গার্মেন্ট মালিকদের অন্যায় দাবি-শ্রম আইন মানতে বাধ্য করা হোক

লোভের কোনো সীমা নেই, থাকেও না। কবিগুরুর ভাষায়, 'রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।' আমাদের দেশের গার্মেন্ট মালিকদের অনেকেই দেশ-বিদেশে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। আরো বিত্তবৈভবের মালিক যে হবেন না, তাও নয়। কিন্তু তাঁদের এত বিত্তবৈভবের মূলে যে শ্রমিকরা,


তারা কী পায়? রক্ত পানি করা পরিশ্রমের বদলে তারা যে পারিশ্রমিক পায়, তা দিয়ে কি তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে পারে? রাষ্ট্র তাই শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় শ্রম আইন ২০০৬ প্রণয়ন করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, কম্পানির মোট মুনাফার পাঁচ শতাংশ শ্রমিকদের দিতে হবে। বাস্তবে দেখা যায়, সেটিও দেওয়া হয় না শ্রমিকদের। ফলে শাস্তির বিধান রেখে আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন গার্মেন্ট মালিকরা উঠে পড়ে লেগেছেন, গার্মেন্ট কারখানাকে এ আইনের বাইরে নিয়ে যেতে। তাঁরা গার্মেন্ট কারখানার জন্য আলাদা শ্রম আইনের দাবি জানিয়েছেন, যাতে শ্রমিকদের জন্য পাঁচ শতাংশ মুনাফা প্রদানের কোনো বিধান থাকবে না। এ কেমন মানসিকতা! ১০০ টাকা মুনাফা থেকে মাত্র পাঁচটি টাকা শ্রমিকদের দিতে তাঁদের এত আপত্তি কেন?
গার্মেন্ট কারখানার একজন শ্রমিক দৈনিক ১৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করে মাসে যে অর্থ পায়, তা দিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায় না। বস্তির ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। সেই ঘরভাড়া ও অতি নিম্নমানের খাবার জোটাতেই চলে যায় বেতনের পুরোটা। গ্রামে থাকা মা-বাবা কিংবা পরিবারকে সহযোগিতা করা তো দূরে থাক, তেল-সাবান আর কাপড়চোপড়ের মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার ক্ষমতাও তাদের থাকে না। এ চিত্র দেশের অধিকাংশ গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিকদের। অথচ রাষ্ট্র সেসব গার্মেন্ট কারখানার মালিকদের বিস্তর সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চলেছে।
রামপুরার একটি গার্মেন্টে কর্মরত একজন নারীশ্রমিক জানায়, ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। ছুটি নেই। এর পরও মাস শেষে বেতন পায় মাত্র তিন হাজার ৭০০ টাকা। বস্তির ঘরে একটি সিটের জন্য তাকে দিতে হয় এক হাজার ২০০ টাকা। বাকি আড়াই হাজার টাকায় মাছ-মাংস দূরে থাক, ভালো কোনো সবজি দিয়েও খাবার জোটানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। আবার বাড়িতে মা-বাবা চেয়ে থাকেন তার দিকে। ছোট ভাইবোনও আশায় থাকে। বাড়িতে ৫০০ টাকা পাঠাতে গেলেও তাকে উপোস করে টাকা জমাতে হয়। এ রকম অবস্থায় থাকা শ্রমিকদের জন্য মুনাফার মাত্র পাঁচ শতাংশ ছেড়ে দিতে মালিকদের এত আপত্তি কেন? অথচ পোশাকশিল্পের মালিকরা দেশের বিত্তবানদের শীর্ষ সারিতে চলে এসেছেন। সরকারও তাদের নানাভাবে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ আছে, শ্রমিকদের জন্য গৃহনির্মাণের নাম করে অনেক মালিক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে সেই অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করেছেন। শুল্ক ও কর রেয়াত তো আছেই। দেশের কোনো নাগরিক বিপদে পড়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে তাঁকে কমপক্ষে ১৮ শতাংশ সুদ দিতে হয়, আর রপ্তানি খাত হওয়ায় গার্মেন্ট মালিকরা ব্যাংক থেকে মাত্র সাত শতাংশ সুদে ঋণ পেয়ে যান। এমনই ছাড় তাঁদের আরো অনেক ক্ষেত্রেই দেওয়া হচ্ছে। এর পরও একজন শ্রমিকের জন্য মুনাফার অতি সামান্য একটি অংশ ছাড়তে তাঁদের এত কার্পণ্য কেন? তাঁরা যদি এতটাই নিজের স্বার্থ দেখবেন, তাহলে রাষ্ট্র কেন জনগণের অর্থ থেকে মালিকদের এত সুযোগ-সুবিধা দেবে। আমরা চাই, সরকার তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকুক।

No comments

Powered by Blogger.