ইতিহাসের পথ ধরে-হরিকেল থেকে চট্টগ্রাম

কত পুরনো আজকের চট্টগ্রাম? অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু ইতিহাস বলছে, চৌদ্দ শ বছরের প্রাচীন শহরের নাম চট্টগ্রাম। ‘অদম্য চট্টগ্রাম উৎসব’ শিরোনামে ডেইলি স্টার আয়োজিত প্রদর্শনী আলোকে এই রচনা। লিখেছেন বিশ্বজিৎ চৌধুরী অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু ইতিহাস বলছে, চৌদ্দ শ বছরের এক প্রাচীন শহরের নাম চট্টগ্রাম।


আমরা জানি, ৯০০ বছরের প্রবীণ নগর লন্ডন, আমাদের রাজধানী ঢাকার রয়েছে ৪০০ বছরের ইতিহাস; আর বছর কয়েক আগে ৩০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বর্ণময় উৎসবের আয়োজন হয়েছিল কলকাতা নগরে। চট্টগ্রামের ইতিহাস এই প্রসিদ্ধ নগরগুলোর চেয়েও দীর্ঘ।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ইৎসিঙ নামের একজন চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রথম উল্লেখ করেন ভারতের পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলে হরিকেল নামে একটি রাজ্য আছে। এই ‘হরিকেল’ই যে চট্টগ্রাম, এই তথ্য উঠে আসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বিএন মুখার্জির গবেষণায়। এই খ্যাতিমান মুদ্রাবিশারদ হরিকেল রাজ্যে প্রচলিত মুদ্রা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হন, সমৃদ্ধ এই রাজ্য ছিল কর্ণফুলী নদীর তীরে, যা কালক্রমে চট্টগ্রাম নামে পরিচিতি পায়। বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের জার্নালে এ তথ্য প্রকাশ করেন তিনি।
আরাকান, ত্রিপুরা ও মোগল—এই তিন রাজশক্তির লড়াইয়ের ক্ষেত্র ছিল চট্টগ্রাম। বহুকাল চলেছে এই দখল প্রতিষ্ঠার লড়াই। মোগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মুনিম খান ১৫৭৫ সালের ৩ মার্চ আফগান শাসক দাউদ খার কররানীকে পরাজিত করলে মোগল সাম্রাজ্যের অধিকারে আসে বাংলা। কিন্তু এরপর আরও প্রায় ৮০ বছর পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে যায় অধরা। অবশেষে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি ‘কর্ণফুলীর যুদ্ধে’ মোগল নৌবাহিনী জয়লাভ করে। আসলে এই লড়াই ও জয়ের মধ্য দিয়েই বঙ্গ বা বাংলার সঙ্গে যুক্ত হয় চট্টগ্রাম। ‘কর্ণফুলীর যুদ্ধে’ মোগলদের জয় নৌ-বাণিজ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে, পাশাপাশি এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতাও প্রতিষ্ঠিত হয়।
মোগলেরা চট্টগ্রামের নাম দেয় ‘ইসলামাবাদ’। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, চন্দনপুরা, জামাল খাঁ, ঘাটফরহাদবেগ, বকশীর হাট, সদরঘাট, বিবিরহাট প্রভৃতি এলাকার নামের মধ্যে যেমন মোগল প্রভাব দেখা যায়, তেমনি এ এলাকাগুলোর প্রকৃত পরিচর্যাও হয়েছে মোগল আমলে। এভাবেই আধুনিক চেহারা পাচ্ছিল একটি শহর।
১৭৬০ সালে মীর কাশিম আলী খানের কাছ থেকে এ অঞ্চলটি অধিগ্রহণ করে ব্রিটিশরা এর নাম দেয় ‘চিটাগাং’, সাধারণের কাছে যা চট্টগ্রাম বা চাটিগাঁও নামে পরিচিতি পায়।
বিভিন্ন সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলটি আরাকানি, ত্রিপুরি, পর্তুগিজ, মোগল, পাঠান ও ইংরেজদের হাতে শাসিত হওয়ায় এখানকার কৃষ্টি, শিক্ষা, সমাজ, সংস্কৃতির মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে আলাদা। অনেকেই বলেন, বাংলার চিরায়ত লোকশিল্পের নিদর্শন নকশি কাঁথার ঐতিহ্য যেমন এ অঞ্চলে ছিল না, তেমনি এখানকার মানুষের প্রিয় খাদ্য শুঁটকিও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের খাদ্যতালিকায় যুক্ত হয়েছে অনেক পরে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পিঠাপুলির ঐতিহ্যও এখানে ছিল না, বরং চট্টগ্রামের মানুষ বেলা বিস্কুটের স্বাদে মজে ছিল দীর্ঘদিন।
