নো ম্যানস ল্যান্ডে পতিত বিমান by আশরাফুল হক রাজীব

ধারাবাহিক লোকসান থামিয়ে লাভজনক করতে ২০০৭ সালে সরকারি প্রভাবমুক্ত করে বাংলাদেশ বিমানকে করপোরেশন থেকে কম্পানি করা হয়। সংস্থাটির ৪০ বছরের ইতিহাসে ৩৫ বছরই করপোরেশন বা দপ্তর হিসেবে মন্ত্রী নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই দীর্ঘ সময় শত শত কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে বিমান।


অভিযোগ আছে, সংস্থাটির সব শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী যাঁর যাঁর অবস্থানে থেকে দুর্নীতি করেছেন। দুর্নীতিতে গা ভাসানোর অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের বিরুদ্ধেও। আরো অভিযোগ আছে, ভর্তুকি দিয়ে বিমানকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টির জন্যই।
এই অবস্থায় পুরোপুরি বেসরকারি হিসেবে কার্যকর করার আগেই বিমানের যাত্রাপথের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পদ মন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতেও আন্দোলন করছেন কর্মচারীরা। কম্পানি করার পর বিমানের চেয়ারম্যানের পদ হারিয়েছেন মন্ত্রী। ফলে বিমান মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হলেও বেসরকারি হতে পারেনি। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের মাঝখানে নোম্যান্স ল্যান্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছে বিমান। অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারের একটি গ্রুপ খারাপ ইমেজের এ সংস্থাটিকে আবার সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এর সম্ভাবনা নষ্ট করে নিজেদের আখের গোছাতে চায়। আরেকটি গ্রুপ শেয়ার ছেড়ে বেসরকারিভাবে পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করে লাভজনক করার চ্যালেঞ্জে যেতে চায়। এই অবস্থায় সরকারের সঠিক সিদ্ধান্তই বিমানকে বাঁচাতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান গত সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিমানকে কম্পানি করা হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে বাছাই করা লোক দিয়ে। সেই পর্ষদ কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। কারণ তারা বিমানকে লাভের মুখ দেখাতে পারেনি। সেবার মান বাড়াতে পারেনি। সংস্থাটির ইমেজ সংকট ছিল, তা আরো বেড়েছে। অথচ এই বিমানের ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল। কারণ এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার দায় সরকার নিয়েছে। দায়দেনা শূন্য করে কম্পানি করা হয়েছে। তা কাজে লাগাতে পারেনি। এ জন্য পরিচালনা পর্ষদ যেমন দায়ী, কর্মচারীরাও দায়ী। নতুন এয়ারক্রাফট সংগ্রহ, বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বৃদ্ধিজনিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে করতে বিমান যখন দিশেহারা, তখন কর্মচারীরা আহার-ভাতা বাড়ানোর দাবি করল, যা মোটেই সময়োপযোগী ছিল না। শুধু আহার ভাতাই নয়, বেতন ভাতাও বাড়াতে বাধ্য করা হয়েছে।' মন্ত্রী বলেন, 'যাই হোক, সব কিছু মিলেই পরিস্থিতি এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে- এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।'
কিভাবে বের হয়ে আসবেন জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, 'অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করি, সরকার ব্যবসা করবে না। এই সূত্র ধরেই সমস্যার সমাধান করতে হবে।'
