জিম্বাবুয়েতে দিনযাপন-প্রপাতে পাণ্ডুলিপি পাচার by মঈনুস সুলতান

বুলাওয়ের রেলওয়ে স্টেশন থেকে বিস্তর বাষ্প ছড়িয়ে আগুনের গনগনে আঁচে ফুলকির ফুলঝুরি উড়িয়ে স্টিম ইঞ্জিনখানা অনেকক্ষণ ধরে প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে ঝিকঝিক করে। তারপর দীর্ঘ ভেঁপু বাজালে রেলগাড়ির গার্ড, টিকিট চেকার, লাইন্সম্যান গয়রহ কাঁধে করে নিয়ে আসেন ড্রাইভারের কফিন।


ষাট-পঁয়ষট্টি বছরের পুরোনো ব্রিটিশ আমলের বগিগুলোতে আজ বিজলিবাতির কোনো বন্দোবস্ত হয়নি। রেলকর্মীরা খুব ইজ্জতের সঙ্গে ট্রেন ড্রাইভারের এইডস রোগে মৃত লাশ হ্যাজাকের আলোয় সেলান-কারে রাখলে আজকে রেলগাড়িটি ভিক্টোরিয়া ফলস অবধি কীভাবে যাবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। জিম্বাবুয়েতে তেল, মবিল ও ডিজেলের তীব্র কাহাতের ফলে হালফিল রেলওয়ে-শেড থেকে বের করে ২৩ বছর আগে বাতিল হওয়া স্টিম ইঞ্জিনকে এ লাইনে চালু করা হয়েছে। নিগ্রো প্রজাতির আদমের আওলাদদের গাত্র বর্ণের চেয়েও কয়েক বিঘত কালো এ ইঞ্জিন চালাতে ডিজেল-পেট্রলের প্রয়োজন নেই একবিন্দু। কাঠকয়লা দিয়ে কাজ চালানো যায়। তবে ড্রাইভার সদ্য মরহুম হওয়াতে কি সংকটের সৃষ্টি হলো?
আমার আমেরিকান সহযাত্রী ক্রিস্টিনা রথরক সেকেন্ড ক্লাস বগির ঝুপসি অন্ধকারে-রোডেশিয়ান রিজব্যাক গোত্রের একটি অন্ধ কুকুরকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। সে চিসোওনা ভাষায় বিড়বিড় করে, ‘চিনহু চিনো মুতাংগিরো..’ বা ‘যাত্রা খারাপভাবে শুরু হলে কপালে আজ গর্দিস আছে।’ খালি গায়ে মুখোশ পরা এক লোক জংলি জানোয়ারের শিঙা বাজাতে বাজাতে জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। তার পেছনে কেরোসিনের কুপি হাতে সাদা হ্যাটকোট পরা ট্রেনের গার্ড। তিনি মুখোশধারীকে রেলগাড়ির সহকারী ড্রাইভার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আশ্বস্ত করেন—তিনি যেহেতু জিন্দা আছেন, রেলগাড়ি অবশ্যই ভিক্টোরিয়া ফলস্ ইস্তক যাবে। তবে কিনা যে ড্রাইভার ষোলো বছর সাত মাস যাত্রীদের পারাপার করেছেন, তাঁর মৃতদেহের প্রতি যদি একটু ইজ্জত দেখান? লাল-সবুজ নিশান বগলে নিয়ে আরেকজন রেলকর্মী বাড়িয়ে ধরেন বেতে বোনা ‘চিমা’ চাঙারি। কারও মৃত্যু হলে মাসোওনা-সংস্কৃতিতে তাকে সম্মান জানানোর জন্য চিমার চাঙারিতে ফলমূল, পানীয় ও টাকা দেওয়ার রেওয়াজ আছে। কিছু যাত্রী তাতে বিস্কুট, পাউরুটি, টাকা ও বিয়ারের ক্যান রেখেছেন। ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির ক্রিস্টিনা অনেক দিন হলো জিম্বাবুয়েতে আছে। গবেষণার উপাত্ত সংগ্রহের জন্য সে চিসোওনা ভাষা বেশ ভালোই শিখেছে। চিমাজাতীয় মৃত্যু-পরবর্তী আচার-বিচারের সঙ্গেও তার পরিচয় আছে। তাই জানালা দিয়ে গলা বের করে দুটি মার্কিন ডলার চিমা চাঙারিতে ফেললে—অন্ধ কুকুর উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করে। সারমেয়টি যারপরনাই বৃদ্ধ, জীবন সম্পর্কে তার উৎসাহ কম হলেও প্ল্যাটফর্মে কী ঘটছে, সে বাবদে একেবারে অনাগ্রহী নয়। ক্রিস্টিনা বকলস টেনে কুকুর সামলাতে গেলে কুপির আলোয় আমি তার বিভ্রান্ত মুখ দেখি।
