স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির স্বার্থে এই আইন জরুরি-সাংসদদের আচরণবিধি

সাংসদদের আচরণ নিয়ে যখন সংসদের ভেতরে-বাইরে সরগরম আলোচনা হচ্ছে, তখন সাংসদদের আচরণবিধিসংক্রান্ত বিলটি সংসদে পেশ করার পক্ষে সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গত বছরের ১০ আগস্ট জাতীয় সংসদে সাংসদদের আচরণসম্পর্কিত একটি বেসরকারি বিল পেশ করেছিলেন সরকারদলীয় সাংসদ সাবের


হোসেন চৌধুরী। সে সময়ে অধিকাংশ সাংসদ বিলটির পক্ষে মত দিলেও বিরোধিতাকারীর সংখ্যাও কম ছিলেন না। তাঁদের আশঙ্কা, এ ধরনের বিল সাংসদদের অধিকার খর্ব করবে। পরে বিলটি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। বিলম্বে হলেও সংসদীয় কমিটি যে সংশোধিত আকারে বিলটি সংসদে পেশ করেছে, সে জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই।
সাবের হোসেন চৌধুরীর পেশ করা বিলে বলা হয়েছে, সাংসদেরা দায়িত্ব পালনকালে সাতটি নীতি অনুসরণ করবেন। এর মধ্যে রয়েছে তাঁদের দায়িত্বের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্বার্থসম্পর্কিত কিছু থাকলে প্রকাশ করবেন, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবেন, জনগণের কাছে জবাবদিহি করবেন, কাজের যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকবেন, নিজের ও পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সুবিধা লাভের জন্য সাংসদের পদ ব্যবহার করবেন না, বাইরের এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন না, যা সাংসদের দায়িত্ব পালনে প্রভাবিত করতে পারে। বিলটিতে আরও বলা হয়েছে, কোনো সাংসদ ১০ হাজার টাকা মূল্যমানের বেশি কোনো উপঢৌকন নিতে পারবেন না। যখন সাংসদদের মধ্যে সোনার নৌকা ও ধানের শীষ উপহার নেওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে, তখন এই বিল তাঁদের কিছুটা হলেও চৈতন্যোদয় ঘটাবে আশা করি।
সাংসদদের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য বিলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন মহল থেকে সাংসদদের কাজের সমালোচনা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য বেশি। যে সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য বেশি, সেই সংসদে তাঁদের স্বার্থরক্ষায় আইন হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অনেক সাংসদকে বেআইনি সুবিধা নিতেও তৎপর থাকতে দেখা যায়। সংসদের কার্যবিধিতে স্পষ্ট বলা আছে, ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত, এমন কোনো কমিটির সদস্য তাঁরা হতে পারবেন না। তার পরও বেশ কয়েকজন সাংসদ এ ধরনের কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা আছেন। এসব অনিয়ম নিরসনে সম্প্রতি কয়েকটি কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। এটিও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বলে মনে করি। সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেশি হলে আরেকটি সমস্যা দেখা যায়। তাঁরা নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে এতটা ব্যস্ত থাকেন যে অধিবেশনে কিংবা কমিটির বৈঠকে যোগ দেওয়ার সময় পান না। গত বুধবার প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, উত্তরাঞ্চলের একজন সাংসদ স্থায়ী কমিটির কোনো বৈঠকেই যোগ দেননি। এ ধরনের ব্যক্তিদের জনপ্রতিনিধি হওয়ার প্রয়োজনটা কি শুধু ভিভিআইপি ও সিপিআই সুবিধা নেওয়ার জন্য?
আমাদের প্রত্যাশা, আলোচনার পর আগামী অধিবেশনের শুরুতেই বিলটি পাস করা হবে। কেবল কাজের জবাবদিহি নয়, সাংসদদের মর্যাদা রক্ষায়ও এই বিল পাস হওয়া জরুরি। আমাদের আইনপ্রণেতারা সব দিক দিয়ে উৎকৃষ্ট আচরণ করবেন। জনগণ যে আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন রেখে জনপ্রতিনিধিদের সংসদে পাঠিয়েছেন, তার অবমূল্যায়ন তাঁরা করবেন না বলেই আমাদের বিশ্বাস। দীর্ঘদিন পর হলেও বিরোধী দল গত অধিবেশনে যোগ দিয়ে সংসদে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। সরকারি ও বিরোধী দলের উপস্থিতিতে সংসদ প্রাণবন্ত ও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হবে আর সাংসদেরা হবেন প্রকৃত অর্থেই জনগণের সেবক, এটাই দেশবাসী প্রত্যাশা করে।

No comments

Powered by Blogger.