অপরাধ দমন-বিচারবহির্ভূত হত্যা একটি গুরুতর রাষ্ট্রীয় সংকট by মোহীত উল আলম

নরসিংদীতে মাইক্রোবাস-আরোহী ছয়জন কথিত ‘সন্ত্রাসী’ র‌্যাবের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে মারা যাওয়ার পর নিহত ব্যক্তিদের পরিবার থেকে বলা হচ্ছে, ওরা সন্ত্রাসী ছিল না। র‌্যাবের ভাষ্যমতে, ওরা সন্ত্রাসী ছিল। নিহত লোকগুলো সন্ত্রাসী ছিল কি ছিল না—এ প্রশ্নটার নিরসন করা চেয়ার-টেবিলে বসে কলাম লিখতে থাকা একজন লেখকের পক্ষে সম্ভব নয়।


সে পথে আমি যাচ্ছিও না। আমি বরং বিনা বিচারে হত্যা সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে আমার পর্যালোচনা পেশ করব, যাতে পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারি এ চিন্তা যে এ সংকট থেকে উত্তরণের রাস্তাটি কী।
প্রথমে অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কে কয়েকটি জানা কথার পুনরুল্লেখ করব। প্রাচীন দার্শনিক অ্যারিস্টটল তাঁর রাজনীতিযুক্ত ধারণার মধ্যে এ কথাটিও বলেছিলেন যে অপরাধীকে শুধু তার অপরাধের জন্য শাস্তি দিলে হবে না, কোন পরিস্থিতিতে সে অপরাধকর্মটি সংঘটিত করেছিল, সেটিও বিবেচনার বিষয় হতে হবে। ব্যক্তি-স্বাধীনতার উদ্বোধনজাত পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অন্যতম প্রবক্তা অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিক ভোলতেয়ার বলেছিলেন, একজন নিরপরাধী লোককে বাঁচাতে হলে প্রয়োজনবশত ৯৯ জন অপরাধী লোককে ছেড়ে দিতে হবে। আইনের চোখে দুই প্রকারে অপরাধী নির্ধারণের কথা আমরা জানি: এক, অপরাধী বস্তুত অপরাধী বলে গণ্য হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নিরপরাধী প্রমাণিত হয়। গিলটি আনটিল প্রুভড ইনোসেন্ট। দুই, অপরাধী বস্তুত নিরপরাধী যতক্ষণ পর্যন্ত না সে অপরাধী প্রমাণিত হয়: ইনোসেন্ট আন্টিল প্রুভড গিলটি। পরের কথাটিই গ্রহণ করা সব সভ্য দেশে দস্তুর, বাংলাদেশেও।
তাই বাংলাদেশে অনিয়মতান্ত্রিক বা বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড বেড়ে গেলে মানবাধিকার সংস্থাগুলো শোরগোল তোলে। বস্তুত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তিও যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো, যেমন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশন্যাল, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সভায় বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষিত হচ্ছে না বলে অভিযোগ আনে। দাতা (ও দাদা) সংস্থাগুলোও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থ অনুদানের সময় মানবাধিকারের ব্যাপারে একটা শর্ত জুড়ে দেয়। সর্বময় ক্ষমতার দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যার বহির্বিশ্বে মানবাধিকার রক্ষা করার রেকর্ড নরসিংদীর চেয়েও খারাপ, সেই যুক্তরাষ্ট্রও তার বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি খুব খারাপ বলে উল্লেখ করে থাকে।
এ অবস্থায় সম্প্রতি নরসিংদীর ঘটনাটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তি এবং সরকারের প্রশাসনের চরিত্র সম্পর্কে জাতিকে নতুন উদ্বেগে ফেলেছে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র কর্তৃক বিনা বিচারে লোক কখনো মারা যাবে না—এ রকম একটি আদর্শিক সিদ্ধান্ত নিশ্চয় সংসদের খাতায় আছে। এবং ভোলতেয়ারের বাণী অনুযায়ী এখানে আইন অনুসৃত হয় বলে, অপরাধ প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় বহু দাগি আসামি আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে আসে। এ রীতিটা আগেও ছিল, কিন্তু দলীয় রাজনৈতিক সরকারের আমলে এর পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। স্বয়ং