দুপুর সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমরা ভিক্টোরিয়া ফলস্ শহরে পৌঁছে যাই। জলপ্রপাত এখান থেকে অল্প দূরে জাম্বেসি নদীর দক্ষিণ পাড়জুড়ে। এ শহরে কিছু গাছের পাতা এ ঋতুতেও সবুজ, তাতে লুকোচুরি খেলছে বেজায় বড় ঠোঁটের হর্নবিল পাখি। আমরা ১৯০৪ সালে তৈরি এডওয়াডিয়ান স্থাপত্যের ভিক্টোরিয়া ফলস্ হোটেলের সামনে একটু দাঁড়াই। জিম্বাবুয়েতে আড়াই মাসের মতো হলো সাহায্যকারী ত্রাণ সংস্থাগুলোর এইড ওয়ার্ক বাতিল হয়েছে। দেশের শাসক রবার্ট মুগাবে চান না, রিলিফ-জাতীয় কাজের মাধ্যমে কোনো শ্বেতাঙ্গ এ দেশে থেকে পাশ্চাত্যে তথ্য পাচার করে। আমি ও ক্রিস্টিনা দুজনে রোজিরোজগারের ধান্দা হিসেবে রিলিফের সংস্থায় কনসালটেন্সি করে থাকি। আর্থিকভাবে আমাদের দিনকালে মঙ্গা যাচ্ছে, পকেটে কিমতি খুবই কম, সুতরাং ভিক্টোরিয়া ফলস্ হোটেলে ঢুকে পড়ে অমলেট-সহযোগে মুড়মুড়ে টোস্টের সঙ্গে এক পেয়ালা গর্মাগ্রম কফি খাওয়ার কোনো উপায় নেই।
বুলাওয়ে থেকে আসার পথে রেলগাড়িতে বাতি ছিল না, তাই ডাইনিং কার অব্দি হেঁটে গিয়ে ডিনার খাওয়া হয়ে ওঠেনি। মাঝরাতে মৃত ড্রাইভারের গাঁয়ে ট্রেন থেমেছিল। তার কওমের খেশ-আকারিবরা মশালের আলোয় কেঁদেকেটে শিঙা বাজিয়ে লাশ নামিয়ে নিয়ে গেছে। ভোরে ঘণ্টা খানেকের মতো ট্রেন থেমেছিল যবখেতের পাশে। কৃষ্ণাঙ্গ যাত্রীরা ঝোপঝাড়ে প্রাতঃকৃত্য করতে গেলে ডাইনিং কারের বাবুর্চি নেমে গ্রাম থেকে কিনে এনেছিল বুনোহাঁসের তাজা ডিম। তা সংখ্যায় এত কম ছিল যে, সকলের পাতে দেওয়া সম্ভব হয়নি। সুতরাং, আমি ও ক্রিস্টিনা একরকম উপাস করে আছি।
আমি ক্রিস্টিনার আমন্ত্রণে তার সঙ্গে ভিক্টোরিয়া ফলসে যাচ্ছি। তার পকেটে যে রেস্ত কম, তা গেলরাতে বুঝতে পেরেছি, সে যখন বারো ডলার দিয়ে ফার্স্ট ক্লাসের পরিবর্তে আট ডলার দিয়ে সেকেন্ড ক্লাস কুপের টিকিট কিনে। জিম্বাবুয়েতে সে ‘রাইটার্স রোল ইন সিভিল সোসাইটি’র ওপর গবেষণা শুরু করছে। ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির যে গ্র্যান্ট থেকে স্কলারশিপ পাচ্ছিল, তা বাজেট কাটের জন্য আর এক্সটেনশন হয়নি। তাই মাস সাতেক হলো সে স্কলারশিপ থেকে কিছু পাচ্ছে না। সাহায্যকারী সংস্থায় ছুটছাট যে কনসালটেন্সি করছিল, সে কূপের জলও এবার শুকিয়েছে। যতটা জানি, সে অন্ডি কনরাড বলে এক শ্বেতাঙ্গ ফার্মারকে আজকাল সাহায্য করছে। বছর কয়েক আগেও মি. কনরাড ১১,০০০ একরের টোব্যাকো ফার্মের