সফলদের স্বপ্নগাথা-আজ হেরেছ, কাল জিতবে by লক্ষণ কাদিরগামার


লক্ষণ কাদিরগামার শ্রীলংকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ২০০৫ সালে তিনি আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। তাঁর জন্ম ১৯৩২ সালের ১২ এপ্রিল। ২০০৪ সালে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের ইংল্যান্ড সফরকালে লঙ্কান ক্রিকেটারদের সম্মানে দেওয়া এক নৈশভোজে তিনি এ বক্তৃতা করেন।


খুঁতখুঁতে ইতিহাসবিদেরা বলে থাকেন, ক্রিকেট আসলেই এক জঘন্য রাজনৈতিক কৌশল। খেলার ছদ্মবেশে তা আসলে যুদ্ধেরই বদলা। প্রজারা যাতে সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের ছেড়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই করে, তার জন্য ধুরন্ধর ব্রিটিশরা এটা আবিষ্কার করে। দুনিয়া দুই শিবিরে বিভক্ত—একদল ক্রিকেটের মারপ্যাঁচে মজা পায়, আরেকদল এর ফেরে পড়ে সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি হয়ে যায়। তারা বুঝতে পারে না হাজার হাজার— এখন তো দুনিয়াজুড়ে লাখ লাখ দর্শকের তুমুল হাততালির জন্য একদল তেজি যুবক কেন তপ্ত সূর্যের নিচে অথবা কাঁপানো শীতের মধ্যে খোলা মাঠে একটি বলের পেছনে ছোটে বা লাঠি দিয়ে বারবার তাকে পেটায়। যারা ইতিমধ্যে এর জটিলতায় হতভম্ব, এই খেলার রহস্যময় ভাষায় তারা আরও বিভ্রান্ত হয়।
অ-ক্রিকেটীয় বিশ্ব যেমন আমেরিকা, চীন, ইউরোপ ও রাশিয়ায় গেলে বোঝাতে বোঝাতে আমি হয়রান হয়ে যাই, ‘গুগলি’ কোনো ভারতীয় মিষ্টির নাম না; ‘স্কোয়ার কাট’ মাংসের কোনো পছন্দের টুকরা না; বাগানের একপাশের চত্বর না ‘কভার ড্রাইভ’; ‘বাউন্সার’ নাইট ক্লাবের পেশিবহুল দারোয়ান নয়; ‘ইয়র্কার’ ইয়র্কশায়ারের কোনো চমৎকার ককটেল না; অথবা ‘লেগ ব্রেক’ নয় প্রতিপক্ষের কোমরের নিচটা ভাঙার কুশলী চাল।
এবার দেখা যাক, ক্রিকেট আর রাজনীতির মধ্যে কোনো মিলের ব্যাপার আছে কি না। সন্দেহ নেই, দুটিই খেলা। বাইরের দিক থেকে রাজনীতিবিদ ও ক্রিকেটারদের একই রকম লাগলেও, তারা বিস্তর আলাদা। নিষ্ঠুর জনতা উভয়কেই উসকায়, আজ তাদের অভিনন্দন জানায় তো কাল একেবারে ছুড়ে ফেলে।
কঠিন খাটুনি যায় ক্রিকেটারদের; আর রাজনীতিবিদেরা পরিশ্রমের ভান করেন। ক্রিকেটাররা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেন, রাজনীতিবিদেরা করেন বিভক্ত। ক্রিকেটাররা শৃঙ্খলাবদ্ধ; বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ এর সঙ্গে অপরিচিত। ক্রিকেটাররা জয়ের স্বার্থে হাত-পা ভাঙার ঝুঁকি নেন; আর রাজনীতিবিদেরা আপন স্বার্থে সমর্থক ও বিরোধীদের হাত-পা-জীবন নষ্টের পরিস্থিতি তৈরি করে নিজেরা নিরাপদ থাকেন। ক্রিকেটাররা যোগ্যতাবলেই পুরস্কার পান; আর জনগণ যেমন, পুরস্কার হিসেবে তেমন রাজনীতিবিদই তাঁরা পান। ক্রিকেটাররা অন্যায্য হলেও আম্পায়ারের রায় মেনে নেন; আর রাজনীতিবিদেরা অপছন্দের বিচারকদের বদলি করে দেন। ক্রিকেটাররা জয়-পরাজয়ে দল ছাড়েন না, রাজনীতিবিদেরা প্রায়ই হারু পাট্টি ছেড়ে জয়ী দলে নাম লেখান। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, ক্রিকেটাররাই ভালো জাতের।
