রেলওয়েতে লোকসান ও আশার আলো by ডা. মো. ফজলুল হক

পরিবেশদূষণ রোধ ও যানজট নিরসনের প্রধান যোগাযোগব্যবস্থাটি হচ্ছে রেলওয়ে। বাস, লঞ্চ ও স্টিমার কোথাও লাভ ছাড়া কথা নেই। রেলের একটি ইঞ্জিনের ঘাড়ে চড়ে লাখ লাখ যাত্রী যাতায়াত করছে, এর পরও লোকসান হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। যেমন- ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ব্যয় ৮৮৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা, আয় মাত্র ৪৪৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা,


নিট ক্ষতি বা লোকসান ৪৩৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে নিট ক্ষতি ৫৬২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ক্ষতি ৬১৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ ৬৩৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে লোকসান প্রায় ৬৮১ কোটি টাকা। তা ছাড়া প্রতিবছর প্রায় ১১ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে সরকার। সুতরাং এ ক্ষতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে যেকোনো মূল্যেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশে রেলওয়ে একটি নিরাপদ ও আরামদায়ক চলাচলের মাধ্যম এবং লাভও হচ্ছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। আমরা কী পারব না এ লাভের অংশীদার হতে? অবশ্যই পারব। তবে প্রয়োজন সঠিক সিদ্ধান্ত, সততা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেম। এর ব্যত্যয় ঘটলে যা হচ্ছে তাই হবে যুগের পর যুগ ধরে। রেলওয়েতে লোকসান হয়ে আসছে গত প্রায় চার যুগ ধরে। বর্তমানে আশার আলো যাচ্ছে কয়েকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপের কারণে। তা হচ্ছে ডাবল লেন তৈরির উদ্যোগ, রেললাইন পুনঃস্থাপন ইত্যাদি।
রেলওয়ে অতীত ও বর্তমানের সব সমস্যাকে মুছে ফেলবে, দূর হবে দুর্নীতি, লুটপাট, লোকসানের গ্লানি, যাত্রী দুর্ভোগ এবং যানজট। যদি স্বচ্ছতা থাকে চিন্তা-চেতনায়, উপকৃত হবে কোটি কোটি মানুষ, দেশ যাবে আরো এক ধাপ এগিয়ে। এবারই প্রথম রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের জন্ম হলো, যা আশার আলোর নির্দেশক বলেই ভাবছেন বিজ্ঞমহল। রেলওয়ে সেক্টরে গতিশীলতা আনতে অনেক ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হবে সরকারকে। যে ক্যান্সার প্রবেশ করেছে তা রাতারাতি দূর করা সম্ভব নয়। তবে এটিও ঠিক, স্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করলে অনেক কিছুই সম্ভব, যার উদাহরণ অনেক ক্ষেত্রেই রয়েছে। রেলওয়ে শুধু যাত্রীই বহন করে না, মাদক চোরাচালানির নির্ভরযোগ্য বাহনও এটি। এদিকে সঠিক নজর পড়লে মাদক পাচারও বন্ধ হবে নিঃসন্দেহে। উল্লেখ্য, স্বচোখে দেখে এলাম রাজবাড়ী থেকে ফরিদপুর হয়ে পুকুরিয়া এবং রাজবাড়ী থেকে ভাটিয়াপাড়া পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তোলনকৃত রেললাইনটি পুনঃ স্থাপনের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে দুই বছরের মধ্যে রেলওয়ের সফলতা আসতে বাধ্য। উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে পঞ্চগড় থেকে ডাবল লেন তৈরির কাজ দ্রুতগতিতে চলছে, এটি আমাদের জন্য আশার আলোও বটে। তবে এক সরকারের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ নতুন সরকার করতে চায় না- এটাই আমাদের দেশে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এ কালচার থেকে আমাদের বের হতে হবে। ১৮৬২ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কলকাতা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেলপথ স্থাপিত হয়। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমানে প্রায় ২৮৫৫ কিলোমিটার রেলপথে ৪৮টি মালবাহী এবং ২৩৫টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। দ্রুতগামী ইন্টারসিটি ট্রেনেও যাত্রী দুর্ভোগ কমেনি কারণ সীমাহীন লেট। এর মূল কারণ ডাবল লেন না থাকা। ফলে রাস্তায় সাইড দিতে গিয়ে কোনো কোনো সময় কয়েক ঘণ্টা সময় চলে যায়। লক্ষ করা যায় ট্রেনে বসা তো দূরের কথা, দাঁড়ানোরও একটু জায়গা থাকে না, তার পরও লোকসানের ঘানি টানতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকার।