আরাকানের রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের যে খুব কদর হয়েছিল, তার পেছনে ছিল চট্টগ্রাম থেকে কবিদের সেখানে যাতায়াত। কোরেশী মাগন ঠাকুর বা দৌলত কাজীর মতো কবি, যাঁরা আরাকান রাজসভা আলোকিত করেছিলেন, তাঁদের আদিবাস চট্টগ্রামে। মহাকবি আলাওলের জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক আছে, তবে তিনি যে দীর্ঘকাল চট্টগ্রামে ছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। তাই তাঁর পদ্মাবতী কাব্যের পটভূমি যদিও সিংহল, কিন্তু প্রকৃতির বর্ণনায় কবি যেসব স্থান ও দৃশ্যের কথা তুলে ধরেছেন, তাতে চট্টগ্রামের রূপই যেন ভেসে ওঠে পাঠকের চোখে।
চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাস আরও দীর্ঘ। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বন্দর চট্টগ্রামের উত্থান। সপ্তম শতাব্দীর পর থেকে বাংলার (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ) আরেকটি বন্দর তমলুক বা তাম্রলিপি বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু হরিকেল রাজ্যটির ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও এর সমুদ্রবন্দর দিয়ে ব্যাপক আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা প্রসারিত হওয়ায় আরব ভূগোলবিদেরা তখন এর মাটি ছুঁয়ে থাকা বঙ্গোপসাগরকে ‘বহর-এ-হরকন্দ’ (হরিকেলের সমুদ্র) নাম দিয়েছিলেন। সেই বহর-এ-হরকন্দই দীর্ঘ ইতিহাস পাড়ি দিয়ে টিকে আছে চট্টগ্রাম বন্দর নামে।
পেছনে ফেলে আসা পায়ের চিহ্নগুলো না চিনে সামনের পথ পাড়ি দেওয়া যেমন কঠিন, তেমনি অতীত না জেনে ভবিষ্যতের দিকে এগোলে ইতিহাস হয়তো প্রশ্ন করবে, ‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’
প্রাচীন এই নগরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য তুলে ধরে এর সম্ভাবনার বিষয়ে নতুন প্রজন্মকে সচেতন করার এক অসাধারণ উদ্যোগ নিয়েছে সম্প্রতি ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার। ‘অদম্য চট্টগ্রাম উৎসব’ শিরোনামে ডেইলি স্টার-এর এই নানা মাত্রিক আয়োজনের মধ্যে ‘ইতিহাস ঐতিহ্য’ অংশে ছিল এক চমৎকার প্রদর্শনী। চট্টগ্রাম জিমনেসিয়ামে অনুষ্ঠিত চিরায়ত চট্টগ্রাম নামের এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে প্রায় ৭৭টি দুর্লভ আলোকচিত্র, যা দেখতে দেখতে দর্শনার্থীরা ঘুরে আসবে ইতিহাসের দীর্ঘ পথ হরিকেল থেকে চট্টগ্রাম। আরও আছে এ অঞ্চলের প্রাগৈতিহাসিক জীবনের ওপর শিল্পী কাজল দেবনাথের তৈরি একটি ত্রিমাত্রিক মডেল, শিল্পী আলপ্তগীন তুষারের চিত্রকর্ম ‘কর্ণফুলীর যুদ্ধ’ এবং মোগল আমলা হামজা খাঁর সমাধিসৌধের একটি মডেল।
প্রদর্শনী শুরু হওয়ার আগে চট্টগ্রামের ২৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী অংশ নিয়েছিল ‘জার্নি টু হেরিটেজ’-এ। শাহি জামে মসজিদসহ আন্দরকিল্লার ঐতিহাসিক নগর কেন্দ্র ঘুরে দেখে শিক্ষার্থীরা। দক্ষ গাইডের প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় তাদের চোখের সামনে তখন ভাসছিল: ‘কর্ণফুলী নদীতীরে দুটি দুর্গ ছিল—একটি নদীর মোহনার বাঁ দিকে দেয়াং পাহাড়ে, অন্যটি ডান পাশে রংমহল পাহাড় ও তার আশপাশে বর্তমান চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডে...।’
বিস্ময়াভিভূত একটি কিশোর হয়তো তখন ভাবছে, ক-ত দূর থেকে এসেছি আমরা, যেতে হবে আরও ক-ত দূর!

No comments

Powered by Blogger.