মালিক ছিলেন। বর্তমানে তাঁর তাবৎ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে খামারটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের জানুপিএফ পার্টির হার্ডকোর ক্যাডারদের হাতে। বিপত্নীক মি. কনরাডের ছেলেমেয়েরা পৈতৃক সয়সম্পত্তি হারিয়ে বিলাত ফিরে গেলে তিনি হারারেতেই থেকে যান। মাসোওনা গোত্রের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে শ্বেতাঙ্গ ফার্মাররা সাধারণত অপ্রিয় হলেও মি. কনরাড এর ব্যতিক্রম। তিনি তারুণ্যে কিছু বইপত্র লিখেছিলেন, তাতে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারের প্রসঙ্গ ছিল বলে তারা তাঁকে সম্মান করে বলে ‘মুনইয়োরি’ বা ‘লেখক’। হারারে শহরের বরোডেইল এলাকায় পাঁচ একরের উইন্ডমিলওয়ালা যে ভিলাতে তিনি বংশানুক্রমে বাস করতেন, তাতে রবার্ট মুগাবের কনিষ্ঠা স্ত্রীর এক আত্মীয় পর্যটক শোভন গেস্টহাউস বানিয়েছে। সে অবশ্য মি. কনরাডকে বাড়ি থেকে একেবারে উৎখাত করেনি। তিনি এখনো বাগানে কেয়ারটেকারের কোয়ার্টারে বাস করছেন। ইদানীং বৃদ্ধ কনরাড লাঠি ভর দিয়ে থুরথুরিয়ে তাঁর পোষা অন্ধ রোডেশিয়ান রিজব্যাক প্রজাতির কুকুরকে সড়কে হাঁটান।
হারারে শহরে আজকাল ডগ-ফুড একেবারে পাওয়া যাচ্ছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধ ও পথ্যের অভাবে মি. কনরাডের স্বাস্থ্যও ভেঙে যাচ্ছে দ্রুত। জিম্বাবুয়েতে জন্মানো এ শ্বেতাঙ্গ তার পূর্বপুরুষের দেশ বিলাতেও ফিরতে চান না। হারারের সেমিটারিতে তিনি দেহরক্ষা করবেন বলে পণ করেছেন। অন্ধ কুকুরটি তাঁর একমাত্র সঙ্গী। কিন্তু তিনি আর তার খাবার জোগাতে পারছেন না। সুতরাং, ক্রিস্টিনা কুকুরটিকে আজ নিয়ে যাবে বর্ডার ক্রস করে ওপারে জাম্বিয়ার লিভিংস্টোন শহরে। মি. কনরাডের দৌহিত্র ওখানে মাইক্রোলাইট বলে একধরনের হালকা বিমানের পাইলট। সে তার মাতামহকে কুকুরটির দেখভালের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বর্ডারে শ্বেতাঙ্গদের ব্যাগ-বোঁচকা ও শরীরে জোর তল্লাশি হয়। তাই ক্রিস্টিনা আমাকে এ যাত্রায় তার সাথি হতে বলেছে। একজন শ্বেতাঙ্গ তরুণী কুকুরের বকলস ধরে পর্যটকে ভরপুর বর্ডার পাড়ি দিচ্ছে—এ দৃশ্য স্বাভাবিক। তবে সে মি. কনরাডের লেখা একটি পাণ্ডুলিপির টাইপ করা কপি তার দৌহিত্রের কাছে পৌঁছে দিতে চায়। তার ব্যাকপ্যাক সার্চ হতে পারে। তাই আমি এগুলো ক্যারি করতে রাজি হয়েছি। টাইপ করা পাণ্ডুলিপি স্কেন করে অ্যাটাচমেন্টে পাঠানো রিস্কি। বিষয়টি জানাজানি হলে সকলকে যেতে হবে জেলে। আমি পাণ্ডুলিপি লুকিয়ে রেখেছি আমার বাংলা লেখাজোখার ভেতর। আমি দৃশ্যত ইন্ডিয়ানদের মতো বলে আমার মালমাত্তায় তল্লাশি হওয়ার সম্ভাবনা কম। রিস্ক একটু আছে বটে। বমাল ধরা পড়ার বিষয় ভেবে কি ক্রিস্টিনা ভেতরে ভেতরে নার্ভাস হয়ে আছে?