রাষ্ট্রপতির তরফ থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মুক্তি পাওয়াও দলীয় রাজনৈতিক সরকারের আমলে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। এ ছাড়া রায় কেনাবেচার অভিযোগ আছে। অপরাধকে স্বর্ণ দিয়ে মোড়াও, দেখবে বিচারের দণ্ড পাখির পালকের মতো অপরাধীকে হালকাভাবে ছোঁবে মাত্র: বলছেন শেক্সপিয়ারের রাজা লিয়ার। সাংবাদিক-দম্পতি সাগর-রুনিকে এখন মনে হয় যেন অশরীরী কোনো ঘাতক এসে হত্যা করেছে। সৌদি আরবের কূটনীতিক হত্যার কোনো একটা কূলকিনারা করতে আটজন সৌদি নিরাপত্তার লোক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন।
সাগর-রুনি হত্যা বা সৌদি কূটনীতিকের হত্যার চেয়ে নরসিংদীর হত্যাগুলো চরিত্রগতভাবে তফাত, কেননা এখানে হত্যাটা হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে। কিন্তু র‌্যাব যে বলেছে তারা আত্মরক্ষার্থে গুলি করেছে, এবং এ ব্যাপারটি করার তাদের আইনসম্মত অধিকার আছে বলেও তারা আইনের বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছে। কিন্তু আগেই বলেছি, নরসিংদীর ঘটনার ব্যাপারে প্রামাণিক কোনো কথা বলার সুযোগ আমার নেই; কারণ, আমার কাছে আইনি কোনো তথ্য নেই। কিন্তু এ ঘটনার সূত্র ধরে দেশের একটি সংকটকে নিয়ে কথা বলছি। সে জায়গায় যাচ্ছি।
ভাষার সৃষ্টি হয়েছে বলে ব্যাকরণের সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাকরণ ভাষাকে সৃষ্টি করেনি। ভাষার ব্যবহারের শৃঙ্খলাটি কীভাবে কাজ করে, সেটি ব্যাকরণ বুঝিয়ে দেয়। অর্থাৎ ব্যাকরণের ভূমিকা ভাষার ওপর কিছুটা পুলিশের ভূমিকার মতো। তেমনি সমাজে অপরাধ আছে বলে অপরাধ দমনের সংস্থাগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। আমার ধারণায় সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন কিছু প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পুলিশ একটি। সক্রেটিসকে বিষের পেয়ালা হাতে দিয়ে যে লোকটি খোলা তরবারি নিয়ে প্রহরায় দাঁড়িয়ে ছিল, সেও ছিল অ্যাথেন্সের পুলিশের লোক। তরুণ বিপ্লবী ক্ষুদিরামকে ধরে ফেলেছিল ডিবি পুলিশের লোক। কিন্তু হাজার বছরের অভিজ্ঞতায় পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষয়ে ক্ষয়ে এমন একটা জায়গায় চলে এসেছে যে ট্যাবলেটকে যেমন শক্তিশালী করার মানসে এখন নাপা প্লাস, এইস প্লাস ইত্যাদি প্রকারে বের করা হয়, তেমনি পুলিশ প্লাস করার জন্য, অর্থাৎ পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি আরও শক্তিশালী একটি বাহিনী করার জন্য আগে র‌্যাট, কোবরা, প্যান্থার ইত্যাদি বাহিনী তৈরি করার পর এখন সৃষ্টি হয়েছে র‌্যাব বা র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, যেটা টিকেও গেছে মনে হয়।
কিন্তু র‌্যাব সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত র‌্যাবের কার্যক্রম ও অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে তাদের পদচারণ নিয়ে যদি কোনো গণভোট নেওয়া হয় যে জাতি তাদের কাজে সন্তুষ্ট কি অসন্তুষ্ট, তাহলে বোঝা যেত রায় কোন দিকে যায়। র‌্যাব উঠিয়ে দেওয়া হোক—এ রকমও যদি একটি প্রশ্নের মুখোমুখি জাতি হয়, তাহলেও দেখবেন রায়টা কী আসে।
বস্তুত যেকোনো পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে র‌্যাব এবং পুলিশ কর্তৃক বহু অনিয়মতান্ত্রিক হত্যা সংঘটিত হয়েছে, আবার পাশাপাশি এ কথাটাও স্বীকার করতে হবে যে বহু কুখ্যাত সন্ত্রাসী—যারা মূর্তিমান বিভীষিকার মতো র‌্যাবের সঙ্গে হয় মুখোমুখি যুদ্ধে কিংবা ক্রসফায়ারে কিংবা এনকাউন্টারে মারা গেছে। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী নির্মূলে র‌্যাবের কার্যকর ভূমিকা তাদের প্রতি জাতির একধরনের সমর্থন ও সহানুভূতি আছে মনে হয়। সে জন্য সাধারণভাবে জনগণের মধ্যে র‌্যাব নিয়ে কখনো তুমুল বিক্ষোভ দেখা যায় না। এবং ভোটাভুটি হলে রায় কী হবে সেটাও প্রায় আঁচ করা যায়।
