আইএমএফ-পশ্চিমা আধিপত্য আর কত কাল? by সারাহ ওয়াইন উইলিয়ামস

ক্ষমতা যখন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না, তখন অনিবার্যভাবেই কিছু ক্ষয়ক্ষতি তৈরি হয়। দমিনিক স্ত্রস কানের উত্তরসূরি হিসেবে ক্রিস্টিন লাগার্দকে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নির্বাচনের বিষয়টি স্পষ্টতই একটি ভাঁওতাবাজি ছিল।


এর মাধ্যমে ইউরোপ ও আমেরিকা একটি অরক্ষণীয় বিষয়কে রক্ষার চেষ্টা করেছে। আর নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে বিশ্বের বাকি অংশ।
এ বিষয়টি এমন একটি সময়ে ঘটেছে, যখন আইএমএফ ও এর শক্তিশালী নেতৃত্বের বিষয়টি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে ইউরোপের বেশ কয়েকটি অর্থনীতি ধসে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে। বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষ খাদ্য ও জ্বালানি মূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য হিমশিম খাচ্ছে। এমন অবস্থায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য আইএমএফের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা মনে করি, ক্রমেই অস্থির হয়ে ওঠা দুনিয়ায় এখন এমন আইএমএফের প্রয়োজন, বিশ্বজুড়ে যার বৈধতা ও কর্তৃত্ব থাকবে। অথচ সংস্থাটির নতুন নেতা এমন একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন, যাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই একজন ইউরোপীয় আইএমএফ প্রধান হবেন। আর বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের পদটি পাবেন একজন আমেরিকান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর প্রতিষ্ঠান দুটি প্রতিষ্ঠার সময়ই এক সমঝোতার মাধ্যমে এ ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই এটি কোনো উন্মুক্ত বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। এর মাধ্যমে আইএমএফের বিশ্বাসযোগ্যতাকে খাটো করা হয়েছে।
এবার অবশ্য উন্মুক্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইএমএফ প্রধান নির্বাচনের জোরালো দাবি উঠেছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রার্থী ঘোষণার আগেই প্যারিসের কোনো বৈঠকখানা কিংবা ওয়াশিংটনের কোনো করিডর থেকে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল_ বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির নতুন নেতা কে হচ্ছেন। ফলে উন্নয়নশীল ও উঠতি শক্তিগুলোর জন্য বরাদ্দ থাকে কেবল পূর্বনির্ধারিত ব্যক্তিটির মনোনয়ন চূড়ান্ত করার আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদনের ভূমিকাটুকু। কোনোভাবেই যা পর্যাপ্ত দায়িত্ব নয়।
আইএমএফ প্রধান নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় উন্নয়নশীল দেশ ও উঠতি বাজারগুলোর ভোটাধিকার হরণের বিষয়টি নিয়ে আমাদের নেতারা একেবারেই নিশ্চুপ ছিলেন। অথচ তারা এগিয়ে এসে উঠতি শক্তিগুলোর হাতে আইএমএফের নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারতেন। এর মাধ্যমে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বৈশ্বিক সংস্থাগুলো পরিচালনা শুরুর একটি ইঙ্গিত দিতে পারতেন তারা।
দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্য দূর করার লক্ষ্য নিয়ে আইএমএফের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল অনেক দেশেই অক্সফাম কাজ করছে। আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, এ তহবিলের ঋণের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া শর্তের কারণে অনেক সময়ই এ সমস্যাগুলো আরও বৃদ্ধি পায়। আমরা মনে করি, আইএমএফের নীতি ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে মত দেওয়ার ক্ষমতা থাকা উচিত সংস্থাটির কাছ থেকে ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর। কারণ এসব নীতি ও সিদ্ধান্ত তাদের ওপরই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে।
আইএমএফের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের জন্য এমন একটি সিদ্ধান্ত হলো, গত বছর সংস্থাটির স্বর্ণের মজুদ বিক্রি থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া প্রায় ৩০০ কোটি ডলার কোন খাতে ব্যবহার করা হবে। আইএমএফ ভালোভাবেই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সময়টি পার করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের এখন বাড়তি তহবিলের প্রয়োজন নেই। অক্সফাম জোরালোভাবে মনে করে, এ টাকা তাদের কাছেই যাওয়া উচিত যাদের টাকার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি এবং যাদের ওপর এর প্রভাবও সবচেয়ে বেশি পড়বে। এর মানে হলো, উন্নয়নশীল দেশের দরিদ্র ও অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য এ বাড়তি মুনাফার টাকা ব্যবহার করা। এসব মানুষকে অবশ্য আইএমএফের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়েছে। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, ইউরোপের বোর্ড সদস্যরা এ টাকা প্রতিষ্ঠানটির তহবিলে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। কারণ সেখানে তাদের আধিপত্য রয়েছে।
এই গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ ইউরোপের হাতে রাখার 'সেকেলে' সমঝোতাটি বাদ দেওয়ার সময় এসেছে। আইএমএফে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি আর খারিজ করা চলবে না। আগামী আগস্টেই সংস্থাটির প্রথম উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালকের প্রভাবশালী পদটি খালি হতে যাচ্ছে। প্রথাগতভাবে বরাবরই একজন আমেরিকানকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবারও প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ায় না গিয়ে ওই প্রথা মেনেই পদটি পূরণ করা হবে। এ পদের মাধ্যমে আইএমএফের পরিচালনায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ঘাটতিটুকু পুষিয়ে নেওয়ার একটি বড় সুযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া আইএমএফে সংস্কারের জন্য নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ওপর অবশ্যই চাপ সৃষ্টি করা উচিত। যাতে নির্বাহী বোর্ডে ইউরোপের আধিপত্য কমে এবং অন্য সদস্য দেশগুলোর মতামত দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
আইএমএফে উঠতি বাজারগুলোর ক্ষমতায়ন মূলত প্রতিষ্ঠানটিকেই লাভবান করবে। কারণ বিষয়টি উঠতি শক্তিগুলোর ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ক্ষমতাসীনরা পুরনো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্বব্যবস্থায় তৈরি কাঠামোর মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইলে অনিবার্যভাবেই উঠতি শক্তিগুলো এ সংস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তারা এমন কোনো সংস্থায় যেতে চাইবে, যেখানে তাদের মতামত দেওয়ার সুযোগ আছে।
আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোয় কেবল ইউরোপ ও আমেরিকাই আধিপত্য বিস্তার করবে_ এ ধারণা এখন আর সমর্থনযোগ্য নয়। বরং সবার স্বার্থেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নিয়মনীতির আওতায় ক্ষমতার চর্চা হোক।

সারাহ ওয়াইন উইলিয়ামস : আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক বিষয়ক বিশ্লেষক; ইংরেজি থেকে ভাষান্তর ইব্রাহীম বিন হারুন

No comments

Powered by Blogger.