একাত্তরের এই দিনে-মুজিব আপস করেছেন, এ কথা বিশ্বাস করি না by আইয়ুব খান

একাত্তরের মার্চে যখন স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বেলিত সমগ্র দেশ, ‘যার যা আছে তা-ই নিয়ে’ পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি বাঙালি, তখন এক হাজার ২০০ মাইল দূরে বসে সাবেক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান কীভাবে সেসব ঘটনা বিশ্লেষণ করেছেন, কীভাবে দেখেছেন মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক কিংবা ভুট্টোর আস্ফাালন—সেসব বিবৃত হয়েছে তাঁর রোজনামচায়।


মাত্র দুই বছর আগে গণ-অভ্যুত্থানে পদচ্যুত, প্রচণ্ড বাঙালিবিদ্বেষী এই শাসক ‘পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছেদকে অবশ্যম্ভাবী’ বলে মনে করেছিলেন। ক্রেইগ ব্যাক্সটার সম্পাদিত আইয়ুব খানের রোজনামচা ১৯৬৬-১৯৭২ বইয়ের নির্বাচিত অংশ অনুবাদ করেছেন এম এ মোমেন

২৬ মার্চ, শুক্রবার
ইয়াহিয়া গত রাতে (ঢাকা থেকে) করাচি ফিরে এসেছেন, ভুট্টো এখনো সেখানে। এটা স্পষ্ট, একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন নিয়ে কিংবা ভবিষ্যৎ সংবিধান কেমন হবে, তা নিয়ে মুজিবুর রহমান, ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার মধ্যে গ্রহণযোগ্য কোনো চূড়ান্ত ফয়সালা হয়নি।
আধঘণ্টার মধ্যে ইয়াহিয়া রেডিওতে ভাষণ দিচ্ছেন। তাঁর ভাষণ থেকে অবস্থা আরও কিছুটা জানা যাবে, কিন্তু বিকেল পাঁচটার খবর পূর্ব পাকিস্তানে একটি গভীর ঘোলাটে অবস্থার বিবরণ দিয়েছে এবং ঘোষণা করেছে, সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ কতগুলো কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। এবারই প্রথম এই প্রশাসন দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলল। এই শক্তি নিয়ে দেখা যাক তারা কত দূর যেতে পারে। তারা যদি সত্যিই কিছু করতে চায়, তাহলে প্রধান ষড়যন্ত্রকারী মুজিবুর রহমান, ভাসানী ও অন্যদের দেখে নিতে হবে। টিক্কা হয়তো তা করতে চাইবেন, কিন্তু ইয়াহিয়া তাঁকে কত সময়ের জন্য কতটা সমর্থন দেবেন, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে ইয়াহিয়া পিছিয়ে যেতে পারেন। কোনো রাজনৈতিক চাপ সহ্য করার মতো ক্ষমতা তাঁর নেই।
যে বিশ্বাসের বিস্তৃতি ব্যাপক, বলপ্রয়োগ কিংবা প্রতিরোধ করে তা বিনষ্ট করা যায় না। কাজেই মনে হচ্ছে, এসব কুৎসিত ব্যবস্থা ও প্রতিরোধ আসলে (পূর্ব পাকিস্তানের) বিচ্ছেদটাকেই ত্বরান্বিত করছে। পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক গোলযোগে সেনাবাহিনী অবিশ্বাস্যসংখ্যক মানুষকে হত্যা করেছে বলে গুজব রটেছে। সংখ্যাটা ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার। ঢাকায় ছাত্রদের বিরুদ্ধে বন্দুক ছাড়াও কামান ব্যবহার করা হয়েছে। ছাত্ররা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছিল। মনে হচ্ছে, ইকবাল হলকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনটাও হতে পারে, এ পরিস্থিতিতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করাই জরুরি ছিল, তবে এর একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। সেনারা দীর্ঘদিন ধরে টিটকারি ও গালাগাল শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া অবাঙালিদের ওপর পরিচালিত ভয়াবহ নৃশংসতাও তারা দেখেছে। পুলিশের সহায়তায় স্থানীয় লোকজন মিরপুর বিহারি কলোনিতে আক্রমণ চালিয়েছে। যথাসময়ে সেনাবাহিনী এসে তাদের রক্ষা করেছে, একই সঙ্গে পুলিশের ওপরও চড়াও হয়েছে।...
