শুরু: ৭—১৭ এপ্রিল ২০১২গ্যালারি: কায়া, উত্তরা-জল ও ছায়ার মোহনায় by মোবাশ্বির আলম মজুমদার

শিল্পী সৃষ্টিকর্মের পথ নির্ধারণে আশ্রয় নেন সুর, ছন্দ ও প্রকৃতির। আশির দশক-পরবর্তী সময়ে তেলরং ও জলরং ছেড়ে বাংলাদেশের শিল্পান্দোলনে এক তরুণ ছাপচিত্রী নিরীক্ষাধর্মী কাজ নিয়ে হাজির হলেন দর্শকের সামনে। রতন মজুমদার ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে তৃতীয় একক প্রদর্শনীর আয়োজন করেন,


বাস্তবানুগ রীতি ভেঙে ছাপচিত্রে বিষয়ের নিরীক্ষা ও ফর্ম ভেঙে আঙ্গিক গঠন দেখিয়েছেন ওই প্রদর্শনীতে। সাদা-কালো লিনোকাট মাধ্যমে প্রিন্ট নেওয়া ছবি ‘মৃত্যুর পর কালো প্রজাপতির দল’ রেখা ও গতিময় চিত্রতলের উৎকৃষ্ট উদাহরণ, কাঠখোদাই মাধ্যমে নিজস্ব শৈলীর উদ্ভাবন ও বিষয়ে জ্যামিতির প্রয়োগ তাঁর বর্তমান প্রদর্শনীর কাজের বৈশিষ্ট্য। কাঠখোদাই মাধ্যম শিল্পকলার ইতিহাসে প্রাচীন মাধ্যমগুলোর অন্যতম। শক্ত কাঠের বুকে নরুন বা সুচালো যন্ত্রের আঁকিবুঁকিতে গড়ে ওঠা রেখা গুহাচিত্রের দেয়ালে ব্যবহূত পশুর সুচালো হাড়ের ব্যবহারের কথা মনে করায়। রতন মজুমদার ছাপচিত্রের বিষয়ে প্রথাবিরোধী আচরণের জনক, আশির দশকের প্রতিভাবান শিল্পী রতন দীর্ঘ সময় পর আবার দর্শককের সামনে এসেছেন। দীর্ঘ বিরতি প্রসঙ্গে শিল্পী বলেন, কাজে ধ্যানস্থ হয়েই তিনি একটি ছবি আঁকা সম্পন্ন করেন। শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার শিল্পের গতিপথ নির্ধারণে দীর্ঘ যাত্রায় খানিক বিরতি শিল্পের জন্য অতি জরুরি। এ প্রদর্শনীর চারটি মাধ্যমের কাজ হলো, উড এনগ্রেভিং, জলরং, ড্রয়িং বা রেখাচিত্র ও ছাপচিত্র। সব মাধ্যমের কাজেই রতন প্রকৃতি, পশুপাখি ও মানুষী মুখ উপস্থাপন করেছেন। কাঠের পাটাতনে প্রকৃতিকে বিষয় করে খোদিত শিল্পকর্ম তৈরিতে রতন মজুমদার ধ্যানস্থ হন ২০০০ সালের পর। কাঠের রিলিফ চিত্রে বিষয়গুলোয় বাস্তবানুগ রীতি ভেঙে জ্যামিতির আশ্রয় নেন। প্রকৃতির সূক্ষ্ম বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হয়ে তিনি ত্রিমাত্রিক রূপ দেন। বর্তমান প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য কাজ ‘গড অব উইন্ড’ কাঠের প্যানেলে এনগ্রেভিং পদ্ধতির মধ্যে ভারতীয় পৌরাণিকের দৈহিক ভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন; ‘লাভ’ শিরোনামের শিল্পকর্মে একদল হাঁসের দুরন্তপনাকে উৎকীর্ণ করেছেন। ফ্রেমবন্দী কাঠের কাজে শিল্পগুণের চেয়ে দ্বিমাত্রিক তলে ত্রিমাত্রিক আচরণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। জলরঙের কাজে শিল্পী রতন চিত্রতলকে জ্যামিতিক বিন্যাসে বিভক্ত করে ঘুড়ির অবয়ব তৈরি করেন। কৌণিক রেখার প্রয়োগে বিভাজিত চিত্রতল, বিন্দু, বৃত্ত ও রেখার সঙ্গে বাংলার লোকজ ঐতিহ্য নকশিকাঁথার সুঁই-সুতার ফোঁড়ের ব্যবহার ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সম্মিলন। নারীর মুখচ্ছবির মধ্যে জলের ধোয়ায় কোমল রঙের প্রয়োগে নারীমুখের কমনীয় রূপ স্পষ্ট হয়েছে। ক্যানভাসের একটি পরিসরে মুখাবয়বের যুক্তচিন্তা মানব মনোদ্বন্দ্বের প্রস্ফুটন, ইউরোপেও রেনেসাঁ-পূর্বকালে বহু চিত্রশিল্পী ছাপচিত্রের মাধ্যমে ভুবনখ্যাত শিল্প সৃষ্টি করেছেন। রতনের আশির দশকের সৃষ্ট শিল্পকর্মের সঙ্গে বর্তমান প্রদর্শনীর কজের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় শুধু ছাপচিত্রে। নানা মাধ্যমের বৈচিত্র্যপূর্ণ ৬০টি কাজের এ শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ৭ এপ্রিল শুরু হয়ে শেষ হবে ১৭ এপ্রিল।

রতন মজুমদার: ১৯৫৪ সালের ৩১ মার্চ ফেনী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ) সিরামিকস বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা অর্জন করেন ১৯৭৮ সালে। ১৯৭৯ সালে অস্ট্রেলিয়া প্রিন্টস কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ করন। এ পর্যন্ত ৪১টি দলীয় ও ছয়টি একক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। ১৯৭৮ সালে চতুর্থ জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে ছাপচিত্রে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি স্বাধীন শিল্পী হিসেবে কাজ করছেন।

No comments

Powered by Blogger.