ভিক্টোরিয়া ফলস্ শহরের কোথাও না থেমে ক্রিস্টিনা চলে আসে বর্ডার পোস্টে। আমরা সীমান্ত অতিক্রম করে জাম্বিয়াতে ঢোকার পাসের সঙ্গে জিম্বাবুয়েতে ফিরে আসার রিএনট্রি ভিসা কিনি। না, আমাদের ব্যাগ-বোঁচকা কিছুই খুলে দেখা হয় না। কাস্টমসের এক আধবুড়ো রক্ষী ক্রিস্টিনার দিকে চোখ নাচিয়ে আমার পেশা জানতে চায়। আমি কায়দা করে মাসোওনা ভাষায় ‘মুনইয়োরি’ বা রাইটার বললে সে তিনটি ভাঙা দাঁত কেলিয়ে বলে, ‘ইউ আর এ রাইটার, লুক বাবা আই অ্যাম অ্যা ফাইটার, জিম্বাবুয়ের ফাসকেলাশ ভিউ ছেড়ে তুমি জাম্বিয়াতে যাচ্ছ...তোমার সাথে ফাইন সেক্সি হোয়াইট গার্ল...ও...লালা। লুক রাইটার, ডু সামথিং ফর দিস ওল্ড ফাইটার।’ আমি বিশ ডলারের নোটসহ তাকে সস্তা সিগারেটের প্যাকেট দিই। গেট দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় সে মাসোওনা ভাষায় এমন এক মন্তব্য করে, যাতে সহযাত্রীর সঙ্গে সন্ধ্যায় সম্ভাব্য সঙ্গমের ইঙ্গিত থাকাতে ক্রিস্টিনা ফুঁসে উঠে গ্রীবা বাঁকিয়ে বলে, ‘নিডিসিইয়োয়ে বা লিভ মি এলোন।’ রক্ষী তার ভাঙা দাঁতের খোড়লে আঙুল ঢুকিয়ে শিস দেয়।
দ্রুত হেঁটে এসে আমরা ব্রিজে উঠি। বিশাল এ পুলটি দাঁড়িয়ে আছে তামাম জগতের সবচেয়ে স্পেকটাকুলার জলপ্রপাতের প্রাকৃতিক ফোয়ারা ছুঁয়ে। বেসাল্ট পাথরের বিশাল রক-ওয়ালে জলের তূর্য নিনাদে কানে লাগে শত শত কামানের গোলা ছোড়ার শব্দ। আর জল থেকে উত্থিত বাষ্পের কুয়াশা-মসলিনের মিহি মেঘ হয়ে উড়ে আসমানে। আশ্চর্য হয়ে ভাবি—এ মুহূর্তে প্রায় ৫৪৬ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি প্রতি মিনিটে প্রায় দুই কিলোমিটার পাথরের ম্যামথ চাঙড় ভাসিয়ে শ্বেতসবুজের বর্ণাঢ্য ধারায় পতিত হচ্ছে ১০০ মিটারের মতো নিচের অত্যন্ত ডিপ্ কুরুঙ্গে। বর্ডার পোস্টের ঝামেলা শেষ হতেই নিজেকে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া রাজবন্দীর মতো নির্ভার মনে হয়।
ব্রিজ থেকে নেমে জাম্বিয়ায় এসেই ট্যাক্সি ধরে আমরা চলে আসি লিভিংস্টোন শহরের কনস্টিটিউশন হিলের কাছাকাছি। আমরা খুব সস্তাগন্ডার ভিক্টোরিয়া ফল ক্যাম্প বলে একটি ব্যাকপ্যাকারদের ডেনে বাগিচায় ছনের গোলাকার রন্ডাবেল বিশ ডলারে এক রাত্রির জন্য ভাড়া নিই। ফোন করতেই মিনিট বিশেকের মধ্যে মি. কনরাডের দৌহিত্রের স্ত্রী গাড়ি চালিয়ে চলে আসে ফল ক্যাম্পে। অল্পবয়সী এ তরুণী শ্বেতাঙ্গী হলেও সে পরে আছে কৃষ্ণাঙ্গ নেডেবেলে গোত্রের অনূঢ়া নারীদের মতো ঊরু উন্মোচন করা বাটিকের র‌্যাপার। অন্ধ কুকুরের দায়িত্ব সে বুঝে নেয়। আমরা তার হাতে পাণ্ডুলিপি পাচার করি। সে তার নানাশ্বশুরের জন্য হরলিকস, পরিজ, ব্লাডপ্রেসারের ওষুধ ও অ্যাজমার পাফ ইত্যাদি ক্রিস্টিনার হাতে তুলে দেয়। তার হাজব্যান্ড মাইক্রোলাইট প্লেনের পাইলট এখন পর্যটক নিয়ে আকাশে উড়ছে। সে আসতে পারেনি বলে তার স্ত্রী অ্যাপোলজি চেয়ে বলে—আমরা যদি ঘণ্টা দেড়েক পর এয়ার স্ট্রিপে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করি।