বলা হয়, দেশের খাতিরে বিদেশে অনর্গল মিথ্যা বলা পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাজের অংশ। কথাটা হয়তো সত্যি। আরো বেশি সত্যহলো, তাঁকে সব সময়ই স্বদেশের জন্য লড়তে হয়, দেশের সাফাই গাইতে হয়। আমাদের ক্রিকেটারদের হয়তো মনে পড়বে, ১৯৯৫ সালে বিশ্বকাপ-পূর্ব প্রস্তুতি ম্যাচের জন্য কলম্বোয় আসতে অস্বীকার করে বসে অস্ট্রেলিয়া। শেন ওয়ার্ন বলেছিলেন, তিনি কলম্বোয় আসবেন না, কারণ সেখানে তিনি কেনাকাটা করতে পারবেন না। সাংবাদিকেরা আমাকে এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে বললে আমি বলি, ‘কেনাকাটা মেয়েদের কাজ’। প্রতিক্রিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গেল অস্ট্রেলিয়ায়...এক টেলিভিশন থেকে প্রশ্ন করা হলো, আমি কখনো ক্রিকেট খেলেছি কি না। বললাম, আপনার জন্মেরও আগে খেলেছি—হেলমেট ও থাই গার্ড ছাড়াই গর্ত আর পাথরভর্তি খোদরা-বোদরা ম্যাট উইকেটে; অনেকগুলো ভাঙা হাড় তার সাক্ষী। আমার বন্ধু অস্ট্রেলীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই বিবাদে নাক গলালেন এবং আমাকে ফোন দিলেন। দুজনে মিলে ঠিক করলাম, উত্তেজনা প্রশমিত করতে হবে। শিগগিরই ভারত-পাকিস্তানের যৌথ ক্রিকেট দল কলম্বো এসে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের দিন একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলল। সেটা ছিল দক্ষিণ এশিয় সংহতির এক ঝলমলে নজির। কঠিন নিরাপত্তা হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও আমি পাকিস্তানি ও ভারতীয় বন্ধুদের শুভেচ্ছা জানাতে মাঠে গেলাম।
ঝামেলা কেটে গেলে আমি আমার অস্ট্রেলীয় প্রতিপক্ষকে এক তোড়া ফুল পাঠালাম। ফুলও তো মেয়েদের জন্য।
পরিষ্কার মনে আছে, অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে গিয়ে মুরালিধরনকে বল ছুড়ে মারার দায়ে অভিযুক্ত করা হলো। অর্জুনা রানাতুঙ্গা তখন পুরো দল নিয়ে বাউন্ডারিতে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলেন; অবশ্য চালাকি করে মাঠের সীমাটা ডিঙালেন না। কলম্বোয় বসে আমি দৃশ্যটা টেলিভিশনে দেখছিলাম। সাবেক অধিনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, অর্জুনার জায়গায় থাকলে আমি কী করতাম? মনের ভেতরে মুরালির প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন টের পেলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফোন বেজে উঠল, ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পরামর্শ চান। বললাম, অর্জুনা উচিত কাজই করেছেন। কারণ অধিনায়ক হিসেবে মাঠের মধ্যে অবশ্যই তাঁকে দলের সবার পক্ষে দাঁড়াতে হবে এবং তাদের বাঁচাতেও হবে। তবে, এর পরিণতি যাতে বেশি দূর না গড়ায় সেটাও দেখতে হবে। ভালো উকিল নিয়োগ করতে হবে এবং অবশ্যই একটা আপসে পৌঁছাতে হবে। তাই-ই করা হয়েছিল। শ্রিলঙ্কার ক্রিকেট দলের ওই সফরের সময়েই আমিও সরকারিভাবে অস্ট্রেলিয়ায় গেলাম। আমার বন্ধু, সেই অস্ট্রেলীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ডিনার বক্তৃতায় পরদিন ফাইনাল খেলা দেখতে তাঁর সঙ্গে তাঁর শহর আদেলাইদে যাওয়ার আমন্ত্রণ করলেন। জবাবে বললাম, অস্ট্রেলিয়া ‘এক চুলের জন্য জিতেছে’ এই কথা বলবার জন্য আমি সেখানে যাব না। পরিকল্পনামাফিক, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার খাতিরে পরের দিনই দেশে ফিরে এলাম...।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মাঝেমধ্যে কঠিন সব পরিস্থিতিতে পড়েন। উগান্ডার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাই ধরুন। প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন তাঁকে জানালেন, তিনি দেশের নাম বদলে ইদি রাখতে চান। মন্ত্রীকে বলা হলো, দুই সপ্তাহের মধ্যে দুনিয়াজুড়ে এর পক্ষে প্রচার করে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু মন্ত্রী সেটা করলেন না। তাঁকে তখন তলব করে ব্যাখ্যা চাওয়া হলো। তিনি বললেন, ‘জনাব প্রেসিডেন্ট, আমি শুনেছি সাইপ্রাস নামে একটা দেশ আছে। লোকে এর নাগরিকদের সাইপ্রিয়ট বলে; আমরা আমাদের দেশের নাম বদলে ‘Idi’ রাখলে আমাদের নাগরিকদের তো সবাই ‘Idiot’ ডাকবে। প্রেসিডেন্ট তৎক্ষণাৎ মতি বদলালেন।
