এমনই চলছে, চলবে .... by সাজিদুল হক সাজু

বারান্দায় শুয়ে রয়েছে সারি সারি অসুস্থ মানুষ। নারী-পুরুষ-শিশুসহ সব বয়সের। কারো মাথায় ব্যান্ডেজ। কারো নাকে পাইপ লাগানো, কারোবা ক্যাথিটার লাগানো। পাশে পড়ে রয়েছে রক্তমাখা স্যালাইনের পাইপ। ধূলা-বালির মধ্যেই স্বজনরা জেগে থেকে সেবা করছেন রোগীর।

এর মধ্যেই মাঝেমধ্যে শোনা যাচ্ছে গগন বিদারী কান্নার আওয়াজ। এই মাত্র কেউ চিরদিনের মতো হারালো কোনো স্বজনকে। ওয়ার্ডগুলোতে নেই ডিউটি নার্স। শূন্য টেবিল চেয়ার যেন সাধারণ মানুষকে উপহাস করছে। সাংবাদিক দেখে কেউ আবার মন্তব্যও করছেন, ‘ছবি তুলে লাভ নেই ভাই। এমনই চলছে, চলবে। সেবা পাবে না গরীব মানুষ।’

উপরের চিত্রটি মধ্যরাতের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের। বৃহস্পতিবার দিনগত রাত পৌনে একটার দিকে জরুরি বিভাগে গিয়ে প্রথমেই শোনা গেল উচ্চস্বরে এক নারীর কান্না। তার পাশে স্ট্রেচারে পড়ে রয়েছে এক নিথর দেহ।

মৃতের নাম আমীর হোসেন। বাড়ি মুন্সীগঞ্জ। হৃদরোগে মারা গেছেন সাড়ে দশটার দিকে। আসছেন আত্মীয়-স্বজনরা। কান্নায় ভারী হচ্ছে বাতাস।

জরুরি বিভাগ ছেড়ে একটু সামনের দিকে এগুতেই দেখা গেল- সারি সারি মানুষ শুয়ে রয়েছেন। প্রায় সবাই রোগী। ওয়ার্ডে বেড পাননি বলেই ঠিকানা হয়েছে বারান্দায়। ১১০ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেলো- ডিউটি নার্সদের চেয়ারগুলো সবই ফাঁকা। কোথায় গেছে কেউ জানে না।

এর একটু সামনে ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টার। সাইন বোর্ডের উপরে বড় করে লেখা- পুরুষ প্রবেশ নিষেধ। অথছ ওখানেই দেখা গেলো বারান্দায় শুয়ে রয়েছেন পুরুষ রোগী আর তাদের স্বজনরা।

আর একটু সামনে গিয়ে কয়েকজন পুলিশসহ একটি জটলা। স্ট্রেচারে পড়ে রয়েছে নিথর একটি দেহ। বিকৃত মুখমন্ডল ফেনায় ভরা। যাত্রাবাড়ীর তাজুল ইসলাম। পেশায় নির্মাণ শ্রমিক। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন। সন্ধ্য ছয়টায় ঢাকা মেডিক্যালে আনা হয়। পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

তাজুলের প্রতিবেশী শফিকুল ইসলাম আক্ষেপ করে এ প্রতিবেদকে বলছিলেন, ‘এখন বাজে রাত একটা। এসেছি সেই সন্ধ্যায়। অথচ এখনও লাশ নিয়ে যেতে পারছি না। কতরকমের ঝক্কি-ঝামেলা যে আছে ভাই তা বোঝানো যাবে না। পুলিশ রিপোর্টের জন্যই এত দেরি হচ্ছে।’

চাঁদপুরের মোহন, ভাইয়ের সঙ্গে হাসপাতালে আছেন চার দিন। বেড পাননি বলে বারান্দায় ঠাঁই হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত তার ভাই মাহমুদ।

মাহমুদের মতো আরো অসংখ্য রোগী পড়ে রয়েছেন হাসপাতালের বারান্দায়। পড়ে রয়েছে অযত্ন-অবহেলায়। দেখার কেউ নেই। আছে শুধু আক্ষেপ, হতাশা আর কাতরতা। এতকিছুর পরেও চিকিৎসা পাওয়ার জন্য পড়ে রয়েছেন তারা। কারণ, মহানগরীর বেসরকারি ক্লিনিকে যাওয়ার সামর্থ্য নেই তাদের।

নোংরা আর অযত্নের মধ্যেই বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে পড়ে রয়েছে সমাজের নীচের তলার এসব মানুষ।

No comments

Powered by Blogger.