আন্তর্জাতিক-মাই নেম ইজ খান... by ইমরান খান

শাহরুখ খান বিশ্বের এক বিখ্যাত ব্যক্তি। তাকে সাময়িকভাবে আটকাবস্থা থেকে বের করে আনার জন্য ভারতীয় দূতাবাস রয়েছে। কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষকে তো নিজেদের কল্পনাশক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র মারাত্মকভাবে আঘাত পেয়েছিল।


কিন্তু এরপর দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও জনগণই সবচেয়ে বড় সম্পদ, এই শিক্ষাটি গ্রহণ করতে পারেনি

তিনি বিশ্বের অত্যন্ত বিখ্যাত মানুষ। তার রয়েছে কোটি কোটি ভক্ত। তার চলচ্চিত্র প্রায় সময় বক্স অফিস হিট হয়। কিন্তু যখন এই বলিউড স্টার গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্র সফরে গমন করেন তখন মার্কিন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তার পরিচয় ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানার নামে তাকে দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখে।
উল্লেখ করা যায়, তার অভিনীত সবচেয়ে বড় হিট ছবির কাহিনীতে নায়ক 'আমার নাম খান এবং আমি সন্ত্রাসী নই' এই সামান্য বার্তাটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে পেঁৗছে দিতে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিল। মুক্ত ও সাহসী মানুষদের আবাসস্থলে সাধারণ মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে এই ছবিটি শক্তিশালী ভাবনা জুগিয়েছিল। তাই মার্কিন হোমল্যান্ড নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের কাছে তিনি সন্ত্রাসী নন, এ কথাটি বলে থাকলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
এ ঘটনায় তিনি ক্ষুব্ধ ও অপমানিতবোধ করছেন বলে জানিয়েছেন। তার মধ্যে কী ধরনের অনুভূতি হয়েছিল তখন সে সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা রয়েছে। গত তিন বছরে আমি অন্তত ছয়বার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছি। একবার বাদে প্রত্যেকবারই আমাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একটা স্থানে যাওয়ার জন্য বলা হয় এবং তখন আমার কাছ থেকে পাসপোর্টটি নিয়ে নেওয়া হয়। ওই ডিটেনশন সেন্টারে আপনাকে একজন বিদ্বেষী অথচ ভদ্রজনোচিত ব্যবহারের কর্মকর্তার মুখোমুখি হতে হবে। বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষমাণ কোনো প্রিয়জনের কাছে তখন আপনি ইচ্ছা করলেও টেলিফোনে যোগাযোগ করতে পারবেন না। কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা বৃথা। কারণ, সে আপনার কথায় কর্ণপাতই করবে না। আপনার মনে তখন এ প্রশ্ন উদিত হবে যে, আপনি সত্যি সত্যিই এ ধরনের ব্যবহার পাওয়ার মতো কি-না।
আমি একজন ব্রিটিশ পাকিস্তানি। আমার একটি ব্রিটিশ পাসপোর্টও আছে। ব্রিটেনেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। আমার বেশভূষাও সনাতন মুসলমানের মতো নয়। আমার ধর্ম বা ধর্মীয় পরিচিতি না থাকা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়। আমার কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ডও নেই। তারপরও আমার কাছে আমাকে একজন ক্রিমিনাল বলেই মনে হয় তখন। প্রত্যেকবার জিজ্ঞাসাবাদের জায়গায় আমি আমার চারপাশে অনেক মানুষকে বসে থাকতে দেখেছি। ক্লান্ত শিশু, নাজেহাল পিতা-মাতা কী হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। একবার আমি একজন অন্ধ মানুষকে হুইল চেয়ারে বসা অবস্থায় দেখেছি সেখানে।