বিশ্বস্ত সূত্রমতে, ১৯৮৬ সালে ২৭টি ইঞ্জিন আমদানি করা হয় কানাডা থেকে এবং ১৯৯৬ সালে ভারত থেকে ১১টি ইঞ্জিন আমদানি করে কোনোভাবে চলছে এ গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরটি। লোকবলের অভাবে ঠিকমতো চেকিং করা সম্ভব নয়, তাই অনেক সময়ে ৩০ টাকার লোকাল ভাড়া ১০-২০ টাকা চেকিং মাস্টারের পকেটে ঢুকিয়ে চলে যাচ্ছেন অনেক যাত্রী। এ ধরনের ঘটনা আমি নিজেই প্রত্যক্ষ করেছি। এ ধরনের চিত্র কমবেশি সমগ্র বাংলাদেশে। উল্লেখ্য, নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন স্টেশন মাস্টার দুঃখ করে বলেন, আশির দশকে শক্তিশালী রেলওয়ে বোর্ডটি ভেঙে দুটি অঞ্চল ইস্ট ও ওয়েস্ট নামে বিভক্ত করাই রেলওয়ের পতনের মূল কারণ। অর্থাৎ ওই সময় থেকেই লোকসনের পাল্লা ভারী হতে থাকে, যার ধারাবাহিকতা অদ্যাবধি। এর আগে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা থেকে উন্নতমানের ট্রেনের বগি ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ তৈরি হতো। ফলে এ সেক্টরটি থেকে লাভ হতো প্রচুর। উল্লেখ্য, সৈয়দপুরে একটি বগি তৈরিতে যেখানে খরচ মাত্র ৮০ লাখ টাকা, সেই একই বগি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় চার-পাঁচ গুণ অর্থ ব্যয়ে। ফলে অধিক লোকসান হয়ে আসছে তিন যুগ ধরে। সুতরাং অতীতের অবস্থা থেকে উত্তোলনের জন্য প্রয়োজন- সৎ ও দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া, ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো, স্টেশনের চতুর্দিকে ফেনসিংয়ের ব্যবস্থা করা, ডাবল লেন তৈরি করা, যা এরই মধ্যে আরম্ভ হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে, উন্নতমানের বগি তৈরি এবং বগির সংখ্যা বৃদ্ধি করা, সব সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি ভাড়া বৃদ্ধিকরণ, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ জনবহুল শহরে মেট্রো ট্রেন ও সাবওয়ের ব্যবস্থা করা, সমগ্র দেশে মিটারগেজ অথবা ব্রডগেজ যেকোনো একধরনের ট্রেন চালু থাকা, বেদখলকৃত রেলওয়ের জমি দখলমুক্ত করে লিজ দেওয়ার ব্যবস্থা করা, পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার্থে কঙ্বাজার সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত রেল যোগাযোগ বৃদ্ধি করা, প্রত্যেক কামরায় সার্কিট ক্যামেরার ব্যবস্থা রাখা, ভ্রাম্যমাণ আদালতের নজরদারি বৃদ্ধিকরণ, আগের মতো সৈয়দপুর ও চট্টগ্রাম রেলওয়ে কারখানা থেকে চাহিদা মোতাবেক মালবাহী এবং যাত্রীবাহী বগিসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ তৈরির মাধ্যমে দেশের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা। উল্লেখ্য, আগের মতো সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানাকে সচলের মাধ্যমে বছরে প্রায় ১৪২টি যাত্রীবাহী কোচ ও চার হাজার ৫০০টি ওয়াগন তৈরি বা মেরামত করার ব্যবস্থা করা, দেশেই রেলওয়ে ইঞ্জিন তৈরির ব্যবস্থা করা, সর্বোপরি বিদেশ থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি হ্রাসের মাধ্যমে অর্থের অপচয় রোধ করা। সব ক্ষেত্রেই সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও জনসচেতনতার অভাবে তা বাস্তবায়িত হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়। যে কারণে বিভিন্ন সেক্টরে লোকসানের ঘানি টানছে সরকার। পাহাড় পরিমাণ সমস্যা নিয়েই বাংলাদেশের জন্ম। তবে সততা, আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে কাজ করলেই সব সমস্যাই দূর হতে বাধ্য।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান, মেডিসিন, সার্জারি অ্যান্ড অবস্টেট্রিঙ্ বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর

No comments

Powered by Blogger.