নদীমাতৃক বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে by আখলাক হুসেইন খান

ফ্যাপ-৬ ও মডেল স্টাডির পুরনো তত্ত্ব এবং বাঁধের পক্ষে সাফাই গাওয়া নিয়ে সমালোচনা সর্বমহলে। এ নিবন্ধে তা নিয়ে কিছু আলোচনা ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ভাবনার কথা তুলে ধরতে চাই। ফ্যাপ-৬ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহিউদ্দিন আহমদ এই উপাত্ত তুলে ধরে (২৯ ডিসেম্বর ২০১১, প্রথম আলো) ড্যামের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন।


ড্যাম চালু হলে বর্ষায় ৩১ শতাংশ বন্যার প্রকোপ কমে যাবে এবং সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পানি প্রবাহ কমবে। শুকনো মৌসুমে পানি বাড়বে ৯ ঘনকিলোমিটার ও ফেব্রুয়ারি মাসে পানির উচ্চতা বাড়বে ২ দশমিক ৬ মিটার। একই সমীক্ষার সূত্র ধরে জাহিদুল ইসলাম তাঁর নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, বর্ষায় বরাক নদের প্রবাহ সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ হ্রাস পাবে, পানির পরিমাণ ২০ শতাংশ কমে যাবে। ফলে পানির উচ্চতা ১ দশমিক ৬ মিটার কমবে। আর শুকনো মৌসুমে সর্বোচ্চ পানি প্রবাহ ১০০ থেকে ২০০ ভাগ বাড়বে। পানি ৬০ ভাগ বেড়ে যাবে। এতে পানির উচ্চতা ১ দশমিক ৭ মিটার বাড়বে। তথ্য-উপাত্তের গরমিল যা-ই হোক, পানির হিসাব আমরা এতটা বুঝি না। তবে আমাদের খটকা লাগে ড্যামের স্থান থেকে অমলশীদ পর্যন্ত বরাক নদের প্রবহমান দৈর্ঘ্য ১০০ কিলোমিটার, সুরমা ২৮৯ কিলোমিটার, কুশিয়ারা ২২৮ কিলোমিটার, মেঘনা ১৫২ কিলোমিটার। এর শাখা-প্রশাখার প্রায় ২৫টি নদীর দৈর্ঘ্য অনুমানে ধরে নেওয়া যেতে পারে কমপক্ষে ১০০০ কিলোমিটার। তাহলে সর্বমোট ১ হাজার ৭৬৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য নদী প্রবাহে উচ্চতায় ২ দশমিক ৬ মিটার পানি বৃদ্ধি হতে হলে কয়টি টারবাইন চালু থাকবে ও স্পিলওয়ে দিয়ে কি পরিমাণ পানি গড়িয়ে পড়বে এর হিসাব ও তথ্য আগে দরকার। তবেই নিশ্চিত করে বলা যাবে গড়ানো পানিতে এ উচ্চতা বৃদ্ধি আদৌ সম্ভব কি না। কেন না, গড়ানো পানি দীর্ঘ এই নদী পথ বয়ে ভাটিতে বঙ্গোপসাগরে লীন হতে থাকবে। মডেল স্টাডিতে নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি ও হ্রাসের একটা হিসাব দেখানো হয়েছে। এখানে তো আরো দেখাতে হবে ফেব্রুয়ারি মাসে বা শুকনো মৌসুমে নদীতে পানির স্তর কোন লেভেলে বা উচ্চতায় কত মিটার থাকে। তবেই বোঝা যাবে কোন স্তর থেকে পানি হ্রাস বা বৃদ্ধি পাবে। ড্যাম নির্মাণের পরে জলাধারে উজানের পানি ধরে রাখার পর ভাটিতে নদীর পানির স্বাভাবিক স্তরের লেভেল বা উচ্চতা কি বজায় থাকবে? একমাত্র উজানের পাহাড়ি বৃষ্টি ও ঢলের পানির স্রোতধারার নদী সুরমা-কুশিয়ারা। সাধারণ কমনসেন্স থেকে বোঝা যায়, উজানের পানির বিশাল পরিমাণ আটকে দিলে ভাটিতে পানির স্তরের লেভেল বা উচ্চতা নামবেই। আর এ নামার পরিমাণ তিন থেকে চার মিটার পর্যন্ত হতে পারে। টারবাইন চালু অবস্থায় স্পিলওয়ে দিয়ে পানি গড়ানো অব্যাহত থাকার পরও ওই সীমিত পানি ভাটিতে লীন হওয়ার প্রক্রিয়ায় ফেব্রুয়ারি মাসে বা শুকনো মৌসুমে বর্তমান (ড্যামের পূর্বাবস্থায়) পানির উচ্চতা বা স্তরের লেভেল বজায় থাকা সম্ভব নয়। কেন না, পানি প্রবাহ বৃদ্ধির প্রকল্প বা উপায়ও নেই। একমাত্র বৃষ্টি থেকে প্রাপ্ত পানি দিয়েই টিপাই প্রকল্প। কাজেই