ইসরায়েলি হামলা-ইরানের সম্ভাব্য জবাব by মাহফুজার রহমান

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে উদ্বিগ্ন ইসরায়েল দেশটিতে হামলা চালিয়ে বসতে পারে বলে আশঙ্কা কোনো কোনো বিশ্লেষকের। ইরানও সে কথা জানে। হামলার শিকার হলে তারাও বসে থাকবে না। নিজেকে রক্ষা ও পাল্টা হামলার চেষ্টা করবে। ইসরায়েলের সামর্থ্য ও সম্ভাব্য হামলার কৌশলের পাশাপাশি তাই আলোচনা হচ্ছে ইরানের সম্ভাব্য জবাবের ধরন নিয়েও।


ইরানের সামরিক সক্ষমতা আঞ্চলিক পরিসরে সমীহ জাগানো হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট ইসরায়েলি সমরশক্তিকে মোকাবিলা করতে মোটেই যথেষ্ট নয়। লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) অস্ত্রবিস্তার রোধ ও নিরস্ত্রীকরণ কর্মসূচির পরিচালক মার্ক ফিটজপ্যাট্রিক বলেন, ‘ইসরায়েলে সরাসরি হামলা চালানোর সামর্থ্য ইরানের সীমিত। দেশটির বিমানবাহিনী ইসরায়েলের তুলনায় একেবারে সেকেলে। ইরানের হাতে ইসরায়েলে আঘাত হানতে সক্ষম ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যাও খুব কম।’
আইআইএসএসের এ বিশেষজ্ঞ জানালেন, ইরানের হাতে যেসব ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে তার মধ্যে আছে সাহাব-৩ ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নত সংস্করণ ঘাদার-১। এটি এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। কিন্তু তাদের এ জন্য মাত্র ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপক (লঞ্চার) রয়েছে। সাজ্জিল-২ নামের নতুন ক্ষেপণাস্ত্রটিও ইসরায়েলে পৌঁছতে সক্ষম। তবে এটি এখনো যুদ্ধে ব্যবহারের মতো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়।
ফিটজপ্যাট্রিক বলেন, ওপরের ক্ষেপণাস্ত্র দুটির একটিও প্রচলিত অস্ত্র বহন করে সামরিক লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করার মতো যথেষ্ট নিখুঁত নয়। এগুলো খুব কার্যকরভাবে রাসায়নিক বা জীবাণু অস্ত্রও বহন করতে পারবে না। আর ইরানের কাছে তো এখনো পরমাণু অস্ত্র নেই-ই। কাজেই ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হবে প্রতীকী অর্থে মাত্র।
নিজের সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে ইরান ইসরায়েলের হামলার জবাব বিকল্পভাবেও দিতে পারে বলে মনে করেন ফিটজপ্যাট্রিক। তারা অন্যদেরও মাঠে নামাতে পারে। ইরানের অন্যতম মিত্র লেবাননের কট্টরপন্থী শিয়া গোষ্ঠী হেজবুল্লাহ। হেজবুল্লাহর কাছে ১০ হাজারেরও বেশি রকেট লঞ্চার রয়েছে। এর অধিকাংশই তাদের দিয়েছে ইরান। লঞ্চারগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই ২৫ কিলোমিটার পাল্লার কাতিউশা। এ ছাড়া রয়েছে ৪৫ কিলোমিটার পাল্লার ফাহর-৩, ফজর-৫ (৭৫ কিলোমিটার), জিলজাল (২০০ কিলোমিটার) ও সম্ভাব্য ২০০ কিলোমিটার পাল্লার ফাতেহ-১০০। এ ছাড়া তাদের ১০টি স্কাড-ডি ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যার একেকটি ৭৫০ কেজি বিস্ফোরক বহনে সক্ষম। হেজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটি লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল থেকে স্কাড ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলের সব জায়গায় আঘাত করতে পারবে।
ফিটজপ্যাট্রিকের মতে, হেজবুল্লাহ ছাড়াও ফিলিস্তিনের কট্টরপন্থী দল হামাস স্বল্পপাল্লার রকেট ব্যবহার করে ইসরায়েলে হামলা চালাবে। তাই ইরানে হামলার একটি বিপদ হচ্ছে হেজবুল্লাহ বা হামাসও এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে একাধিক রণাঙ্গনে লড়তে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের বিদ্যমান চরম অস্থিতিশীলতার মধ্যে ইরানে হামলা বিশাল এক আঞ্চলিক গোলযোগের সূচনা করতে পারে।
ইরানের নৌবাহিনী এবং বিশেষ করে তার ইসলামিক রেভল্যুশন গার্ডস কোরের (আইআরজিসি) নৌ বিভাগের কাছে ক্ষুদ্র আকারের দ্রুতগতির কিছু নৌযান রয়েছে। এগুলো সাগরে মাইন পাতা বা বড় কোনো জাহাজকেও আঘাত হানতে সক্ষম। শত্রুপক্ষের যুদ্ধজাহাজে হামলায় সক্ষমস্থলে মোতায়েন ক্ষেপণাস্ত্রও আছে ইরানের। দেশটি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেল সরবরাহের প্রধান পথ হরমুজ প্রণালি বন্ধে তা ব্যবহার করতে পারে।
ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিলেও মার্কিন নৌবাহিনী তা খুলে দিতে পারবে। তবে এটা যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘায়িত নৌ সংঘাতের ঝুঁকি বাড়াবে এবং স্বল্প মেয়াদে বিশ্বে জ্বালানি তেলের দামের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
ওয়াশিংটনের ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল বাইম্যান বলেন, এক অর্থে ইসরায়েল ও ইরান ইতিমধ্যেই পরস্পরের ওপর হামলা চালিয়েছে। এতে ইসরায়েল বেশি সফল হয়েছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি ইরানের কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যার কথা উল্লেখ করেন। বাইম্যানের মতে, ভারত ও থাইল্যান্ডে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের ওপর ইরানের (অভিযোগ সেটাই) হামলা এটাই তুলে ধরে যে ইহুদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হামলার ব্যাপারে ইরান দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