ভুট্টোর ব্যাপারে ইয়াহিয়ার মনোভাব বোঝা যাচ্ছে না। হয় তিনি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য ভুট্টোর ওপর ভরসা করছেন, যা একসময় ভুট্টোর কাছে প্রবঞ্চনা বলে প্রমাণিত হবে অথবা ইয়াহিয়া একটি উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন, তাঁকেও মুজিবুর রহমানের মতো দেখে নেবেন। দেশের বিবেকবান সব মানুষই মনে করেন, দেশটাকে রক্ষা করার জন্য ভুট্টো ও তাঁর প্রধান সাগরেদদের কঠোর হাতে দমন করা উচিত। ইয়াহিয়া একজন শঠ ও চতুর মানুষ, মনের ইচ্ছাকে গোপন রাখার ওস্তাদ। যদি এমন কোনো পরিকল্পনা তাঁর মনে থেকে থাকে, আমি একটুও অবাক হব না। ভুট্টোও কম ধূর্ত নন। সেনাবাহিনীর ভেতর তাঁর বৃত্তটা বাড়াতে এক মুহূর্তও দেরি করার লোক তিনি নন। বিপন্ন অবস্থায় পেলেই ইয়াহিয়াকে আক্রমণ করবেন অথবা সেনাবাহিনী যখন তাঁর ওপর আস্থা হারাবে, তখন। ইয়াহিয়ার অভ্যাস এরই মধ্যে বাহিনির ভেতর যথেষ্ট সমালোচনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার ধারণা, এ দুজনের মধ্যে যে আপাত সহযোগিতার সম্পর্ক লক্ষ করা যাচ্ছে, তা উভয়েরই সুবিধা আদায়ের সম্পর্ক, আসলে দুজনই দুজনের দিকে বাজ পাখির মতো তাকিয়ে আছেন। সুযোগ পেলেই একজন অন্যজনকে আঘাত করতে এতটুকুও ছাড় দেবেন না।
পাকিস্তানের সমস্যা নিয়ে ভারত অযাচিত আগ্রহ দেখাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি ভারতীয় সংসদে আলোচিত হয়েছে এবং এ বিষয়টি নিয়ে একটি স্পেশাল ক্যাবিনেট মিটিংও হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, মুজিবুর রহমান ও তাঁর সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া আরও ১০-১২ জনকে—যাঁদের মধ্যে মশিউর রহমান রয়েছেন—পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে আসা হয়েছে। তাঁদের আটক-দুর্গে রাখা হয়েছে। কেউ একজন বলেছেন, সরকারের চাহিদামতো যেকোনো সাংবিধানিক ব্যবস্থা মেনে নিয়ে স্বাক্ষর করতে মুজিবুর রহমান আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এ কথা আমি একবিন্দুও বিশ্বাস করি না। নেতৃত্ব ধরে রাখতে হলে এ কাজ তিনি করতে পারেন না, এমনকি এটা করলে তাঁর পক্ষে বাংলায় বেঁচে থাকাও সম্ভব হবে না। তা ছাড়া তিনি তো ছাত্র ও চরমপন্থীদের কাছে বন্দী। তাদের সম্মতি ছাড়া কিছু করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকের সময় তারাই তাঁকে কী বলতে হবে, বলে দিত। তা যে চরমপন্থী বক্তব্য, তাতে সন্দেহ নেই।
ঘটনার সময় ঢাকায় ছিলেন এমন একজনের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে আসলে কী ঘটেছিল, আর কোন কারণে ট্যাংক ব্যবহার করতে হয়েছে।
ইকবাল হল ছিল নাশকতামূলক কাজের ও চরমপন্থী ছাত্রসম্প্রদায়ের মূল আখড়া, তা ছিল পুরোদস্তুর অস্ত্রসজ্জিত। কাজেই এই হলটাকে নিরস্ত্র ও নিষ্ক্রিয় করা সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের প্রথম লক্ষ্য হয়ে ওঠে। হল দখলের জন্য এক কোম্পানি পদাতিক সেনা মোতায়েন করা হয়। তারা আক্রমণ করলে পাল্টা গোলাগুলি শুরু হয়। গুলির আঘাতে কয়েকটি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনী হলটি দখল করে নেয়।
তল্লাশির সময় দেখা যায়, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও বিস্ফোরকসহ গোটা হলই অস্ত্রে পূর্ণ ছিল। অন্যদিকে এই বিষবাষ্প ছড়ানোর উৎস ধ্বংস করে দিতেই ট্যাংক ব্যবহার করা হয়। আওয়ামীপন্থী দুটি সংবাদপত্র ইত্তেফাক ও পিপল-এর ভবন ও ছাপাখানা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। মিরপুরে অবাঙালি শরণার্থীদের যারা হত্যা করেছে, সেই পুলিশদের থানা ও থানায় অবস্থানকারীদের ওপরও অনুরূপ আক্রমণ চালানো হয়। অবাঙালিদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ও পাকিস্তানবিরোধী হওয়ার কারণে ঢাকার লাল কেল্লায় অবস্থিত রিজার্ভড পুলিশের আস্তানায়ও আক্রমণ করা হয়। (ঈষৎ সংক্ষেপিত)

No comments

Powered by Blogger.