বিমান সূত্র জানিয়েছে, ৪০ বছরে বিমানের লোকসান হয়েছে এক হাজার ৬৭৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা। লাভ দেখিয়েছে ৪১৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এই লাভ-লোকসানের মধ্যেও শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। কারণ যেসব বছর লাভ দেখানো হয়েছে, তা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন সময় বিমান যখন দেনার দায়ে দাঁড়াতে পারছিল না, তখন সরকার সে দায় নিজের কাঁধে নিয়েছে। সেই দেনাকে বিমান আর লোকসান হিসেবে দেখায়নি। ২০০৭ সালে বিমান মুনাফা দেখিয়েছে পাঁচ কোটি ৯১ লাখ টাকা। কিন্তু ওই বছর সরকার বিমানের কাছে বিপিসির পাওনা এক হাজার ২০০ কোটি টাকার দায় নিজে নিয়েছে। একইভাবে বিভিন্ন এয়ারপোর্ট ব্যবহারের পাওনা ৬০০ কোটি টাকা সরকার নিজে পরিশোধ করেছে। অর্থাৎ ২০০৭ সালে বিমান পাঁচ কোটি টাকা মুনাফার কথা বললেও এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা দেনা সরকার নিজের কাঁধে নিয়েছে। ৪০ বছরের মধ্যে লোকসান হয়েছে ২৪ বছর। অবশিষ্ট ১৬ বছরে লাভ দেখিয়েছে ৪১৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ফাঁকিবাজির লাভের পরও বিমানের নিট লোকসান এক হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোকসান দিয়েছে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে। চারদলীয় জোটের শাসনাধীন ওই বছরে বিমানের লোকসান দাঁড়িয়েছিল ৪৫৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা। বিমানের ৪০ বছরের লাভ-ক্ষতির গ্রাফে দেখা যায়, ২০০৫-০৬ সালে ক্ষতির চিত্র সমান্তরাল রেখা অতিক্রম করে ঋণাত্বকে পৌঁছেছে। পরের বছরে এই লোকসান হয়েছে ২৭২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মুনাফা দেখানো হয়েছে। বিএনপি শাসনাধীন ওই বছরগুলোতেও সরকার বিমানের দায় নিজের কাঁধে নিয়েছিল। এ কারণে পরপর চার বছর মুনাফা দেখাতে পেরেছে।
বিমান কেন শেয়ার ছাড়তে পারেনি জানতে চাইলে বিমান ও পর্যটন সচিব মো. আতাহারুল ইসলাম বলেন, শেয়ার ছাড়ার বিষয়টি একটি প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়েছে।
কিন্তু বিমান সূত্রে জানা গেছে, পরপর দুই বছর লাভ করতে না পারলে শেয়ার ছাড়ার অনুমোদন মেলে না এসইসি থেকে। আর এই অবস্থায় বিমানের দুই বছর লাভ করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সরকারের তরফ থেকেও বিমানের দায় নেওয়ার মতো অবস্থা নেই।
গত বছর তিন হাজার ২০০ কোটি টাকায় দুটি এয়ারক্রাফট কেনা হয়েছে ৫ থেকে ৬ শতাংশ সুদে। কিস্তি ও সুদের টাকা বিমান না দিতে পারলে সরকারকে দিতে দেবে। আগামী বছরই আরো দুটি এয়ারক্রাফট বিমান বহরে যোগ দেবে। এই অবস্থায় সংস্থাটির কৃচ্ছ দরকার ছিল বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মত। কিন্তু তা না করে সংস্থাটি ব্যয় বাড়িয়েছে। এ সম্পর্কে বিমানের বক্তব্য জানার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু চলমান আন্দোলনের কথা বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এড়িয়ে গেছেন।
এ ধরনের ভয়াবহ অর্থিক সঙ্কটের মধ্যে বিমানে আন্দোলন শুরু হয়েছে। বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবি আদায়ের দেড় বছরের মাথায় নতুন করে আন্দোলন শুরু হওয়ায় বিমানের অবস্থা খুবই নাজুক আকার ধারণ করেছে। আন্দোলন একমুখী হয়ে পড়েছে। আন্দোলনকারী নেতাদের ক্ষোভ, বিমান চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। গত মাসে জামাল উদ্দিন ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা সৌদি আরবে ওমরা করতে যাওয়ার জন্য বিমান থেকে রেয়াতি টিকিট সংগ্রহ করেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা চেয়ারম্যানকে সে কারণে বিমানে চড়তে বাধা দেন। অথচ ২০০৩ সালের ১৫ এপ্রিল জারি করা বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়েছে, চেয়ারম্যান ও পর্ষদ সদস্যরা বছরে একটি শতভাগ রেয়াতি টিকিট, বছরে দুটি করে ৯০ ভাগ রেয়াতি টিকিট এবং দুটি করে ৭৫ ভাগ রেয়াতি হারে টিকিট পাবেন। চেয়ারম্যান ও পর্ষদ সদস্যরা শত ভাগ রেয়াতি টিকিট পরিবারের স্ত্রী ও সন্তান এবং বাবা-মায়ের অনুকূলে হস্তান্তরও করতে পারবেন।'
