চারুশিল্প-প্রকৃতির সুর by সিলভিয়া নাজনীন

অসুর এবং সুরের দ্বন্দ্বের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে সভ্যতার এগিয়ে চলার মন্ত্র। অবশ্য কালের বিবর্তনে তৈরি হয় অসুরের সুর আর সুরের অসুরে রূপান্তরিত হওয়ার আখ্যান। সময় হিসেবি বৃদ্ধের মতো সবকিছুকেই তার সঠিক পাওনা বুঝিয়ে দেয়। শিল্পকলার সুদীর্ঘ ইতিহাসে সময়ের এই প্রবণতা ধারাবাহিকভাবেই পাঠ করা যায়।


সম্প্রতি গুলশানের বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে শুরু হয়েছে শিল্পী কাজী গিয়াসউদ্দীনের ‘সাউন্ড অব নেচার’ শীর্ষক প্রদর্শনী। নির্বস্তুক শিল্পচর্চায়ই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, আপাতদৃষ্টিতে বিমূর্ততাই তার আরাধ্য বলে মনে হয়। যদিও তিনি বলেন, ‘আমার শিল্পকর্ম ভীষণভাবে রিয়েলিস্টিক, আমি নেচারকে অনুভব করি এবং কাগজ-রঙের খেলায় মেতে উঠি।’
শিল্পভুবনে কাজী গিয়াসের দীর্ঘদিনের বিচরণ। তাঁর শিল্পজমিনে বাংলার প্রকৃতির ঘ্রাণ দর্শকদের খুঁজতে বলেন। দীর্ঘদিন জাপানে বসবাস করেও শিল্পী গিয়াসের মনোজগতে সেখানকার পরিবেশ তেমন কোনো প্রভাবক হিসেবে কাজ করেনি বলে শিল্পীর ধারণা। অথচ গিয়াসের এই প্রদর্শনীর শিল্পকর্মে দর্শক যে রঙের ব্যবহার দেখতে পায় তা বাংলার রং কি না সে প্রশ্ন থেকেই যায়; শাশ্বত বাংলার লাবণ্যময় উচ্ছল প্রকৃতি ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়ে নতুন স্নিগ্ধ রূপে মগ্ন হয়। ষড়্ঋতুর এই নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে রঙের যেমন বহুবিধ বর্ণিল আয়োজন পৃথিবীতে তেমন উজ্জ্বল-উচ্ছল প্রকৃতির দেখা মেলা ভার। মলিন-কালো-পোড়ামাটির ঐতিহ্য বা বিষণ্ন-ধূসর রঙের প্রকৃতি আমাদের জলবায়ুর অপ্রধান এবং গৌণ দিক। কিন্তু শিল্পী গিয়াসের চিত্রতল আমাদের অপরিচিত এক জগতের সামনে এনে দাঁড় করায়; যে জগৎ আর যাই হোক বাংলাকে মনে করার পেছনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।
বাংলাদেশের কথিত আধুনিক শিল্পকলার শুরু জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্নতার সূত্রেই। মনোজগতে প্রশ্নের উদ্রেক তৈরি করে না, শিল্পে সৌন্দর্য সৃষ্টি, গ্যালারিকেন্দ্রিক শিল্পচর্চা বা বিশেষ শ্রেণীর জন্য শিল্পকর্ম সৃজন—এ সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয় এ দেশের নির্বস্তুক বা অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টে। এদেশের বিমূর্তবাদিতার জন্ম এবং চর্চা পাশ্চাত্য থেকে ভিন্ন; বাংলার শিল্পীরা সাধারণ সামাজিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত থাকলেও নানা কারণে নানা দেশে পাড়ি জমিয়ে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ এবং নতুন ধরনের শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই সময়ে তাদের জগৎ নির্মিত হয় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে। জীবন হয়ে যায় আত্মকেন্দ্রিক, শিল্পে আচ্ছন্ন হলেও সেই শিল্প আদৌ জীবনের টানাপোড়েনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় কি না তা ভাবার অবকাশ থেকে যায়। যদিও ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ নামক তকমায় এই শিল্পধারাকে এক ধরনের মাহাত্ম্য দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবুও বলা যায়, এই ধারণা অন্তত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অযাচিত, অপ্রত্যাশিত ও বিভ্রান্তিকর। বিমূর্ত শিল্পকে মূর্ত কোনো কিছুর সঙ্গে মিলিয়ে দেখার প্রবণতা রয়েছে এ দেশের শিল্পীদের; যা এক ধরনের স্ববিরোধিতা। বিমূর্ত শিল্পে সাংগীতিক মূর্ছনা প্রধান আরাধ্য হয়ে ওঠে যুগে যুগে। বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি, বৃষ্টির শব্দ, মাটির ঘ্রাণ, নিসর্গের একাকিত্ব শিল্পে উপস্থাপিত হয় বিমূর্ত রূপে।
শিল্পী গিয়াসের শিল্পকর্মে টেক্সচার, ওয়াশ, রেখা, রং, ফর্মের একাকার হয়ে যাওয়ার প্রবণতা ভীষণ দৃষ্টিনন্দন। মাধ্যমকে যথাযথ উপভোগ করা আর ব্যবহার করার মুনশিয়ানা চোখে পড়ে। শিল্পমাধ্যম হিসেবে কাগজ ও তেলরংকে তিনি বেছে নিয়েছেন। তাঁর শিল্পকর্মে তেলরংকে জলরঙের মতো উপযোগী বা বিভ্রম তৈরি করার ক্ষমতা বিস্মিত করে দর্শকদের। শিল্পকর্মে কখনোবা সূক্ষ্ম ডিটেইল চোখে পড়ে। এই ডিটেইলে হয়তো কোনো পাখি-ঘর-গাছ এমন কিছু বিষয় দেখা যায়; যা পরিচিত ফর্মের প্রতিনিধিত্ব করে।
অটাম, আননোন স্টোরি, ইন দ্য ফরেস্ট, ব্লু মাউন্টেইন, মাই ড্রিম, ইলুশন এমন শিরোনামের শিল্পকর্মে শিল্পীর ভাবনার খানিকটা হয়তো দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে।
‘শিল্পকর্মের ভালো-মন্দ আমি জানি না; তবে তা সুন্দর হচ্ছে কি না, এটাই মূল বিষয় আমার’—এভাবেই শিল্পী তাঁর শিল্পকর্মকে বর্ণনা করতে পছন্দ করেন।

শিল্পী কাজী গিয়াসউদ্দীন: জন্ম ১৯৫১ সালে মাদারীপুর জেলায়। ১৯৭০ সালে বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বিএফএ এবং ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএফএ করেন। জাপান থেকে তিনি ১৯৮৫ সালে পিএইচডি করেন। তিনি বহু একক এবং যৌথ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.