কালেভদ্রে আমি সেখানে ইউরোপীয়কে দেখেছি। তবে অধিকাংশ মানুষই ছিলেন ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী। এসব লোক সাধারণত দক্ষিণ এশীয় বা আরব অরিজিনের হয়ে থাকবে। তাদের অধিকাংশই শিক্ষিত মনে হয়েছে। তাদের চেহারা, হাবভাব ও গায়ের রঙ দেখে যে কারও মনে হবে, তারা দক্ষিণ এশিয়া বা মধ্য এশিয়া বা আরব অরিজিনের। প্রত্যেকবারই আমাকে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির কর্মকর্তা আমার কাছে একই বিষয় জানতে চেয়েছেন। আমি এখানে কী করি এবং আমি কার কাছে যাব_ এসব জানতে চেয়েছেন নিরাপত্তা কর্মকর্তা। প্রত্যেকবারই তারা আমাকে বলেছেন, প্রসিডিউরটা রুটিন কাজ, যত দ্রুত সম্ভব তারা আমাকে ছেড়ে দেবেন। আমার কর্মস্থল মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র যেতে ১৪ ঘণ্টার ফ্লাইট। প্রত্যেকবারই মার্কিন বিমানবন্দরে নামার পর আমার নিজেকে ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত মনে হয়েছে। কিন্তু চিৎকার, চেঁচামেচিতে কোনো কাজ হওয়ার নয়। এসব লোক তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বই শুধু পালন করে যাচ্ছে। আমেরিকাতেই এ ধরনের সমস্যা। মুসলমানদের সঙ্গেই এ ধরনের ব্যবহার করা হয়। নিউইয়র্কের ক্যামেরাগুলোর চোখ মসজিদগুলোর ওপর নিবদ্ধ। সম্প্রতি মার্কিন সিকিউরিটি ফাইল থেকে দেখা যায়, যেসব ক্যাফেতে আল-জাজিরা টিভি দেখানো হয় সেসব জায়গা নতুন করে তদন্ত করা হয়। আমেরিকা এবং ব্রিটিশ মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এ ধরনের অনেক মানুষকে আমি দেখেছি, যারা উদ্বেগের মধ্যে কাটান। তাদের সাহায্য করা দরকার। ভালো মার্কিন নাগরিক যারা কর প্রদান করেন, ভোট দেন এবং দেশকে ভালোবাসেন, তারা কী হচ্ছে তাই নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন।
আমার এক বন্ধু রয়েছে। তার পোশাক-আশাক, চালচলন, কথাবার্তায় সে যে একজন মুসলমান নারী তা তার নাম না জেনে আন্দাজ করাও সম্ভব হবে না। একজন প্যালেস্টাইন আমেরিকান এই তরুণী এখন যুক্তরাষ্ট্রে সবসময় ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় থাকেন। তিনি আমাকে প্রায়ই বলেন, খেয়েদেয়ে নাও, কখন তারা তোমাকে গ্রেফতার করবে তা তুমি জানতেও পারবে না। সে এসব কথা বলে আমার সঙ্গে তামাশা করে। তবে এই তামাশার মধ্যেই তার মনোভাব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।
আপনি যখন আপনার নিজের দেশেই ভয়ের মধ্যে থাকেন তখন একজন নতুন আগন্তুকের অবস্থা আমেরিকায় কী হয় তা সহজেই অনুমেয়। নতুন মানুষকে পুনরায় পরীক্ষার কথা বললেই তো তার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড় হবে। আর তখন যদি বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষমাণ প্রিয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে না দেওয়া হয় তাহলে অবস্থাটি আরও সঙ্গিন হয়ে ওঠে।
শাহরুখ খান বিশ্বের এক বিখ্যাত ব্যক্তি। তাকে সাময়িকভাবে আটকাবস্থা থেকে বের করে আনার জন্য ভারতীয় দূতাবাস রয়েছে। কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষকে তো নিজেদের কল্পনাশক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র মারাত্মকভাবে আঘাত পেয়েছিল। কিন্তু এরপর দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও জনগণই সবচেয়ে বড় সম্পদ, এই শিক্ষাটি গ্রহণ করতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্রে ভবিষ্যৎ সন্ত্রাসবাদী হামলা বন্ধের জন্য অবশ্যই মুসলিম সম্প্রদায়ের ভালো মানুষদের কৃতিত্ব স্বীকার করতে হবে। তাদের নাম সন্ত্রাসবাদীদের নামের অনুরূপ হলেও তারা সন্ত্রাসবাদী স্পিরিটকে গ্রহণ করেনি।

আল-জাজিরা ব্লগ থেকে ভাষান্তর

No comments

Powered by Blogger.