গল্প চালু আছে, এক হাঙরকে প্রশ্ন করা হলো, খাবার হিসেবে কেন সে কূটনীতিকদের পছন্দ করে। তার জবাব: ‘তাদের মগজ ছোট হওয়ায় খেতে স্বাদ বেশি, মেরুদণ্ড নরম হওয়ায় আরাম করে মজ্জা চুষে খেতে পারি আর তাদের পাওয়া মদে চুবানো অবস্থায় পাওয়া যায় বিধায় খাওয়ার সুখটাই হয় অন্যরকম’।
ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়গণ, আমার এই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার শেষে আমি শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট দলের উদ্দেশে কিছু বলতে চাই। আজ আমরা একটা খেলায় হেরেছি। কিন্তু আমরা হেরেছি বৃষ্টি আর ‘ডাকওয়ার্থ ও লুইসে’র দোষে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে তোমরা দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে এক উচ্ছ্বসিত বিজয় পেয়েছ। আবার তোমরা কালকে জিতবে। মনোবল ও চেতনা অটুট রাখাই সবচেয়েগুরুত্বপূর্ণ এখন। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা সবাই, তোমাদের দেশবাসী নারী ও পুরুষ, সবাই তোমাদের নিষ্ঠা, শৃঙ্খলা, পেশাদারি ও সংকল্প দেখে দারুণভাবে প্রভাবিত। জনগণ তোমাদের সঙ্গে আছে। আমরা সবাই জানি, তোমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ দক্ষতা শাণিত করায় ব্যস্ত রয়েছ। দেখতে পাচ্ছি, তোমাদের শারীরিক সামর্থ্যও বেশ ভালো। এসব দেখে মানুষ অগাধ আনন্দ তো পায়ই, পাশাপাশি তাদের নৈতিকতাও জোরদার হয়। তারা জানে, শ্রীলঙ্কানরা লাগাতার নৈপুণ্য দেখানোর চ্যালেঞ্জ নিতে সক্ষম।
সব দলই হারে। খেলতে তো দুই পক্ষই লাগে। এদের একজনকে হারতে হয়। তোমরা যে ধাঁচে খেলবে, তাই দেবে বিজয়ের প্রতিশ্রুতি। দেখেও সুখ, একেবারে তরুণদেরও নিয়মিতভাবে জাতীয় দলে নেওয়া হচ্ছে। আমাদের দল ঐক্যবদ্ধ। এর ইতিবাচক প্রভাব দেশের সব জাতি ও ধর্মের মানুষের ওপরও পড়ে। আজকের দিনে, বিশ্বের আর সব খেলার মতো ক্রিকেটও অতিমাত্রায় প্রতিযোগিতামূলক; এবং এটাই হওয়া উচিত এ রকমটাই থাকা উচিত। খেলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা সব সময়ই এক মার্যাদার ব্যাপার। তোমরা সবাই আমাদের তরুণদের আদর্শ। কীভাবে তোমরা পরাজয়কে নিচ্ছ, তারাও তা দেখতে আগ্রহী। জয়ে আত্মহারা হওয়া সহজ; কিন্তু পরাজয়ের মুখেও স্থির থাকা পরিপক্কতার লক্ষণ। সৌখিন সমালোচকদের নিন্দামন্দকে একদম পাত্তা দেবে না। তারা অনেক তত্ত্ব কপচিয়ে বলবে, কীভাবে খেললে জয় আসতো। কিন্তু তাদের অনেকেই জীবনে একবারও ব্যাটে বল লাগাতে পারেনি। সৌখিন সমালোচনা তাদের অবসরের বিনোদন।
কমে আসা আলোয় ফাস্ট বোলিংয়ের মুখোমুখি হওয়া কেমন, তা তারা জানে না; শতেক প্রতিকূলতার মুখে রান বাড়িয়ে যাওয়ার সংগ্রাম কীরূপ তা তারা বুঝবে না। খেলার মাঠে লম্বা সময় জুড়ে পরিশ্রমের ক্ষমতা ও শারীরিক সক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে ব্যবহার করার সমস্যা কী, তা তারা জানবেও না কোনোদিন। আধুনিক যুগে খেলোয়াড়দের কী পরিমাণ মানসিক চাপ বহন করতে হয়, তার খোঁজ তারা রাখে না। তাই, তোমাদের প্রতি আমার পরামর্শ, ওদের উপেক্ষা করো। শৃঙ্খলা বজায় রাখ এবং নিয়ম মেনে পরের খেলার জন্য তৈরি হও।
এখানে আমন্ত্রিত হওয়ার সময় কেউ আমাকে বলেনি যে, খাওয়ার শেষে একটা বক্তৃতাও করতে হবে। এসে বুঝলাম, বিনা প্রতিদানে আজকাল ডিনারও পাওয়া যায় না!
সূত্র: ইন্টারনেট, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: ফারুক ওয়াসিফ

No comments

Powered by Blogger.