চেয়ারম্যানের টিকিট আটকে দেওয়া প্রসঙ্গে বিমান বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক এবং সিবিএ সভাপতি মশিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বিমানের পরিবারের সদস্যরা কেন বিনা টিকিটে চড়বেন? এ ধরনের খারাপ আইন থাকলে তা বাতিল করা উচিত। চেয়ারম্যানের উচিত ছিল ২০০৩ সালের আইন বাতিল করা। বিমানের প্রতি দরদ থাকলে চেয়ারম্যান এই আইন বাতিল করতেন। এ থেকেই বোঝা যায়, বিমানের প্রতি তাঁর কোনো দরদ নেই।'
মশিকুর রহমান আরো বলেন, 'আমরা চাই সরকারের, বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান। তাঁর তত্ত্বাবধান ছাড়া বিমানের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সরকার ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এখন বিমানকে লাভ দেখানো সম্ভব হবে না। সরকারই পারে দায়-দেন নিজের কাঁধে নিয়ে বিমানকে লাভ করাতে।
সেটা প্রকৃত লাভ কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ছাড়া বর্তমানে আর কোনো বিকল্প নেই।
এর আগে বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী জি এম কাদের বিমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হতে চেয়েছিলেন। তিনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় পর্ষদের চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী হিসেবে তাঁর হাতে ন্যস্ত করার জন্য ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠান। সারসংক্ষেপে জি এম কাদের বোর্ড সদস্য নিয়োগ ও অপসারণের কর্তৃত্ব মন্ত্রণালয়ের হাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বিমানকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখার জন্য জি এম কাদেরের প্রস্তাবে সায় দেননি। তিনি জামাল উদ্দিকে ডেকে কাজ চালানোর নির্দেশ দেন। এবারের সংবটেও জামাল উদ্দিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে পরিস্থিতি জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে তা জানাতে অস্বীকার করেছেন জামাল উদ্দিন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের (বিআইএম) ঊর্ধ্বতন গবেষণা কর্মকর্তা সাইদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকার ব্যবসা করবে কেন? সরকার পলিসি তৈরি করবে, তদারকি করবে। এয়ারলাইন্স চালানোর জন্য কম্পানি করে শেয়ার ছাড়ার প্রক্রিয়াটাই ঠিক ছিল। পুরো প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ না করে এর মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা হবে আত্মঘাতী। ভর্তুকি নিয়ে বেঁচে থাকতে সরকারের নিয়ন্ত্রণে যেতে চায় কর্মচাররিা।' তিনি বলেন, 'এয়ারলাইন্স ব্যবসা পর্যালোচনা করে যেটা দেখা যায়, সেটা বিমানে প্রয়োগ করা উচিত। শুধু ৪৯ ভাগ শেয়ার পাবলিকের কাছে ছেড়ে দিলেই হবে না। তাদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করতে দিতে হবে। একই সঙ্গে এয়ারলাইন্স ব্যবসায় পারদর্শী কোনো সংস্থাকে বিমান পরিচালনায় যুক্ত করতে হবে। যদিও এসব সংস্কার বিমানের কর্মচারীরা মেনে নেবেন বলে আমার মনে হয় না। কারণ বিদেশি সংস্থা এলে নয়-ছয় করা যাবে না, টাকা মারা যাবে না। একটা বিষয় সরকারকে আমলে নিতে হবে, আর তা হলো- সরকার পরিচালিত দুটি হোটেল সোনারগাঁও ও সাবেক শেরাটন নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ নেই। কেন নেই? কারণ, এ দুটি হোটেল বিদেশিরা চালান।'

No comments

Powered by Blogger.