হাতে একটু সময় আছে দেখে ক্রিস্টিনা জংলা ট্রেইল ধরে হেঁটে চলে এয়ার স্ট্রিপের দিকে। বেসাল্ট পাথরের ধূসরে শ্যাওলায় সবুজাভ বিপুল সব ক্লিফের উল্টো দিকে রেইনফরেস্টের ভেতর দিয়ে চলে গেছে এ পথ। মাঝেমধ্যে বনানীর অপেনিংয়ের ভেতর দিয়ে দেখা যায় জাম্বেসি নদীর স্টানিং ভিউ। আরেকটু সামনে যেতেই দেখি— প্রপাত রীতিমতো ফোয়ারা হয়ে চারদিকে ছুড়ছে জলের স্প্রেয়ার। আমরা একটু সময় ওখানে দাঁড়ালে ক্রিস্টিনা পাণ্ডুলিপির কথা বলে। পাণ্ডুলিপিটি মি. কনরাড লিখেছেন অনেক বছর আগে। রোডেশিয়ার শ্বেতাঙ্গ শাসনের অবসানে দেশটি যখন জিম্বাবুয়েতে রূপান্তিত হলো—তখন দেশের সংখ্যগরিষ্ঠ মাসোওনা গোত্রের সঙ্গে বাঁধে সংখ্যালঘিষ্ঠ নেডেবেলে সম্প্রদায়ের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ চিসোওনা ভাষায় ‘গুকুরাহুয়ানডি’ বা সিভিল ওয়ার বলে পরিচিত। মাসোওনাদের নেতা সদ্য গদিনসীন রবার্ট মুগাবের জানপিএফ পার্টি- নেডেবেলে গোত্রের নেতা নাকোমর জাপু পার্টিকে গুকুরাহুয়ানডিতে রক্তাক্তভাবে হারায়। দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রবার্ট মুগাবে কিছুদিন পর তার ক্যাডারদের নর্থ কোরিয়া থেকে রাজনৈতিকভাবে নির্যাতনের ট্রেনিং দিয়ে আনেন। তারা নেডেবেলে সম্প্রদায়ের মোট ৬২ জন রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদীকে চেউয়ালে নদীর তীরে খুন করে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে গ্রামবাসী ও আত্মীয়স্বজনের সামনে ভিকটিমদের দিয়ে নিজ হাতে তাদের কবর খোঁড়ানো হয়। খুন হওয়া নেডেবেলে ভিকটিমদের কিছু আত্মীয়স্বজন মি. কনরাডের ফার্মে মজুর হিসেবে কাজ করত। তাদের জবানি থেকে শুনে শুনে তিনি এ পাণ্ডুলিপিটি তৈরি করেছেন। রবার্ট মুগাবে এখনো বহাল তবিয়তে হারারের মসনদে আছেন। সুতরাং, জিম্বাবুয়েতে এ গ্রন্থ প্রকাশের প্রশ্নই ওঠে না। তিনি জীবনের শেষ কটি দিন হারারেতে নিরাপদে কাটাতে চান। তবে আওলাদ ফরজন্দরা তার মৃত্যুর পর চাইলে এ পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে পারে।
এয়ার স্ট্রিপে এসে পৌঁছালে দেখি মাইক্রোলাইট প্লেনটির কাছেই দাঁড়িয়ে আছে চুলে পনি-টেইল করা—বয়সে অত্যন্ত তরুণ মি. কনরাডের দৌহিত্র। সে খুব দ্রুত কাজের কথায় এসে তার মাতামহকে দেখাশোনা এবং অন্ধ কুকুর ও পাণ্ডুলিপি এপারে পৌঁছে দেওয়া বাবদ ডলারের নোটে পূর্ণ একটি এনভেলাপ ক্রিস্টিনার হাতে দেয়। কোনো প্রকারের ধন্যবাদ না দিয়ে সে অতঃপর টোব্যাকোর পাতা চিবিয়ে টিস্যুপেপারে ঠোঁটে লেগে থাকা খয়েরি রস মুছে জানতে চায়—আরও কিছু টাকা দিলে ক্রিস্টিনা কি তার মাতামহ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পারবে? খুব নির্লিপ্ত মুখে ক্রিস্টিনা রাজি হলে কনরাড সাহেবের নাতি হিপপকেট থেকে ওয়ালেট বের করে গুনে তাকে আরও কয়েকটি ১০০ ডলারের বিল দেয়।