তবে সব মিলিয়ে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ইরান যেকোনো হামলার জবাব দেবে খুব সাবধানে। কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ইরান বিশেষজ্ঞ করিম সাদজাদপুর বলেন, ‘ইরান ইসরায়েলে ছোটখাটো হামলা চালালে তার মুখ (মান) হারাবে, আর বড় ধরনের হামলা চালালে মাথাই হারিয়ে বসবে।’ করিমের মতে, ইরান আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলা ও বিশ্ব অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলার ওপর জোর দেওয়ার চেষ্টা করবে। কারণ, এতে করে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় বইবে। তবে তেহরান খুব সম্ভব যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি এমন আচরণ করবে না, যা ওয়াশিংটনকে তাদের ওপর বড় ধরনের হামলা করতে উসকে দিতে পারে।
করিমের মতে, ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিয়ে বা সৌদি আরবের তেলসমৃদ্ধ পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে হামলা চালিয়ে তেল সরবরাহ বিঘ্নিত করতে পারে। এটা করলে যুক্তরাষ্ট্রও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। কিন্তু এর পরিপ্রেক্ষিতে হামলার শিকার হলে ইরান অবশ্যই জাতিসংঘে যাবে। সেখানে তারা হামলার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। সেখানেই আসে একটি গুরুত্বপূণ আইনি প্রশ্ন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইরানের ওপর ইসরায়েলের আগাম হামলা আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ হবে। নটর ডেম ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক ম্যারি এলেন ও’কনেল বলেন, ইরানে হামলা চালাতে হলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমতি লাগবে। ইরান আগে ইসরায়েলে হামলা না চালালে ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা হামলা বৈধতা পাবে না। তিনি বলেন, জাতিসংঘ সনদে বলা আছে, নিজে হামলার শিকার হলে আত্মরক্ষার প্রয়োজন বা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া এক দেশ অন্য দেশের ওপর হামলা চালাতে পারবে না।
এলেন ও’কনেল বলেন, ভবিষ্যতে হামলার আশঙ্কায় কোনো দেশের ওপর আগেই হামলা চালানো কোনো বিশেষজ্ঞই সমর্থন করেন না।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে নিজের স্বার্থ ঝুঁকির সম্মুখীন হলে সব দেশ এসব যুক্তির কথা বিবেচনা নাও করতে পারে। যেমন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন না নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে এবং ন্যাটো সার্বিয়ায় হামলা চালিয়েছিল।
সম্প্রতি প্রকাশিত এ সিঙ্গেল রোল অব দ্য ডাইস-এর লেখক ত্রিতা পারসি বলেন, ইসরায়েল হামলা চালালে ইরানের অবস্থানের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটবে। দেশটি তার পরমাণু কর্মসূচি আরও গোপন করবে, অস্ত্রবিস্তার রোধ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাবে বা বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দেবে এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের প্রবেশ বন্ধ করে দেবে। এটা যুক্তরাষ্ট্রেরও ধারণা বলে উল্লেখ করেন তিনি। ত্রিতা পারসি বলেন, ‘কিছু জ্যেষ্ঠ মার্কিন সামরিক কর্মকর্তার ধারণা ইরানে হামলা হলে দেশটির দ্রুত বোমা তৈরির বিষয়টি আরও নিশ্চিত হবে।’
ত্রিতার এ সিঙ্গেল রোল অব দ্য ডাইস বইয়ের বিষয়বস্তু, প্রেসিডেন্ট ওবামার ইরান কূটনীতি।
২০০৯ সালের নির্বাচনের পর থেকে ইরানের সরকার ক্রমশ অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সেখানে জনগণের মধ্যে গভীর বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। তবে ত্রিতা পারসি মনে করেন, ইসরায়েলি হামলায় সাধারণ মানুষ হতাহত হলে ইরানের বিভক্তি মুছে গিয়ে কঠিন ঐক্য গড়ে উঠবে। সব মিলিয়ে পর্যবেক্ষকদের ধারণা, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানে আপাত সফল হামলা চালালেও তা একসময় দেশটিকে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারবে না। হামলার ফলে হয়তো ইরানের এই সক্ষমতা অর্জন কয়েক বছর পিছিয়ে যেতে পারে মাত্র। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র এখন ইরানে হামলা চালানো থেকে ইসরায়েলকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ত্রিতা পারসির মতে, ইরান সমস্যার কূটনৈতিক সমাধানের পথ এখনো নিশ্চিতভাবে বন্ধ হয়ে যায়নি। তবে গত কয়েক বছরে এ সমস্যা সমাধানে খুব কম উদ্যোগই নেওয়া হয়েছিল। সেগুলোও ছিল সংক্ষিপ্ত মেয়াদি।
 সূত্র : বিবিসি

No comments

Powered by Blogger.