছি ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আজ আমার ক্ষেত্রেই তা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল। সুতরাং, আমাকেই তা বজায় রাখতে হবে। আমি ভুল করেছি, আমার ব্যক্তিস্বার্থ এবং সরকারি কার্যক্রমের মধ্যে যে পার্থক্য তাতে কালির ছিটা পড়েছে।’
কিন্তু সুরঞ্জিত আমাদের হতাশ করলেন। যে কথা নিজে বলে তিনি গৌরব করতে পারতেন, সে কথা জনগণ বলছে। গতকাল তাঁর পদত্যাগের খবরে প্রথম আলো অনলাইনের একজন পাঠকের মন্তব্য, ‘কালো বিড়াল খুঁজতে গিয়ে সুরঞ্জিত বাবুর গায়ে কালো রং মেখে গেছে।’ সৈয়দ আবুল হোসেনের মতোই সুরঞ্জিত ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে মত্ত হলেন। এখানেও তাঁর স্ববিরোধিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথম দিন তিনি ধারণা দেন, তাঁকে হেনস্তা করতে রেলের সংস্কারবিরোধীরা কলকাঠি নাড়ছেন। এরপর তিনি যথারীতি ‘গণতন্ত্র নস্যাতের’ মন্ত্র আওড়ান। প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন লিয়াম ফক্সের চিঠি পেয়ে প্রকাশ্যে বলেছেন, তাঁর বিদায়ে তিনি খুব দুঃখিত। প্রতিরক্ষা খাতের মৌলিক সংস্কারে তিনি বিরাট ভূমিকা রেখেছেন। তিনি আবার ফিরে এলে সুখী হব। সুরঞ্জিত ক্লিন হতে পারলে শেখ হাসিনা কি তাঁকে বরণ করবেন?
আগেই বলেছি, বাংলাদেশে দুর্নীতির বিচার হয় না। রাজনীতিক ও সামরিক-বেসামরিক আমলাদের কে কতজন সর্বোচ্চ আদালতে দণ্ডিত হয়ে জেল খেটেছেন, তার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করলে বাংলাদেশের নাম গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে উঠতে পারে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দুঃখ প্রকাশ করলেন না। দুঃখে, ব্যথিত চিত্তে বলি, তিনি ট্রেন ফেল করেছেন। লাইনচ্যুত ট্রেনে চেপে তিনি এখন মহানুভব হওয়ার দাবি করছেন। ধরে নিই, পিলখানা উপাখ্যানে কিছু একটা রহস্যের গন্ধ আছে। তদুপরি তাঁর গত পাঁচ দিনের বক্তব্যের অসংগতি স্পষ্ট করে যে একটি কালো বিড়াল যেন আমাদের ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
সুরঞ্জিত অবশ্য কখনো আওয়ামী লীগার হতে পারেননি। তাঁর ‘আনুগত্য’ সন্দেহাতীত ছিল না। কেন তাঁকে চলে যেতে হলো? তাহলে সরকারের লজ্জা বলে কিছু একটা আছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছিলেন, রেল ভবনকে হাওয়া ভবন হতে দেবেন না। এ কথায় শুধু দুর্নীতি নয়, বাড়তি কিছুর ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট। কারণ, হাওয়া ভবন শুধু টাকা কামানোর কারখানা ছিল না। একই সঙ্গে তা ছিল পাওয়ার হাউস। রেল ভবনের যেটা হওয়ার সুযোগ ছিল না। মলিন, বিষণ্ন বদনে সুরঞ্জিত স্বভাবসুলভ পরিহাস করতে ভোলেননি। বলেছেন, ‘বিষ খেয়ে আমি নীলকণ্ঠ হতে চাই।’
পিলখানার সেই রাতের কাহিনি সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তের জোরালো প্রতিপাদ্য হওয়া উচিত। বিএনপি নেতা এম কে আনোয়ার যথার্থই বিজিবির কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দাবি করেছেন। যদিও দুর্নীতি প্রশ্নে বিএনপির কোনো নীতি-নৈতিকতার দাবি হাসির উদ্রেক করবে, তার পরও তারা দেশের বৈধ বিরোধী দল। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সুরঞ্জিত পদত্যাগ করেছেন বলে বিরোধী দলের বাণীসেবা শেষ হয়ে যায়নি।
দেশে যদি আইনের শাসন থাকত তাহলে জাতি ইতিমধ্যেই জেনে যেত রেলমন্ত্রীর এপিএসের গাড়িতে কত টাকা ছিল? সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরীরা পাঁচ বোতল ফেনসিডিল পেলে নিজেরা বাদী হয়ে থানায় মামলা ঠুকে। এখানে তারা মামলা করল না। তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হলো। এই তথাকথিত টাকার বস্তা নাটকের তদন্ত বস্তাপচা হতে পারে, যদি বিজিবি-গেটের সেই রাতের আইনবহির্ভূত ভূমিকা জনগণের সামনে উন্মোচিত না করা হয়।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর বনেদি রাজনৈতিক ভাবমূর্তি আপাতত কলুষিত ও বিপর্যস্ত। গতকাল বেলা ১টা ২০ মিনিটে রেল ভবনে রেল-গেটের দায়দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করায় রাজনৈতিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। এখন দেখার বিষয়, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার কী ভূমিকা রাখে। কালো বিড়াল কি অন্ধকারেই থাকবে? জনগণকে যদি টাকার পরিমাণ, তার উৎস ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ফোনের রেকর্ড এবং প্রত্যেকের সম্পৃক্ততার কোনো বিষয় অবলিম্বে জানতে না দেওয়া হয়, তাহলে কিন্তু তার দায়দায়িত্ব আর যা-ই হোক অন্তত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কাঁধে চাপানো যাবে না।
তাঁর পদত্যাগের পর দুদক যদি প্রভাবমুক্ত থেকে সুষ্ঠু তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জনগণ অন্য এক কালো বিড়ালের খোঁজে নামবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.