তবে সমস্যাটা হলো, র‌্যাব সংস্থাটি হচ্ছে একটি সচল তারের মতো। এটার কখনো কখনো শর্টসার্কিট হবেই। সন্ত্রাসী তাড়া করতে গিয়ে গুলির মুখোমুখি হলে র‌্যাব গুলি ছুড়বেই, তখন সন্ত্রাসী মারা পড়তে পারে, কিংবা সন্ত্রাসী ভেবে ভুল লোককে র‌্যাব মেরে ফেলতে পারে। র‌্যাবের কার্যক্রম পরিচালনার মধ্যে এ ভুলটির কোনো হেরফের হবে না। যদিও এ ভুলের ফলে মানবমৃত্যু অবধারিত হয়ে ওঠে, এক একটা সংসার তছনছ হয়ে যায়। সেটি দুঃখজনক, এবং র‌্যাবকে হয়তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও সতর্ক হতে বলবেন; কিন্তু পুনরায় কার্যক্ষেত্রে র‌্যাব কর্তৃক ওই ভুল লোককে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটতে পারে। র‌্যাবের পরিকাঠামোর মধ্যেই এ ভুলটার জায়গা আছে। এ কথা অবশ্য সাধারণভাবে শুধু র‌্যাবই নয়, আইন প্রয়োগকারী অন্য সংস্থার ক্ষেত্রেও খাটে। তবে অনিয়মতান্ত্রিক হত্যার ঘটনা নিয়মে পরিণত হলে তার পক্ষে কোনো সাফাই চলে না। সংশ্লিষ্ট বাহিনী তখন প্রতিষ্ঠান হিসেবেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
তবে সমস্যা শুধু র‌্যাব নয়, সমস্যা হচ্ছে অপরাধের বিচার না হওয়া পরিস্থিতিও, যা এ ধরনের সংগঠনকে একধরনের গ্রহণযোগ্যতা দেয়। প্রায় সন্ত্রাসীদের বিবরণ পড়তে গিয়ে দেখি, তারা ধরা পড়েছিল, কিন্তু জামিন পেয়ে বা নিরঙ্কুশ খালাস পেয়ে জেল থেকে বের হয়ে এসেছে। তখন ওকালতি পেশার বন্ধুবান্ধবকে জিজ্ঞেস করার রেওয়াজ: এ রকম নিশ্চিতভাবে খুনি আদালত থেকে ছাড়া পেল কীভাবে! তখন ব্যাখ্যা আসে, পুলিশ ঠিকমতো মামলা না সাজালে বিচারকের কী করার আছে! কিংবা টাকার খেলা চললে কার কী বা করার আছে। তাই বিচারব্যবস্থা ন্যায়পরায়ণ না হলে কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে স্বাধীনভাবে বিচার করতে না পারলে অপরাধ ও শাস্তি কোনোটাই ভারসাম্য রাখতে পারবে না। আইনিব্যবস্থা শিথিল হতে থাকলে অপরাধ বেড়ে যাবে, অপরাধ বেড়ে গেলে র‌্যাবের মতো পুলিশ প্লাস বাহিনীর প্রয়োজন হবে; আর মনে হবে, র‌্যাব ছাড়া বুঝি চলবে না। এমন একটি দুষ্টচক্রের আবর্তে পড়েছে দেশ।
আরেকটি জিনিস মনে রাখতে হবে: অপরাধকর্ম তার নিজস্ব চরিত্র অনুযায়ী খুব সৃজনশীল একটি কর্ম, অপরাধজগতে নিমজ্জিত ব্যক্তিরা সাধারণত কল্পনাশক্তিসম্পন্ন, মেধাবী, কৌশলী, বুদ্ধিমান, অপসাহসী ও সিদ্ধহস্ত হয়, এবং এদের সঙ্গে সমাজের উঁচুতলার যোগাযোগটা প্রায় অমোঘ, তাই এদের মোকাবিলা করার জন্য সৎ, সাহসী, মেধাবী, স্বাস্থ্যবান, ধৈর্যবান ও পরিশ্রমী লোক-সমন্বিত সংস্থা দরকার। এ দিকটা র‌্যাব খানিকটা নিশ্চিত করেছে মনে হয়। ফরাসি দার্শনিক মন্তেনকে ইংরেজ মানবতাবাদী লেখক ফ্রান্সিস বেকন তাঁর ‘অব ট্রুথ’ রচনার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখলেন, ‘অপরাধীরা হয়তো সৃষ্টিকর্তাকে ভয় পায় না, কিন্তু তারা পুলিশকে ঠিকই ভয় পায়।’ কালো পোশাকধারী র‌্যাবকে দেখে অপরাধী ভয়ে কাঁপে বলে আমার ধারণা।
আরেকটি কথা হচ্ছে র‌্যাব ব্যর্থ হচ্ছে নিচের জগতের অপরাধ দমন করতে পারছে না বলে নয়, তারা তা পারছে কমবেশি সফলতার সঙ্গে। কিন্তু তারা যেটা পারার কথা না, সেটা হচ্ছে অপরাধের উৎস তো নিচের জগতে নয়, ওপরের জগতে। সেখানে তো র‌্যাবের হাত পৌঁছাবে না।
মোহীত উল আলম, বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব এবং গল্পকার ও ঔপন্যাসিক।

No comments

Powered by Blogger.