সীমিত পানি দিয়ে শুকনো মৌসুমে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি ও সেচের উপকারের হিসাব এবং বর্ষায় পানি প্রবাহ কমিয়ে বন্যার ঝুঁকি কমানোর ধারণাপ্রসূত হিসাব কতটা বাস্তবসম্মত? এ ছাড়া অতিমাত্রায় বৃষ্টিপাত হলে ড্যামের উপরিভাগে বন্যা দেখা দেবে এবং ওই অতিরিক্ত পানি সংরক্ষণ নয়, ফ্লাড গেইটে ছেড়ে দেওয়া হবে। এতে হাওরে বন্যার ঝুঁকি বাড়বে বৈ কমবে না। আর ফুলেরতলা ব্যারাজ হলে ৮৯ ও ১১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য দুটি খালে পানি সরিয়ে নিয়ে ১৬৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সেচ সুবিধা দেওয়া হবে। তখন নদীতে ড্যাম নির্মাণের পর ৭১৩ কিউসেক (ঘনমিটার প্রতি সেকেন্ডে) পানি প্রবাহ বৃদ্ধির স্থলে ৪০৫ কিউসেক পানি প্রবাহ বাড়বে এবং শুকনো মৌসুমে ২ দশমিক ৬ মিটারের স্থলে ২ দশমিক ১ মিটার পানি বৃদ্ধি পাবে বলে হিসাব দেখানো হয়েছে। ব্যারাজে কতটুকু পানি আসবে বা কি পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করবে, এ হিসাব ছাড়া উপরোক্ত তথ্যের সম্ভাব্যতায় আমরা ভরসা রাখতে পারি না। এ ছাড়া আমাদের ফারাক্কা ব্যারাজের একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। ১৯৭৪ সালে এ ব্যারাজ নির্মাণের সময় ভারত ভাটিতে পানি প্রবাহের হিসাব তুলে ধরেছিল। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পেলাম তার উল্টো। পদ্মা শুকিয়ে মরুপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরও ২২ বছর লেগেছে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করতে। চুক্তি অনুযায়ী ৭০ হাজার কিউসেক অথবা তার নিচে সমান অংশীদারিত্ব নির্ধারণ হয়। ৭০ ও ৭৫ হাজার কিউসেক পানি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক এবং ভারতের ক্ষেত্রে সমন্বয়সূচক নির্ধারণ হয়। ৭৫ হাজার কিউসেক অথবা ততোধিকের ক্ষেত্রে ভারত ৪০ হাজার কিউসেক এবং বাংলাদেশের জন্য সমন্বয়সূচক নির্ধারণ হয়। তার পরও পদ্মাসহ নদ-নদী ও উত্তরাঞ্চলের কি অবস্থা আমরা এ নিবন্ধের শুরুতে আলোচনা করেছি। বাস্তবতা হলো আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে অভিন্ন নদীগুলোতে একতরফাভাবে অবকাঠামো গড়ার ফলেই বাংলাদেশের নদ-নদীর মরণ দশা। মরু প্রক্রিয়ায় ধ্বংসের পথে হাওরাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চল। কাঠগড়ায় যদি তাদের দাঁড় করানো হয়, তাহলে এর ক্ষয়ক্ষতির দায় নেওয়া ও ক্ষতিপূরণ দেওয়াটা তাদের ওপরই বর্তাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বেলায় গ্যাস নিঃসরণে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে দায়ী করে যদি ক্ষতিপূরণ চাওয়া যেতে পারে, তবে নদী ও পানিসম্পদ এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসের জন্য ভারতের কাছে কেন ক্ষতিপূরণ চাওয়া যাবে না। এ প্রশ্ন আমরা তুলতেই পারি। তবুও বাংলাদেশ এসব বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে সমঝোতার স্বার্থে আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর জোর দিয়ে আসছে। এখন আমাদের উচিত বিতর্ক নয়, বিভ্রান্ত নয়, নদী বাঁচাতে, নদীমাতৃক বাংলাদেশ বাঁচাতে নদী রক্ষা ও পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সোচ্চার হওয়া।
লেখক : হাওর গবেষক

No comments

Powered by Blogger.