আমি এবার মাইক্রোলাইট প্লেন সম্পর্কে আগ্রহ দেখালে সে বলে, জিম্বাবুয়েতে শ্বেতকায় হওয়ার কারণে তো বসবাসের কোনো উপায় নেই। তার জন্ম আফ্রিকাতে, সুতরাং সে বিলাতেও ফিরতে চায় না। তার নানা তাকে এ হালকা প্লেন কিনে দিয়েছেন। ভিক্টোরিয়া ফলসের ওপর দিয়ে ১৫ মিনিট ওড়ার জন্য সে পর্যটকদের কাছ থেকে ১৩৫ ডলার নেয়? ‘আর ইউ গাইজ ইন্টারেস্টেড টু ফ্লাই ইন দিস মাইক্রোলাইট?’ আমাকে জবাব দেওয়ার কোনো সুযোগ না দিয়েই ক্রিস্টিনা ‘নো থ্যান্কস্’ বলে হাঁটতে শুরু করে।
ফল ক্যাম্পে ফেরার পথে বনানীর আরেকটি ওপেনিংয়ে এসে ক্রিস্টিনা দাঁড়ায়। একটু দূরে আমাদের হূদয় তোলপাড় করে প্রপাতের শুভ্র-সফেন সবুজাভ জলরাশি পাড়ি দিচ্ছে বেসাল্ট রকের প্রতিবন্ধক। বেলা শেষের সূর্যালোকে তাতে উড়ে স্ফটিকের সোনালি স্ফুলিঙ্গ। প্রকৃতির এ লীলা সম্মোহনী আবহের ভেতর দাঁড়িয়েও মাইক্রোলাইট চড়তে না পারার জন্য আমার মেজাজ তেড়িয়া হয়ে ওঠে। এ ট্রিপের সমস্ত খরচ তো মি. কনরাড দিচ্ছেন? আমি তো রিস্ক নিয়ে ক্রিস্টিনাকে পাণ্ডুলিপি পাচারে সহায়তা করলাম। তার তো কার্টিসি ছিল আমাকে মাইক্রোলাইটে চড়তে দেওয়া।
জলের রুপালি তোড়ে আড়াআড়িভাবে ফুটে আছে বেশ কটি রঙধনু। প্রপাতের শব্দে কিছু শোনা যাচ্ছে না বলে ক্রিস্টিনা কানের কাছে মুখ এনে বলে, ‘মাইক্রোলাইটে ফ্লাই করিনি বলে তুমি ডিসঅ্যাপয়েন্টেড। আই আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট্। ডু ইউ মাইন্ড আমি যদি কনরাডের নাতির কাছ থেকে পাওয়া টাকার পুরোটা সেইভ করতে চাই?’ ‘তুমি ডেসপারেটলি টাকা সেইভ করছ কেন, হোয়াই?’ ‘বিকজ অব মাই মাদার। আমি তাকে আমেরিকা থেকে জিম্বাবুয়ে নিয়ে আসার জন্য প্লেনের টিকিট কিনব। তাকে নিয়ে আসব ভিক্টোরিয়া ফলসে। দেখতে পাবে না সে কিছুই, দেখার শক্তি তার নেই। বাট মাই সেভেনটি থ্রি ইয়ার্স ওল্ড মাদার—এ জলপ্রপাতের পানিতে ভিজতে পারবে। সে শুনতে পারবে জলধারার বজ্রনির্ঘোষ।’ আমি এবার একটু কনফিউজড্ হয়ে জানতে চাই, ‘তোমার মা এখানে এলে জলপ্রপাত দেখতে পাবে না কেন? হোয়াটস্ রঙ উইথ হার?’ ‘বিকজ, মাই মাম ইজ ব্লাইন্ড। আমার জন্মের মাস তিনেক আগে সে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যায়। আমার বাবা যত দিন বেঁচে ছিলেন, অন্ধদের জন্য ব্রেইলে লেখা পত্রপত্রিকা বইপুস্তক এনে দিতেন। তাঁর মৃত্যু পর থেকে মা একেবারে একা। আমি টেলিফোনে তাঁকে ভিক্টোরিয়া ফলসের বর্ণনা দিয়েছি। সে একবার আসতে চায়।’

No comments

Powered by Blogger.